নিজস্ব প্রতিবেদক

২১ মার্চ, ২০১৯ ১২:০২

‘আবুসিনা ছাত্রাবাস ভবন’ সংরক্ষণের দাবি

স্থাপত্য ঐতিহ্য 'আবু সিনা ছাত্রাবাস ভবন সংরক্ষণ, প্রস্তাবিত ২৫০ শয্যার হাসপাতাল বিকল্প স্থানে নির্মাণ ও ঐতিহ্যবাহী এই ভবনকে সিলেট বিভাগীয় যাদুঘর ঘোষণার দাবিতে চলমান আন্দোলনের সাথে সিলেটের বিভিন্ন প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল, স্থাপত্য, পরিবেশ ও ঐতিহ্য রক্ষার নাগরিক সংগঠন একাত্মতা প্রকাশ করেছেন।

বুধবার রাত ৮টায় সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদস্থ মতিন উদ্দিন যাদুঘরে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেট শাখার উদ্যোগে সিলেটের প্রতিনিধিত্বশীল বিভিন্ন প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল, নাগরিক, সাংস্কৃতিক, স্থাপত্য, পরিবেশ ও ঐতিহ্য রক্ষার সংগঠনের নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় এই একাত্মতা প্রকাশ করা হয়। মতিন উদ্দিন জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা ডা. মোস্তফা শাহজামান চৌধুরী বাহারের সভাপতিত্বে আয়োজিত সভায় বাপা সিলেট শাখার সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম স্বাগত বক্তব্য দেন।

প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল সমূহের পক্ষ থেকে সাম্যবাদী দল-এর কেন্দ্রীয় পলিট ব্যুরো সদস্য ও সিলেট জেলা সাধারণ সম্পাদক কমরেড ধীরেন সিংহ, গণতন্ত্রী পার্টির সিলেট জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোঃ আরিফ মিয়া, ওয়ার্কার্স পার্টি সিলেট জেলার সাধারণ সম্পাদক সিকান্দার আলী, বাংলাদেশ জাসদের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও মহানগর জাসদের সভাপতি অ্যাডভোকেট জাকির আহমদ, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) সিলেট জেলার সাধারণ সম্পাদক এম.এ মতিন, বাসদ সিলেটের আহ্বায়ক আবু জাফর, সিপিবি জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন সুমন ভবন রক্ষার চলমান আন্দোলনের সাথে সংহতি প্রকাশ করে বলেন, সিলেটের ঐতিহ্যবাহী আলিয়া মাদ্রাসা মাঠের দক্ষিণপ্রান্তে বহুতল ভবনে হাসপাতাল নির্মাণ কোন বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত নয়। ভবিষ্যতে এই মাঠে জাতীয় নেতৃবৃন্দের জনসভা আয়োজন নিরাপত্তাহীন হবে। সিলেট নগরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য আবু সিনা ছাত্রাবাস ভবন সংরক্ষণ করা জরুরী। এই ভবনের সাথে মুক্তিযুদ্ধ ও সিলেটের প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশের ইতিহাস জড়িত।

সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি সাংবাদিক আজিজ আহমেদ সেলিম বলেন, প্রধানমন্ত্রী ঐতিহ্য রক্ষা করে উন্নয়ন করার পরামর্শ দিয়েছেন। তাই স্থানীয়ভাবে দাবি আদায় না হলে প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিষয়টি তুলে ধরতে হবে।

সু শাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেট শাখার সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ২৫০ শয্যার হাসপাতালটি বাদাঘাট এলাকায় বা স্বাস্থ্য বিভাগের বেদখল হয়ে যাওয়া জায়গা উদ্ধার করে নির্মাণ করা যেতে পারে।

লিডিং ইউনিভার্সিটির স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ সৈয়দা জেরিনা হোসেন বলেন, যানজটে নাকাল সিলেট নগরীর এই ব্যস্ত সড়কে আরেকটি হাসপাতাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত কোনভাবেই যুক্তিসংগত নয়।

সভাপতির বক্তব্যে মতিন উদ্দিন জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা ডা. মোস্তফা শাহজামান চৌধুরী বাহার বলেন, ১৮৫০ সালে এই ভবনের প্রথম পর্বের নির্মাণ কাজ হয়। মিশনারিদের উদ্যোগে এখানে সর্বপ্রথম স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হয়। ১৮৭৬ সালে এখান থেকেই প্রকাশিত হয় সিলেটের প্রথম সংবাদপত্র‘শ্রীহট্ট প্রকাশ’। ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে এই ভবন সেনা ছাউনি হিসাবে ব্যাবহার হয়। পরে ১৯৩৬ সালে এ বাড়িতে মানুষের চিকিৎসাসেবার জন্য ছোট পরিসরে হাসপাতাল চালু করা হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় এ হাসপাতালের বর্ধিতাংশে বার্মা-ইংরেজ সৈনিকদের চিকিৎসা দানের লক্ষ্যে মিলিটারি হাসপাতাল চালু করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৪৮ সালে এ ভবনে মেডিকেল শিক্ষাদানের জন্য নির্মাণ করা হয় ‘লাইসেন্সড মেডিকেল ফ্যাকাল্টি’ (এলএমএফ)। ১৯৬২ সালে এটিকে মেডিকেল কলেজে রূপান্তরিত করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৮-৭৯ সালে হাসপাতালটি কাজলহাওরে পরিপূর্ণভাবে স্থানান্তরিত হলে ভবনটি ‘আবু সিনা ছাত্রাবাস’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তিনি বলেন, জেলা স্টেডিয়ামের পাশে হাসপাতাল নির্মাণ করা হলে রোগীরা খেলা চলাকালে শব্দ দূষণের শিকার হবে।

স্বাগত বক্তব্যে আব্দুল করিম কিম স্থাপত্য ঐতিহ্য আবু সিনা ছাত্রাবাস ভবন সংরক্ষণের চলমান আন্দোলনের বিস্তারিত তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সুরমা নদীর তীরে গড়ে ওঠা হাজার বছর প্রাচীন সিলেট নগরীতে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপত্যকর্মের সামান্য চিহ্ন আর অবশিষ্ট নেই। ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা হওয়ায় প্রাচীন স্থাপত্য দূরের কথা সুলতানি আমল ও মোগল আমলের স্থাপত্যকর্মই ধ্বংস হয়ে গেছে। এমনকি ব্রিটিশ আমলে তৈরি কলোনিয়াল স্থাপত্যরীতির সাথে মোগল ও আসাম ভ্যালীর স্থাপত্যরীতির মিশেলে তৈরি প্রাচীন ভবনগুলো অবহেলা ও অজ্ঞতায় হারিয়ে গেছে। টিকে থাকা হাতেগোনা ভবনগুলোর মধ্যে অনবদ্য নির্মাণ শৈলীর আবু সিনা ছাত্রাবাস ভবন সিলেটের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে নানাভাবে সম্পৃক্ত। সেই ঐতিহাসিক ভবনটি ভেঙ্গে সেখানে ২৫০ শয্যার ১৫ তালা ভবন নির্মাণের সংবাদে বাপার পক্ষ থেকে শাহজালাল ও লিডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে গত ১২ই মার্চ একটি মানববন্ধন কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে ভবন সংরক্ষণের আন্দোলন শুরু হয়। ১৩ই মার্চ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘সেভ দ্য হেরিটেজ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’-এর উদ্যোগে আয়োজন করা হয় প্রতিবাদী অবস্থান কর্মসূচির।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষক স্থপতি সুব্রত দাস ও কৌশিক সাহা ভবনটির স্থাপত্যরীতি ও প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব তুলে ধরে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগ একটি গবেষণা কর্ম উপস্থাপন করেন। তাঁরা বলেন, কোন ভবন বা স্থাপনা মূলত সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক বা ব্যবহারিক মূল্য বিবেচনায় সংরক্ষণ করা বা ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করা হয়। এই ভবনটি নগরের কেন্দ্রস্থলে থাকা সত্ত্বেও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তালিকাভুক্ত না হওয়াটা বিস্ময়কর।

‘সেভ দ্য হেরিটেজ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট -এর প্রধান সমন্বয়ক আব্দুল হাই আল হাদী বলেন, সিলেটের প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ রক্ষায় আমাদের উদাসীনতা দুর্ভাগ্যজনক।

সভায় অন্যান্যের মধ্যে আরও বক্তব্য রাখেন উদীচী সিলেটের সভাপতি এনায়েত হাসান মানিক, সম্মিলিত নাট্য পরিষদ সিলেটের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শামসুল বাসিত শেরো, যুব ইউনিয়ন জেলা সভাপতি খায়রুল হাসান, নারীমুক্তি কেন্দ্রের আহবায়ক ডা. ফাতেমা ইয়াসমিন, বাসদ (মার্কসবাদী)-এর নেতা সুশান্ত সিনহা সুমন ও প্রসেনজিৎ রুদ্র, আইনজীবী মো মাহবুবুল আলম, চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র সিলেট এর সংগঠক রুবাইয়াৎ আহমেদ, হাবিবুর রহমান প্রমুখ।

সভায় সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয় যে, বাপা' সিলেট শাখার নেতৃত্বেই চলমান আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থিত নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে স্থাপত্য ঐতিহ্য 'আবু সিনা ছাত্রাবাস ভবন সংরক্ষণ, প্রস্তাবিত ২৫০ শয্যার হাসপাতাল বিকল্প স্থানে নির্মাণ ও ঐতিহ্যবাহী ভবনকে সিলেট বিভাগীয় যাদুঘর ঘোষণার দাবিতে স্মারকলিপি দেয়ারও সিদ্ধান্ত হয়।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত