সিলেটটুডে ডেস্ক

১৯ এপ্রিল, ২০১৯ ১৮:৩৬

‘খণ্ডিত নয়, ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার পুরোটা সংরক্ষণ করুন’

বিশ্ব ঐতিহ্য দিবসের আলোচনা সভায় সিলেটের ঐতিহ্য রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ নাগরিক সমাজ

সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের আবু সিনা ছাত্রাবাস হিসেবে ব্যবহৃত দেড়শতাধিক বছরের ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার আংশিক বা খন্ডিত অংশ নয়, পুরোটা সংরক্ষণ করার আহবান জানিয়েছেন সিলেটের ঐতিহ্য রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ নাগরিক সমাজ। সিলেটের দেড়শ বছরের প্রাচীন স্থাপত্য পুরাতন মেডিকেল বা বর্তমান আবু সিনা ছাত্রাবাস ধ্বংসের উদ্যোগ দেখে বিভিন্নধারার নাগরিকেরা সম্প্রতি এই নাগরিক প্ল্যাটফর্ম গঠন করে সিলেটের ঐতিহ্য রক্ষায় বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করে আসছেন।

গত বুধবার ঐতিহ্যবাহী ভবনের আংশিক রেখে বাকিটা ভেঙ্গে ফেলার বিষয়ে সিলেটে পরারাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন গণমাধ্যমে মন্তব্য করেন। সেই মন্তব্যের প্রেক্ষিতে গত বৃহস্পতিবার রাতে বিশ্ব ঐতিহ্য দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত আলোচনা সভায় নাগরিক সমাজের পক্ষ্ থেকে ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার পুরোটা সংরক্ষণের আহবান জানানো হয়।

বিশ্ব ঐতিহ্য দিবস উপলক্ষ্যে সিলেটের কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের (কেমুসাস) পঞ্চম তলায় ভাষাসৈনিক মতিন উদ্দীন আহমদ জাদুঘরের সভাকক্ষে বৃহস্পতিবার রাত নয়টায় অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় বিশ্ব ঐতিহ্য দিবস পালনের গুরুত্ব, সিলেটের ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও আবু সিনা ভবন বিষয়ে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বিশদ আলোচনা করেন।

আলোচনা সভায় অংশগ্রহণকারী বক্তারা সিলেটের বিভিন্ন ঐতিহ্য সংরক্ষণে নিজেদের অঙ্গিকার ব্যাক্ত করেন। বক্তারা বলেন, ১৯৮২ সালে তিউনিশিয়ায় একটি আলোচনা সভার আয়োজন করে ‘ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল ফর মনুমেন্টস অ্যান্ড সাইটস’। সভায় ‘ইন্টারন্যাশনাল ডে ফর মনুমেন্টস অ্যান্ড সাইটস’ হিসাবে ১৮ এপ্রিলকে 'বিশ্ব ঐতিহ্য দিবস' হিসাবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৯৮৩ সালে ইউনেস্কো এই দিবসের স্বীকৃতি দেয়। ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে হলে অতীতকে সংরক্ষণ করতে হবে। ঐতিহ্য’ নিয়ে উন্নত বিশ্বে যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা করা হয়, তা আমরা এখন পর্যন্ত শুরু করতে পারিনি। তাই ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ভেঙ্গে ফেলার অন্যায় সিদ্ধান্ত এখানে সহজে অনুমোদন পেয়ে যায়। কেউ সেই সিদ্ধান্ত যে ভুল সেটা কাগজে কলমে বুঝিয়ে দেয়ার পরেও তা শোধরানোর চেষ্টা না করে ঐতিহ্যকে প্রসাধন বলার দরবারী প্রয়াস চালানো হয়।  

সর্বশেষ গত বুধবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী গণমাধ্যমে যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেখানে তিনি আবু সিনা ভবনকে ঐতিহ্যবাহী ভবন স্বীকার করে নিলেও ভবনের কিছু অংশ সংরক্ষণ করে বাকিটা ভেঙ্গে ফেলার কথা বলেছেন। ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা খণ্ডিতভাবে সংরক্ষণের চিন্তা কোন ভাবেই সরকারের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDGs)'র সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
পররাস্ট্রমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে হাসপাতাল নির্মাণ কাজের অর্থ বরাদ্দ চলে যাওয়ার আশঙ্কায় হাসপাতাল নির্মাণ অব্যাহত রাখার কথা বলেছেন এবং ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার কিছু নমুনা সংরক্ষণ করে হাসপাতাল নির্মাণ করা যেতে পারে-এমন মতামত ব্যক্ত করেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন মন্তব্যে বিস্ময় প্রকাশ করে, ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা সংরক্ষণ দাবিতে সোচ্চার নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলেন, ‘যখন প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছিল, তখন প্রকল্পস্থল যে একটি শতবর্ষী স্থাপনা, সেটি গোপন করেই স্থান নির্বাচন করা হয়। পরবর্তীতে স্থাপনা ভেঙ্গে ফেলার বিষয়টি আলোচিত হলে ভবনটি শত বছরের মানতেও চাচ্ছিলেন না কেউ কেউ। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মা'ল আব্দুল মুহিত নাগরিকদের অনুরোধে ভবনটি পরিদর্শন করতে গিয়ে গত ২৪ মার্চ ভবনটি ঐতিয্য হিসাবে সংরক্ষণের পক্ষে মতামত ব্যাক্ত করেন। এবার পররাস্ট্রমন্ত্রীও ভবনটিকে ঐতিহ্য বলে স্বীকার করায় ঐতিহ্য কথাটি সরকারীভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

বক্তারা বলেন, কোনো ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা সম্পূর্ণরুপে সংরক্ষণ করার সুযোগ থাকা সত্বেও তা ভেঙ্গে ফেলে আংশিক অংশ সংরক্ষণ করার প্রস্তাব সুবিবেচনার নয়। সম্পূর্ণ গোপনীয়ভাবে একটি ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ধ্বংস করে সেখানে হাসপাতাল নির্মানের উদ্যোগ বাংলাদেশের প্রত্নতত্ব আইন ও ঐতিয্য রক্ষার আন্তর্জাতিক অঙ্গিকারের সাথে সাংঘর্ষিক। বিষয়টি সর্বসাধারণে আলোচিত হওয়ার সাথে সাথেই এই ভবন প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের ঐতিয্য তালিকায় কেন তালিকাভুক্ত হয়নি, রাস্ট্রের কর্তাব্যাক্তিদের উচিৎ ছিলো- সেই কারন খুঁজে বেড় করা ও অবিলম্বে ভবনটি তালিকাভুক্ত করার নির্দেশ প্রদান করা। কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্যে ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার আংশিক সংরক্ষণ কার্যত বিশ্বব্যাপী সমাদৃত ঐতিহ্য সুরক্ষার দাবির প্রতি উপহাস হয়েছে এবং তাঁর অগ্রজ সাবেক অর্থমন্ত্রীর আকাংখার প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করা হয়েছে।’

সিলেটের ঐতিহ্য রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ নাগরিক সমাজ মুখপাত্র ও ভাষাসৈনিক মতিন উদ্দীন আহমদ জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ডা. মোস্তাফা শাহজামান চৌধুরী বাহারের সভাপতিত্বে সভায় সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এমাদ উল্লাহ শহিদুল ইসলাম, সাম্যবাদী দলের সভাপতি ধীরেন সিংহ, জাসদ কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক জাকির আহমদ, নাগরিক মৈত্রীর সমন্বয়ক সমর বিজয় সী শেখর, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম, শাহজালাল বিশবিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষক কৌশিক সাহা, লেখক ও গবেষক সৈয়দ মবনু, নারী মুক্তি সংসদের সভানেত্রী ইন্দ্রানী সেন, মেঠোসুর সম্পাদক বিমান তালুকদার প্রমুখ।

সভায় ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা রক্ষায় দেশে ও বিদেশের শত নাগরিকদের বিবৃতি পরবর্তী ধাপ হিসেবে ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা রক্ষায় নাগরিক সমাজ ও স্থপতিদের মতামত সংবলিত একটি স্মারকলিপি প্রধানমন্ত্রী বরাবর পাঠানো এবং প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরকে স্থানান্তর হওয়া আবু সিনা ছাত্রাবাস এলাকাকে ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করার জন্য তথ্য ও দলিলাদির মাধ্যমে পত্র পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। চলতি সপ্তাহের মধ্যে এ দুটো পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার পুরোটা সংরক্ষিত করে ২৫০ শয্যার হাসপাতালটি স্থানান্তরের জন্য সিলেট নগরীর শাহী ঈদগাহ এলাকার সংক্রমন ব্যাধি হাসপাতালে স্থানান্তর করার প্রস্তাব করা হয়। এ জন্য শাহী ঈদগাহ এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে দাবি উত্থাপনে জনমত সংগ্রহের সিদ্ধান্ত হয়।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত