হৃদয় দাশ শুভ, শ্রীমঙ্গল

২০ মে, ২০১৯ ০০:৩৩

একবেলা খেতে পাই না, আমাদের আবার কিসের দিবস?

আজ চা শ্রমিক দিবস

চা শ্রমিক দিবস আজ৷ আজ থেকে ৯৮ বছর আগে, ১৯২১ সালের ২০ মে ‘মুল্লক চলো’ আওয়াজ তুলে প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক চাঁদপুরে পৌঁছেছিলেন স্টিমারে নিজ নিজ এলাকায় ফিরে যাওয়ার জন্য। সেখানে বাধা দেয় মালিকপক্ষ। বাগানমালিকদের স্বার্থক্ষাকারী ব্রিটিশ সরকারের গোর্খা সৈন্যরা গুলি করে হত্যা করে শত শত মেহনতি মানুষকে। তাঁদের লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয় মেঘনা নদীতে।

ব্রিটিশ শাসনামলে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সিলেট অঞ্চলে চা উৎপাদন শুরু করে ব্রিটিশ মালিকেরা। উন্নত জীবনের লোভ দেখিয়ে উপমহাদেশের দারিদ্র্যপীড়িত বিভিন্ন এলাকা থেকে গরিব মানুষদের এনে চা-বাগানের কাজে লাগিয়েছিল বাগানমালিকেরা। নামমাত্র মজুরিতে অমানুষিক পরিশ্রম করতে বাধ্য করা হতো ওই অসহায় শ্রমিকদের। দিনের পর দিন অবর্ণনীয় শোষণ-নির্যাতন ও মানবেতর জীবনযাপনে অতিষ্ঠ হয়ে একসময় শ্রমিকেরা কাজ ছেড়ে নিজেদের এলাকায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

সেই দিবসের ৯৮ বছর পর কেমন আছেন চা শ্রমিকরা? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে শ্রীমঙ্গল ভাড়াউড়া চা বাগানের মধ্য লাইনে গিয়ে একটি ভাঙাচোরা কাঁচা মাটির ঘরে শোয়া অবস্থায় পাওয়া গেল বৃদ্ধা উমা বাউড়িকে। সেখানে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি জানান, চা শ্রমিক দিবস আবার কি? দিনে একবেলা খেতেই পাই না, আর আমাদের আবার দিবস? গত কয়েকদিন ধরে আমি অসুস্থ কিন্তু বাগানের মধ্যে যে হাসপাতাল রয়েছে তা সাইনবোর্ড সর্বস্ব। ডাক্তার-ওষুুধ কোনোটাই পাওয়া যায় না। অধিকাংশ সময় হাসপাতাল তালাবদ্ধ থাকে। ডাক্তার, নার্স ও কর্মচারী কাউকে সার্বক্ষণিক নিয়োগ দেওয়া হয় না বলেও অভিযোগ করেন চা শ্রমিকরা। বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়াকে তাঁরা নিয়তি হিসেবে মেনে নেন।

কয়েকটি চা বাগানে শ্রমিকদের বাসস্থানে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে মানবেতর জীবন যাপন করছেন তাঁরা। চুক্তি কিংবা খাতাপত্রে শ্রমিকদের সুস্বাস্থ্যের প্রথম শর্ত হিসেবে একটি পরিকল্পিত বাসস্থান নির্মাণের কথা থাকলেও বাস্তবে এর কোনো নজির পাওয়া যায় না। ছন ও বাঁশ দিয়ে তৈরি ছোট ছোট ঘরে গাদাগাদি করে থাকতে হয় শ্রমিক এবং তাঁদের পরিবারকে। ঝড়-বৃষ্টিতে ঘরে বসে থেকেও তাঁদের ভিজতে হয়। টিনের চাল দিলে আর এ অসুবিধা হতো না।

সুনীল রিকিয়াশন নামের এক শ্রমিক জানান, স্ত্রী লছমী রিকিয়াশনসহ তাঁর পরিবারের সদস্য নয়জন। অথচ চা বাগান মালিকপক্ষ থেকে যে ঘর তুলে দেওয়া হয়েছে সেখানে দুই থেকে তিনজন বসবাস করতে পারেন। বাকিরা ঘরের দাওয়া বা উঠানে ঘুমান, বষ্টি বাদলা হলে তখন এক ঘরে গাদাগাদি করে সবাইকে ঘুমাতে হয়৷

শুধু বাসস্থানই নয়, চা বাগানে শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট, বিশুদ্ধ পানি এবং ড্রেনেজ ব্যবস্থা খুবই অপ্রতুল। ফলে তাঁদের পরিবারের অধিকাংশ সদস্য নানা রোগে ভোগেন।

বালিশিরা বাগান ভ্যালির সভাপতি বিজয় হাজরা সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, বিভিন্ন দিবস আসলে সবাই আমাদের খোঁজ নেয়, বক্তৃতা বিবৃতি দেয় কিন্তু আমাদের যে দাবি সেগুলো নিয়ে কেউ ভাবে না৷ আমাদের মূল দাবি হলো আমাদের ভূমির অধিকার, আমাদের শ্রমিকদের বাগান কর্তৃপক্ষ চাইলেই ভূমি থেকে উচ্ছেদ করতে পারে৷ চাকরি না থাকলে ভুমিও থাকবে না, এরকম অমানবিক নিয়মের মধ্যেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি৷ আসলে প্রশাসন ও বাগান মালিকদের কাছে চা শ্রমিকরা মানুষ কি না সেটা স্পষ্ট হওয়া উচিত। তা না হলে শ্রমিকদের সঙ্গে পশুর মতো আচরণ করা হতো না।

তিনি জানান, আইন অনুযায়ী বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য প্রতিটি পরিবারে একটি টিউবওয়েল বসানোর কথা। অথচ পানি সংগ্রহ করতে গিয়ে ঢাকা শহরের মতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। অনেক সময় পানির অভাবে গোসল করা যায় না। টয়লেট ব্যবহার না করেই কাজে চলে যেতে হয়। কয়েকটি চা বাগানে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, এক কলসি বিশুদ্ধ পানির জন্য তাঁদের সকাল ৬টায় ঘুম থেকে উঠে লাইনে দাঁড়াতে হয়।

এখনো কল্পনাতীত কম মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন চা শ্রমিকেরা। মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা। নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এখনো লড়ছেন এ মানুষগুলো। ২০ মেকে ‘চা শ্রমিক দিবস’ ঘোষণা করা, দৈনিক মজুরি বাড়ানোসহ বিভিন্ন দাবিতে চা শ্রমিকদের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রাম চলছে।

চা গাছ ছেঁটে ছেঁটে ২৬ ইঞ্চির বেশি বাড়তে দেয়া হয় না। চা শ্রমিকের জীবনটাও ছেঁটে দেয়া চা গাছের মতোই, লেবার লাইনের ২২২ বর্গফুটের একটা কুঁড়ে ঘরে বন্দি। মধ্যযুগের ভূমিদাসের মতোই চা মালিকের বাগানের সঙ্গে বাধা তার নিয়তি। চা শিল্প বাংলাদেশের অন্যতম একটি বৃহৎ শিল্প। জাতীয় অর্থনীতিতে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।

শ্রীমঙ্গলসহ দেশের প্রায় ১৬৫টি চা বাগানের শ্রমিকরা মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। প্রায় ২০০ বছর ধরে মৌলভীবাজারের ৯২টি চা বাগানে বংশ পরম্পরায় কাজ করছেন চা শ্রমিকরা। তাদের শ্রমে এই শিল্পের উন্নয়ন হলেও শ্রমিকদের ভাগ্যের পরিবর্তন হচ্ছে না। দৈনিক একজন শ্রমিকের মজুরি ১০২ টাকা। আর সেই সঙ্গে সপ্তাহ শেষে তিন কেজি খাওয়ার অনুপযোগী আটা।

মৌলিক চাহিদা পূরণে দীর্ঘদিন ধরে মজুরি বৃদ্ধি, ভূমি অধিকার, বাসস্থান ও চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নসহ বিভিন্ন দাবি তাদের। কিন্তু বাস্তবায়ন না হওয়ায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন চা শ্রমিক পরিবারের সদস্যরা। চা বাগানের শ্রমিকরা তাদের শ্রম দিয়ে চা বাগান আগলে রাখলেও তাদের শিক্ষা ও চিকিৎসা এখন সেই অবহেলিত রয়ে গেছে। দীর্ঘদিন ধরেই ভূমির অধিকার নিয়ে আন্দোলন করে আসছেন চা শ্রমিকরা।

চা শ্রমিকরা জানান, বাগানের হাসপাতালে ভালো চিকিৎসার যথেষ্ঠ অভাব রয়েছে। বাগানে যে কয়েকটা ছোট হাসপাতাল রয়েছে তাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ওষুধ ও ডাক্তার না থাকায় সেবা মিলছে না।  তাছাড়া বাগানের কিছু কিছু ছেলে-মেয়েরা উচ্চ শিক্ষা অর্জন করলেও চাকরির ক্ষেত্রে বড় কোনো পদ পাচ্ছে না।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের উপদেষ্টা পরাগ বাঁড়ই বলেন, চা শ্রমিকরা সেই ব্রিটিশ আমল থেকে এ দেশে বাস করছে। তারা ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযোদ্ধে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিল। সেই চা শ্রমিকরা আজও অবহেলিত। বর্তমান শ্রমিক বান্ধব সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে শ্রমিকদের পক্ষ থেকে দাবি জানাচ্ছি- এই অবহেলিত চা শ্রমিকদের বাসস্থানের জায়গাটুকু যাতে তাদের নিজের নামে করে দেয়া হয়। যাতে বাগান কর্তৃপক্ষ তাদের যখন তখন ভূমি থেকে উচ্ছেদ করতে না পারে।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রাম ভজন কৈরী জানান, চা শ্রমিকদের ২০ দফা দাবি মালিকপক্ষকে লিখিত দেয়ার পর কয়েক দফা দ্বি-পক্ষীয় আলোচনা হয়েছে। তবে মালিকপক্ষ কালক্ষেপণ করছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত