সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি

১৯ এপ্রিল, ২০১৯ ১৯:৫১

সুনামগঞ্জে যুবক খুনের নেপথ্যে বালুমহালের চাঁদাবাজি, গ্রেপ্তার ৮

সুনামগঞ্জে নৌ-পথে বালু পাথর বাহি নৌকা থেকে চাঁদাবাজির দ্বন্ধের জের ধরে প্রতিপক্ষের হাতে মিজানুর রহমান (২৫) নামক এক যুবক খুনের ঘটনায় আট জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

বৃহস্পতিবারের ওই হত্যাকান্ডের ঘটনায় নিহতের বড়ভাই জুনেদ মিয়া ওরফে জুনায়েদ ২৪ জনকে অভিযুক্ত করে রাতেই সদর মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। বালুমহালের চাঁদাবাজির আধিপত্য নিয়ে দ্বন্দ্ব থেকেই এ হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটচে বলে জানিয়েছে পুলিশ

নিহত মিজানুর রহমান সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের ইব্রাহিমপুরের গ্রামের  মৃত আবদুর রহিমের ছেলে।

বৃহস্পতিবার সকাল ৭ টার দিকে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার অক্ষয় নগর গ্রামের খালের তীরে প্রতিপক্ষের লোকজন কুপিয়ে মিজানুরকে হত্যা করে।

এ ব্যাপারে শুক্রবার সন্ধ্যায় সুনামগঞ্জ সদর থানার ওসি মো. শহীদুল্লাহ্ বলেন, ‘ঘটনায় জড়িত ৮ জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।, তিনি আরো বলেন, প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে হত্যাকান্ড যারা ঘটিয়েছে এবং যে যুবক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে মুলত দুই পক্ষই বিভিন্ন রশিদে ধোপাজান নদীতে বালু পাথর বাহি নৌকা ট্রলার, বারকি নৌকা, বাল্ক হেট, কার্গো ও জাহাজ থেকে চাঁদা তোলে। ইউনিয়ন ট্যাক্সের কথা বলেও চাঁদা তোলা হয়।

ঘটনার পরপর নিহতের বড়ভাই জুনেদ মিয়া জুনায়েদ জানান, সদর উপজেলার সদরগড় গ্রামের মসজিদের নামে প্রতিদিনের ন্যায় বালু -পাথর বাহি ষ্টিলবাডি নৌকা থেকে টাকা (চাঁদা) কালেকশান করতে গ্রামের বাড়ি ইব্রাহীমপুর থেকে মিজানুর রহমান তার অপর দুই সহযোগীসহ বৃহস্পতিবার সকাল ৭টার দিকে বাড়ি থেকে বের হয়ে পাশের গ্রাম অক্ষয় নগরের খালের মুখে যান।

পরবর্তী সদর উপজেলার একই ইউনিয়নের সদরগড় গ্রামের নজরুল ইসলাম ওরফে নুর জামানের নেতৃত্বে প্রতিপক্ষের চাঁদা আদায়কারী গ্রুপের ২০ থেকে ২৫ জনের একটি দল মিজানুরকে টাকা কালেকশানে বাঁধা প্রদান করে। তারা প্রথমে মিজুনরকে মারধর করে পরবর্তীতে ধারালো রামদা দিয়ে কুপিয়ে মিজানুরের লাশ খালের মুখে ফেলে রেখে যায়। এ সময় প্রতিপক্ষের হামলার শিকার হয়ে মিজানুরের মামা রেজাউলও আহত হন।

খবর পেয়ে সুনামগঞ্জ সদর মডেল থানা পুলিশ ওইদিন সকাল পৌণে ১০টায় ঘটনাস্থলে পৌছে  লাশ জেলা সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠায়।

ঘটনা সম্পর্কে নৌ-পথে চলাচলকারী নৌযানের একাধিক মালিক, বালু পাথর ব্যবসায়ী ও এলাকার প্রত্যক্ষদর্শী লোকজন জানান, মুলত বৃহস্পতিবার ধোপাজান চলতি নদীর পূর্বপাড়ে পূর্ব সদরগড় এলাকায় বালু মহালে চাঁদাবাজি নিয়ে পূর্ব বিরোধের জের ধরেই মিজানুর রহমান নামের ওই যুব খুন হয়েছেন।
 
পুলিশের দায়িত্বশীল একটি সুত্র ও এলাকাবাসী আরো জানান, হত্যাকান্ডের শিকার ও হত্যাকারী দুটি পক্ষই নৌ-পথে চাঁদাবাজির ঘাট নিয়ন্ত্রন নেয়ার দ্বন্দ্বের জের ধরে ওই হত্যাকান্ডের ঘটনাটি ঘটিয়েছে। তারা আরো জানান, ধোপাজান বালু পাথর মহালে বাংলাদেশ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিটিএ), সুরমা ইউনিয়ন ট্যাক্স, চলতি নদী উজানভাটি, এমনকি বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ( মসজিদ-মাদ্রাসা) সহ একাধিক প্রতিষ্ঠানের রশিদে বালু-পাথর বহনকারী বাল্কহেড, কার্গো, ইঞ্জিন চালিত ট্রলার এবং বারকী শ্রমিকদের নিকট থেকে নামে বেনামে কয়েক লাখ টাকা চাঁদা আদায় হয়।

জেলা শহরের একাধিক প্রভাবশালী মহলের আর্শীবাদ পৃষ্ঠ হয়ে নৌ -পথে চাঁদাবাজির  এই নিয়ন্ত্রণ নিয়ে জেলা শহরের তেঘরিয়া, জেলা শহর ঘেষা অলিরবাজার ও পশ্চিম সদরগড়ের কিছু যুবককের সাথে ইব্রাহিমপুর ও পূর্ব সদরগড়ের কিছু যুবকের পুরনো বিরোধ রয়েছে।

ওই বিরোধের জের ধরে বৃহস্পতিবার সকালে প্রতিপক্ষের ১০-১২ জনের ধারালো অস্ত্রের আক্রমণে খুন হন মিজানুর রহমান। এলোপাতাড়ি কুপিয়ে মিজানের এক হাত কেটে নেওয়া হয়। অন্য হাতের কব্জি কাটা হয়। শরীরের বিভিন্ন স্থানে কোপানো হয় তাকে। এসময় মিজানের সঙ্গে থাকা তার মামা ও ব্যবসায়িক পার্টনার রেজা উদ্দিন আহত হন।
পুলিশ এ হত্যাকান্ডের ঘটনায় জড়িত থাকায় তাৎক্ষণিকভাবে ও বৃহস্পতিবার রাতভর অভিযান চালিয়ে সদর উপজেলার  সদরগড় গ্রামের মৃত আবদুল হেকিমের ছেলে নজরুল ইসলাম ওরফে নুর জামাল একই গ্রামের,  হাজি মাছিম আলীর ছেলে আবদুল হাই, গুলজার আহমদের ছেলে ছাত্তার হোসেন, শেরগুল আলীর ছেলে কামাল মিয়া,  রেনু মিয়ার ছেলে সাইফুল ইসলাম, জমির আলীর ছেলে আবুল কালাম, ইব্রাহিমপুর গ্রামের মৃত সজ্জাদ আলীর ছেলে আব্দুল মালেক, আবদুল মান্নানের ছেলে আলী আনোয়ার সহ আটজনকে গ্রেপ্তার করে।  

আহত রেজা উদ্দিন জানান, বৃহস্পতিবার সকাল ৭ টায় আমার ভাগ্না মিজানুর আমাকে ফোন দিয়ে নদীর পাড়ের আব্দুন নূরের চায়ের দোকানে নিয়ে গেলে ওখানেই নদীতে নানা নামে নানা রশিদে টাকা আদায়কারী পশ্চিম সদরগড়ের নূর জামাল, আব্দুন নূর, রোকন মিয়া, খোকন মিয়া ও তেঘরিয়ার বশির আহমদসহ ১০ থেকে ১২ জন চা ষ্টলে ঢুকে প্রথমে  আমার মাথায় ঘুষি মারে । চা ষ্টল থেকে আমরা সরে যাওয়ার করলে তারা দা, রামদা নিয়ে ফের হামলার করে। এসময় আমি সাঁতার কেটে নদীর পূর্বপাড়ে আসার চেষ্টা করি আর মিজানুরকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে বর্বরভাবে খুন করে।

মসজিদের নামে টাকা কালেকশানের বিষয়ে নিহত মিজানের ভাই জুনেদ গণমাধ্যকে বলেন, ‘আমার ভাই ব্যবসায়ী, সে চাঁদাবাজির সঙ্গে যুক্ত নয়। গ্রামের জামে মসজিদের পক্ষ থেকে মিজানুর সহ কয়েকজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ধোপাজান বালু পাথর মহাল থেকে মসজিদের সহায়তার অর্থ তুলতে। বৃহস্পতিবারও নদীতে মসজিদের অর্থ সংগ্রহ করতে গিয়েছিল মিজানুর।’

সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার  সুরমা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুস ছাত্তার বলেন, ‘আমরা নদী থেকে টোল আদায়ের জন্য কোন ইজারা দেইনি। আমাদের ইউনিয়ন পরিষদের নামে রশিদ ব্যবহার করে নৌ পথে চাঁদা আদায় যদি কেউ করে সেটি চাঁদাবাজি হিসাবেই গণ্যহবে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত