মিনহাজ উদ্দিন, গোয়াইনঘাট

২২ এপ্রিল, ২০১৯ ১৪:৪৩

জৈন্তাপুরে কফি চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা

সিলেটের জৈন্তাপুরের পাহাড়ি ঢালু মাটিতে কফি চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এখানকার পাহাড়ি দো-আশ বেলে মাটি ও বৃষ্টিপাত প্রবণ অঞ্চল হওয়ায় তা সম্পূর্ণরূপে কপি চাষের অনুকূলে এবং উপযোগী মনে করছেন কৃষি সংশ্লিষ্টরা।

এখানকার জলবায়ু, আবহাওয়ার অবস্থান চা শ্রেণির এ ফসল চাষে ক্ষতিকর না হওয়ায় লাভজনক এ ফসল বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় একটি অঞ্চল হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে জৈন্তাপুর উপজেলা।

শখের বসে কফি চাষে উদ্বুদ্ধরা জানিয়েছেন, চা নয় বাণিজ্যিকভাবে কফি চাষ ও উৎপাদনে উৎসাহিত হলে স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে তা রপ্তানি করে জৈন্তাপুরের মানুষজন অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারবেন। পাশাপাশি স্থানীয় রাজস্ব ভাণ্ডারের চাকাও গতিশীল হবে বলে মনে করছেন তারা।

সোমবার জৈন্তাপুর ইমরান আহমদ মহিলা কলেজের সহযোগী অধ্যাপক খায়রুল ইসলামসহ সরেজমিনে সিলেটের জৈন্তাপুরে খাসিয়া হাটিতে গেলে এ অঞ্চলে কফি চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনাময়তার কিছু চিত্র ফুটে ওঠে।

জৈন্তাপুর উপজেলা সদরের কাছে অবস্থিত ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর গ্রাম তৌশি হাটি (খাসিয়া হাটি)। সমাজের শান্তিপ্রিয় জনগোষ্ঠী খাসিয়াদের বসবাস এ গ্রামজুড়েই। এ গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িই যেন একেটি বাগান বাড়ি। খাসিয়া জনগোষ্ঠীর মানুষজন সবকটি বাড়িকে করেছেন জুম চাষের আওতাভুক্ত। প্রতিটি বাগানেই রয়েছে পান, সুপারি, কমলালেবু, লেবু, নানা জাতের কলা, সাতকরাসহ ফলমূল।

এ গ্রামের বাসিন্দা স্থানীয় লামনিগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষক প্রদীপ লানো। পেশায় শিক্ষকতা করে আসা এ খাসিয়া বয়োবৃদ্ধ শিক্ষা সচেতন এলাকা তথা খাসিয়া (খাসি) সম্প্রদায়ের ইতিহাস ঐতিহ্যের একজন মুখ্য ধারকও। খাসিয়া জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা, কৃষ্টি-সংস্কৃতি, স্থাপত্যশৈলী আর এ জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যের ছবি আর বিভিন্ন বই-পুস্তকের সারি শোভা পাচ্ছে তার ঘরের দেয়াল আর আলমারিতে।

স্থানীয় ইতিহাসবিদদের মতে, তিনি এ জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে পুরনো একজন ইতিহাস সংরক্ষক। গুণী এই সাবেক শিক্ষকের বাড়িতে রয়েছে কফি গাছ। পৌনে ২ বিঘার তার বাড়িটি যেন একটা ফল বাগান। এ বাড়িতেই তিনি অন্যান্য ফসলের সাথে ২০১৩ সালে উপজেলার মোকামপুঞ্জি থেকে রোপণ করে এনেছিলেন কফি গাছের চারা। শখের বসে তিনি এগুলো রোপণ করেন বাড়ির সীমানা প্রাচীরের কাছে। বিগত দুই বছর থেকে এ গাছগুলোতে ফল ধরা শুরু করেছে।

আঙ্গুরের মতো আকৃতির তার বাড়ির কফিগুলো অত্যন্ত চমৎকার রঙের। বর্তমানে দুটি গাছে প্রচুর পরিমাণে ফল ধরে পেকে গিয়ে লাল রং ছড়িয়েছে। লতানো গাছে চিকন ডালে ডালে ঝুলে থাকা কফিগুলো দেখতেও বেশ ভালো লাগে।

এ প্রবীণ শিক্ষক জানান, আমি একজন খাসিয়া জনগোষ্ঠীর মানুষ। আমি আমার স্ব-জাতীয়দের ন্যায় জুমচাষকে ভালোবাসি। আমাদের জুমসমূহে উৎপাদিত সব ধরণের ফসল, ফলমূলের পাশাপাশি আমি আমার বাড়িতে বেশকটা কফি গাছ লাগিয়েছিলাম। শখের বসে লাগানো এসব কফি বাঁচবে কিংবা ফল দিবে তা আশা করিনি। তবে জলবায়ু, আবহাওয়া আর জৈন্তাপুরের পাহাড়ি দো-আশ বেলে মাটির কারণে গাছগুলো বেঁচে আছে এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ ফল উৎপাদন করতে পারছি।

তিনি জানান,আমি শখের বসে এটা চাষ করেছি তবে এখানকার জলবায়ু, আবহাওয়া কফি চাষের অনুকূলে হওয়ায় আমি মনে করি কফি চাষে এখানকার কৃষকসহ মানুষজনের জড়ানো দরকার। অতি বৃষ্টিপ্রবণ এ এলাকায় যদি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কফি চাষ শুরু হয় তাহলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস গোটা জৈন্তাপুরের পাহাড়-টিলাময় পতিত ভূমি থেকে বছরে কোটি কোটি টাকা আয় করা সম্ভব।

তিনি বলেন, পাহাড়ি এ অঞ্চলের মাটিতে চা বাগান না করে কফি বাগান ব্যবস্থাপনায় মনোযোগী হলে চায়ের চেয়ে দ্বিগুণ লাভবান হওয়া যাবে।

তিনি এ ব্যাপারে জনগণকে উদ্বুদ্ধকরণসহ দ্রুত উদ্যোগ জৈন্তাপুর উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রতি জোর দাবি জানান।

এ বিষয়ে জৈন্তাপুর ইমরান আহমদ মহিলা কলেজের সহযোগী অধ্যাপক মো. খায়রুল ইসলাম জানান, জৈন্তাপুরে আমিই প্রথম এখানকার কফি উৎপাদনের বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের মাধ্যমে জনসম্মুখে নিয়ে আসি। আমাদের জৈন্তাপুর অঞ্চলটা কৃষি বিপ্লবের এক অপার সম্ভাবনাময় এলাকা। এখানকার কৃষি আবাদ ব্যবস্থাপনা এখনো মান্ধাতার আমলেই সীমাবদ্ধ। প্রান্তিক কৃষকসহ জুম চাষ ব্যবস্থাপনায় আশানুরূপ ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে। এখানকার মাটি অত্যন্ত উর্বর ও পরিবেশ, জলবায়ু, আবহাওয়া সবই মানানসই।

তিনি বলেন, এখানকার কৃষি আবাদে বাণিজ্যিকভাবে কফি চাষকে সম্পৃক্ত করা গেলে আমার ধারণা বাম্পার ফলন আসবে। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে উৎপাদিত কফি রপ্তানি করা যাবে এবং উৎপাদিত কফি বিক্রি করে আর্থিক সচ্ছলতা বৃদ্ধি পাবে। তবে স্থানীয় কৃষি বিভাগের সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতার কারণে এ ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্থানীয় কৃষি বিভাগ থেকে উদ্বুদ্ধকরণসহ জনসাধারণকে কফি চাষে সংযুক্ত করা গেলে সরকারের কৃষি সম্প্রসারণ ব্যবস্থা আরও এগিয়ে যাবে এবং স্থানীয় রাজস্ব আদায় ব্যবস্থাও প্রসারিত হবে।

এ ব্যাপারে কথা হলে জৈন্তাপুরের উপজেলা কৃষি অফিসার ফারুক হোসেন জানান, ব্রাজিল আর সিলেটের আবহাওয়া প্রায় একই ধরণের। অতিবৃষ্টির জন্য বলতে পারেন অদ্বিতীয় অঞ্চল সিলেট। জেলার জৈন্তাপুর উপজেলাও একই ধরণের আবহাওয়া বিদ্যমান। কফি চাষের জন্য এখানকার মাটি ও আবহাওয়া অত্যন্ত উপযোগী। সরকারের তরফ থেকে এখনো এখানে কফি চাষের কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। তবে এখানকার মাটি, জলবায়ু,আবহাওয়া কফি চাষে উপযোগী হওয়ায় এ খাতে বিনিয়োগ করলে লোকসান নয়, বরং বাম্পার ফলনই আশা করা যাচ্ছে।

তিনি বলেন, বিষয়টি আমরা সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে অবহিত করব, যাতে বিষয়টি প্রসারে সরকার উদ্যোগী হোন। ব্যক্তিগতভাবে কেউ কফি চাষে উদ্যোগী হলে আমাদের তরফে সব ধরণের সহযোগিতা করবো।

জৈন্তাপুর সাইট্রাস গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ঝুটন চন্দ্র সরকার জানান, জৈন্তাপুরের পাহাড়ি ঢাল মাটিতে কফি চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। এটা অত্যন্ত লাভজনক চা জাতীয় ফসল। এখানকার আবহাওয়া ও জলবায়ু কফি চাষের জন্য সহনশীল। কফি গাছের রোগবালাই খুবই কম। তাছাড়া এ গাছের শিকড় মাটি ভেদ করে অনেক গভীরে ঢুকে প্রসারিত থাকে ফলে শুষ্ক মৌসুমে তা পানি শূন্যতায় মারা যাওয়ার সম্ভাবনাও থাকে না।

তিনি বলেন, পাহাড়-টিলার ভূমিধ্বস রোধেও এ গাছ ভূমিকা পালন করতে পারে। জৈন্তাপুরে বাণিজ্যিকভাবে কফি আবাদ প্রসারিত হলে বেকারত্ব দূর করার পাশাপাশি তা স্থানীয় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথ সুগমেও সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত