তপন কুমার দাস, বড়লেখা

১৬ মে, ২০১৯ ০০:৫২

‘ছেলেও গেল, বাড়িও গেল’

ভূমধ্যসাগরে ট্র্যাজেডিতে নিহত বড়লেখার ফাহাদের মায়ের বিলাপ থামছে না

ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে ছেলে মারা গেছেন। এ কথা শোনার পর থেকেই বারবার অজ্ঞান হয়ে পড়ছেন মা। ছেলের কথা বলছেন আর কান্নাকাটি করছেন। ছেলে ফাহাদ আহমদ (১৮) নৌকাডুবিতে নিখোঁজ হয়েছে ভূমধ্যসাগরে। ছেলের স্বপ্নের কথা বলে মা আয়েশা আক্তারের বিলাপ আর থামছে না।

ফাহাদের মা আয়েশা আক্তার কান্নাজড়িত কন্ঠে বুধবার (১৫ মে) যখন কথা বলছিলেন, কোনো কথাই গুছিয়ে বলতে পারছিলেন না। বললেন ছেলের সাথে শেষ কথা হয়েছে গত ৮ মে রাত আটটায়। ছেলে বলেছে, ‘মাইগো, আমি যাইরামগি (চলে যাচ্ছি)। আমারে যে টেখা (টাকা) দিছো একটাও আমি খাইছি না। ওরা সব নিয়ে গেছে। কোনো কিছু খাইতে দেয়নি। অনেক নির্যাতন করেছে আমারে। রাইত (রাত) একটায় তার মামারে লিখছে মামা আমি বোটে (নৌকায়)। আর কোনো যোগাযোগ নাই। আমার পোয়ার (ছেলের) কুনু (কোনো) খবর নাই। অনেকে অনেক রকম খবর আনিয়া দিরা। আমি শান্তি পাইরাম না।’

ফাহাদের বাড়ি মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের গাজিটেকা পূর্বের চক এলাকায়। ফাহাদ আহমদের বাবা আব্দুল আহাদ দুবাই প্রবাসী। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে ফাহাদ ছিলেন সবার বড়। কলেজে পড়তেন, প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন।

লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে তিউনিসিয়া উপকূলে ভূমধ্যসাগরে অভিবাসীবাহী নৌকাডুবিতে যে কজন মারা গেছেন, তাদের মধ্যে ফাহাদ আহমদও একজন। গত সোমবার (১৪ মে) রেড ক্রিসেন্ট প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে মৌলভীবাজারের যে দুজনের নাম দিয়েছে, তাদের একজন শামীম ও অপরজন ফাহাদ। এরপরই পরিবারের সদস্যরা জেনেছেন ফাহাদ নৌকাডুবিতে মারা গেছেন। তবে মারা গেছেন কি না পরিবার এখনো নিশ্চিত করতে পারেননি।

ছেলেরে চিন্তায় বার বার অজ্ঞান হয়ে মা আয়েশা অসুস্থ হয়ে গেছেন। স্বামী বিদেশে। এই অবস্থায় তাঁর বাবার বাড়ির লোকজন তাকে নিয়ে গেছেন নিজেদের বাড়িতে। বাবার বাড়ি উপজেলার নিজবাহাদুরপুর ইউনিয়নের গল্লাসাংগন (নিশ্চিন্তপুর) গ্রামে বুধবার সকাল সাড়ে ১০টায় গিয়ে দেখা গেছে, স্বজনেরা আহাজারি করছেন। আত্মীয়স্বজন ও আশপাশের লোকজন পরিবারের সদস্যদের সান্তনা দিতে আসছেন। ওই বাড়িতে কথা হয়, ফাহাদ আহমদের মা আয়েশা আক্তার ও এক মামা সাব্বির আহমদের সাথে।

তাঁরা জানান, বড়লেখা উপজেলার উত্তর শাহবাজপুর ইউনিয়নের বোয়ালি এলাকার তাদের পরিচিত নাসির উদ্দিন নামে এক ব্যক্তি ইতালির পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। তারা চাইছিলেন না সাগর পাড়ি দিয়ে তাদের ছেলে ইতালি যাবে। কিন্তু নাসির উদ্দিন কিভাবে ফাহাদকে রাজী করিয়ে ফেলেন। নাসির বলেছিলেন, কোনো সমস্যা হবে না। ওকে জাহাজে পাঠানো হবে। এতে ভয়ের কিছু নেই। ফাহাদ অনেকটা জোর করেই মাকে বাধ্য করে। তখন আট লাখ টাকায় চুক্তি হয়। মায়ের কাছে নগদ দুই লাখ টাকা ছিল। বাকিটা অনেকের কাছ থেকে ধার দেনা করে জোগার করেন।

২০১৭ সালের ৩ নভেম্বর ফাহাদ ইতালির উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। দুবাই, তুর্কি হয়ে লিবিয়ায় পৌঁছান। লিবিয়াতে পৌঁছার পর তিন মাস পরে একবার সাগরপথে ইতালির উদ্দেশে পাঠানো হয়েছিল। সেবার ধরা পড়ে যায়। এরপর লিবিয়াতেই ছিলেন এতদিন। ধরা খাওয়ার পর তাঁকে দেশে ফেরত আনার জন্য নাসির উদ্দিনকে চাপ দেওয়া হয়। নাসির উদ্দিন তাঁকে ছাড়িয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। এরপর কিছুদিন পরপরই ভিডিও কলে ফাহাদের দিকে বন্দুক ধরে আত্মীয়স্বজনের কাছে টাকা চাওয়া হয়। সন্তানের মায়ায় মা আয়েশা আক্তার প্রতিবেশীর কাছে বাড়ি বন্ধক দেন। একে একে ১৮ লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন। টাকা নেওয়ার পরও এতদিন ছেলের ওপর নির্যাতন চলেছে। খাবারের টাকা দিয়েছি। কিন্তু ওরা খাবার দেয়নি। অল্প খাবার দিত। গোসলের জন্য পানি দিত না। দুই তিনদিন পর পর পানি দিত। গোসলের জন্য তা পর্যাপ্ত ছিল না।

ফাহাদের মা আয়েশা আক্তার বলেন, ‘আমি কিতা করতাম (কি করবো)। আমি চাইছলাম না (চাইনি) পোয়ারে (ছেলেকে) পাঠাইতে। নৌকা ডুবি যায়। পোয়ারে এমনভাবে উসকাইছে নাসিরে। পোয়া পাও ধরি কইছে কাঠের শিপে নিব, কিচ্ছু অইতো (হবে) নায়। রাজি অই যাও। অখন আমার বাইচ্চা আছে কিনা কুনতা জানি না। জামাইও বেমার (স্বামী অসুস্থ)। তিনটা বাইচ্চা নিয়া বাড়ি ছাড়িয়া রোডও। না খাইলাম পানি, না খাইলাম দানা। অনাহারে জীবন কাটাইরাম (কাটাচ্ছি)। অন্যের কাছে বাড়ি বন্ধক দিয়া টাকা নিছি। মনে করছি ছেলে ইটালি পৌঁছালে আমাদের দিন ফিরতে পারে। বন্ধকের টাকা দিয়ে বাড়ি ফেরাতে পারব। এখন সব শেষ আমার।’

ফাহাদের মামা সাব্বির আহমদ বলেন, ‘আমার ভাগনা খুব সরল সোজা। তারে খুব বেশি উসকানি দিত নাসির। ১০ দিনের মধ্যে ইটালি পৌছে দিব। এমনটা বলেছে। প্রথমে আট লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। পরে কয়েকবার বন্দুক ধরে ভিডিও কল করে বলে, টাকা পাঠাও। ধারদেনা আর বাড়ি বন্ধক দিয়ে ১৮ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। আমরা বিভিন্ন টেলিভিশনে নিউজ দেখছি। কিন্তু এখনো নিশ্চিত হতে পারছি না। এখন ছেলেও গেল। বাড়িও গেল।’

এই ঘটনার সঙ্গে বারবার নাসির উদ্দিনের নাম চলে আসায় তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু মুঠোফোন বন্ধ থাকায় তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

বড়লেখা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শামীম আল ইমরান বলেন, ‘ফাহাদ নামে একজনের মারা যাওয়ার খবর পেয়েছি। আমরা পরিবারের খোঁজ নিয়েছি। তাঁর বাড়িতে যাব।’

আপনার মন্তব্য

আলোচিত