রিপন দে, মৌলভীবাজার

২১ মে, ২০১৯ ১১:২৩

সাইকেল রাইডে আত্মবিশ্বাসী হচ্ছেন মৌলভীবাজারের নারীরা

রেশমি চুড়ি, আলতা, একটা টিপ আর পরিপাটি সাজগোজ। কদিন আগে এটাই ছিল পরিবারের কাছে অধিকাংশ মেয়েদের বায়না। দিনে দিনে সেটা পৌঁছল স্মার্টফোনে আর এখন মৌলভীবাজারের অনেক মেয়ের পরিবারের কাছে বায়না একটি বাইসাইকেল।

মেয়ের আগ্রহের কারণে পরিবারও কিনে দিচ্ছেন সেই বাইসাইকেল। দিনে দিনে মৌলভীবাজারে মেয়েদের কাছে জনপ্রিয় হচ্ছে সাইকেল রাইড। জেলা শহরসহ বিভিন্ন উপজেলায় মেয়েদের সাইকেল চালাতে দেখা যায় প্রতিদিন। যা নারীকে সুস্থতার সাথে আত্মবিশ্বাসী করে তুলছে।

মৌলভীবাজার জেলার বিভিন্ন এলাকা ভিত্তিক অন্তত ১৩টি বৃহৎ সাইক্লিং গ্রুপ আছে এবং এই গ্রুপ ছাড়াও অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে সাইকেল রাইডের সাথে যুক্ত হচ্ছেন। দিনে দিনে ছেলেদের সাথে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তরুণ প্রজন্মের মেয়েরা।

কয়েক বছর আগেও নারীদের অনেক সামাজিক বাধার মুখে পড়তে হতো। পরিবার থেকে চাপ থাকতো এমন কি নিরাপত্তা নিয়ে অনেকেই শঙ্কিত ছিলেন। কিন্তু এ প্রজন্মের দুরন্ত নারীরা সে ভয়কে জয় করেছে। সাইক্লিংয়ের মাধ্যমে ছেলে বন্ধুদের পাশাপাশি যখন ঘরের বাইরে নিজেকে আবিষ্কার করছে নিজের আত্মবিশ্বাস ফিরে পাচ্ছে। সমঅধিকার কাগজে নয়, বাস্তবে সে উপলব্ধি করছে।

তেমনই এক নারী সাইকেল রাইডার মৌলভীবাজারের পৌর শহরের অনুরাধা রায় অর্পা। তিনি জানান, আমার বড় ভাইকে প্রতিদিন সাইকেল নিয়ে রাইডে যেতে দেখতাম। তা দেখে আমার খুব আফসোস হত। একদিন বড় ভাইকে বললাম আমি তার সাথে রাইডে যাব। সেও রাজি হল সেই থেকে শুরু প্রতিদিন ভোরে ভাইয়ের সাথে সাইকেল চলানো শিখতে বের হতাম। শেখার পর প্রথম প্রথম ভাইয়ের সাথে রাইডে যেতাম এখন আমরা মেয়েরা মিলে বা কখনো একা একা রাইডে যাই। এতে শারীরিক এবং মানসিকভাবে যেমন উপকৃত হচ্ছি তেমনি বাইরের জগতকে জানতে পারছি।

শখের এই রাইডারদের বাইরেও প্রায় ৬ শত নারী সাইকেল চালাচ্ছেন মৌলভীবাজারের কুলাউড়া এবং কমলগঞ্জ উপজেলায়। এই দুই উপজেলার পাহাড়ি প্রত্যন্ত এলাকার ছাত্রীরা ৩-৪ কি.মি. দূর থেকে নিয়মিত স্কুলে আসতে পারতো না। প্রচুর হাটতে হতো। তার উপর আসা যাওয়ার পথে বখাটেদের ভয় ছিল। কিন্তু সরকারি উদ্যোগে সাইকেল পেয়ে প্রত্যন্ত এলাকার এসব ছাত্রীদের মুখে এখন আত্মবিশ্বাসের ছাপ। আর তাদের দেখে উৎসাহিত হচ্ছে অন্য ছাত্রীরাও।

এই উদ্যোগ নারী শিক্ষার অগ্রগতি ও নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্র প্রসারিত করবে বলে ধারণা সচেতন মহলের। শুধু কমলগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন হাই স্কুলে এখন পর্যন্ত ৫০০ জন ছাত্রীকে বাইসাইকেল দেয়া হয়েছে। উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে এই প্রকল্প চলমান রয়েছে। উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে দরিদ্র ছাত্রীরা পাচ্ছে বাইসাইকেল। এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন কমলগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন।

আর সেই সব মেয়েদের সাইকেলে চড়ে বিদ্যালয়ে যাওয়ার দৃশ্যে শহর এলাকায় বসবাস করা মেয়েদেরও সাইক্লিং করার দুর্নিবার ইচ্ছা পেয়ে বসে। শুধু হাতে থাকা স্মার্টফোন ব্যবহারেই পড়ে থাকা নয়, দৈহিক ও মানসিকভাবে ফিট থাকার জন্যই অনেকে সাইক্লিংয়ে বের হয়।

শুধু সাইক্লিং নয়, নিজের প্রয়োজনীয় কাজটুকু সারতেও মেয়েরা সাইকেল চড়ে যাতায়াত করে। উপজেলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশী নারী রাইডার শ্রীমঙ্গল শহরে। ইদানীং প্রায়শই দেখা যায় ট্রাফিক জ্যামের মধ্যে দিয়েই সবাইকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছেন নারী রাইডার।

তবে শুধু সাইকেলই নয়, আরেকটু বড় হয়ে স্কুটার বাইক চালানোরও ইচ্ছে তাদের মধ্যে কারো কারো। নারী রাইডাররা বলছেন, মূলত পরিবারের সহযোগিতা থাকায় আজ প্রায় শতাধিক নারী সাইকেল চড়ে ঘুরতে পারছেন।

জানা যায়, মায়েরা সবসময়ই মেয়েদের একটু অন্যরকম ইচ্ছার প্রতি সমর্থন দিলেও বাবারা একটু উদ্বিগ্ন থাকেন। তবে কেউই সন্তানের বায়নাকে কোন শঙ্কা বা অজুহাত দেখিয়ে ফিরিয়ে দিলেও অনেক বাবা আবার নিজ থেকেই সন্তানকে উৎসাহ দিচ্ছেন ।

শ্রীমঙ্গলের রাইডার কলেজ শিক্ষার্থী শাহিনুর ইসলাম কিরণ জানান, সাইকেল চালানোর উৎসাহ প্রথমে আমার বাবাই আমাকে দিয়েছেন। ছোটবেলায় আমার বাবা আমাকে সাইকেল কিনে দিয়েছেন। সাইকেল চালানো উনি আমাকে শিখিয়েছেন। কখনো উনি বলেন নাই যে তুমি মেয়ে, তুমি সাইকেল চালাতে পারবে না। আমার পরিবার সব সময় আমার সাইকেল চালানোর ব্যাপারে সহযোগিতা করেছেন এবং এখনো করেন। এর জন্য আমি ধন্যবাদ জানাই সিওএসকে যারা মেয়েদের জন্য একটা প্লাটফর্ম তৈরি করে দিয়েছে।

অন্যদিকে পরিবার থেকে প্রথমে সমর্থনা না পাওয়া কলেজ শিক্ষার্থী প্রিমিন্দিতা বৈদ্য ঐশি জানান, আমার ছোটবেলা থেকে সাইক্লিং করার ইচ্ছে ছিলো কিন্ত আমি পরিবার থেকে কোন সহযোগিতা পাইনি। অনেক ছোটবেলায় আমার ছোট ভাই আমাকে সাইক্লিং করা শিখায়। তারপর আমি একাদশ প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়ার পর আমি সাইক্লিং আসি। এখানে আসার পথে আমি আমার পরিবার থেকে কোন সহযোগিতা পাইনি। আমি নিজে থেকে আসছি, তারপর এখানে এসে আমি গ্রুপে যাদেরকে পেয়েছি তারা আমাকে সহযোগিতা করছে। আমি ওদেরকে অনেক ধন্যবাদ দেই আমি আজকে তাদের জন্য এখন স্বাধীনভাবে ঘুরতে পারছি।

তবে নারীদের রাইডের ব্যাপারে ফেসবুক ভিত্তিক সাইক্লিস্ট গ্রুপ থেকেই মূলত উৎসাহ পাচ্ছেন নারীরা।

এ ব্যাপারে মৌলভীবাজার সাইক্লিং কমিউনিটি (এমসিসি) এর এডমিন শুভ রায় জানান, সুস্বাস্থ্য এবং মানসিক বিকাশের জন্য ব্যস্ত এই নগর জীবনে সাইক্লিং অন্যতম মাধ্যম। শারীরিক ব্যায়ামের সাথে মেয়েরা আত্মবিশ্বাসী হচ্ছে। একটা মেয়ে যখন তার ছেলে বন্ধুর সাথে সমান তালে সাইক্লিং করছে তখন নারী পুরুষের যে সমঅধিকার তা উপলব্ধি করতে পারছে। সে বাইরের জগত থেকে বাস্তবতার নিরিখে অনেক কিছু শিখতে পারছে।

নারী-পুরুষের লিঙ্গ বৈষম্য নিয়ে জাতিসংঘের একটি প্রকল্পে কাজ করছেন ইফফাত নিপা। তিনি বলেন, এক সময় নারীদের পৃথিবী বলতে ঘরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। ফলে সে বাইরের জগৎ সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলো। কিন্তু এখন নারীরা ঘর থেকে বের হচ্ছে। বাইরের জগৎ দেখছে, জানছে এবং বুঝতে পারছে। ফলে তার মনোজগতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। মেয়েরা সাইক্লিং করছে। সত্যিই এটি খুব ভালো একটা দিক। আত্মবিশ্বাসী নারী নিজের ভেতরে থাকা প্রতিভাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।

সাইক্লিং মন এবং শরীরের জন্য উপকারী জানিয়ে মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যা হাসপাতালের চিকিৎসক ড. মো. আবু ইমরান জানান, সাইক্লিং ভাল লাগা বাড়ায়। বিষণ্ণতা কমায়, আত্মবিশ্বাস, কর্মোদ্দীপনা বাড়ায়, ওজন কমাতে সহায়তা করে, হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। সাইক্লিং করলে ঘুমের সমস্যা দূর হয়, মস্তিষ্কের ক্ষমতা বুস্ট আপ হয়, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।

তিনি আরও বলেন, সাইক্লিং গ্রুপের সাথে সংযুক্ত থাকার কারণে সামাজিক যোগাযোগ বাড়ে। একে অপরের প্রতি সহমর্মিতা ও সহযোগিতামূলক মনোভাব গড়ে ওঠে যা উন্নত সমাজ গঠনের জন্য খুবই দরকারি।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত