সজল ছত্রী

১১ জুলাই, ২০১৯ ১৭:৩৮

রাক্ষুসে ধলাই বুঝে না চোখের জল

তিন বোনোর সাথে আবীর। ছবিটি পারিবারিক এ্যালবাম থেকে নেওয়া

সন্তানের আপদ নাকি আগেই টের পায় মা। রোববার সকালে কী ছিল আবীরের মায়ের মনে? রাতেই জানতেন, ছেলে সকালে বন্ধুদের সাথে যাবে ভোলাগঞ্জ বেড়াতে। তবু কেন যেন সকালে ছেলেকে তৈরি হতে দেখে বাধা দিলেন।

‘আজকে আর যাস না। শুক্রবারই তো গিয়ে এলি!’ ঠিক আগের শুক্রবারই ভোলাগঞ্জের সাদাপাথর এলাকা ঘুরে এসেছিলেন আবীর। মায়ের বার বার বাধায় আবীরের মনেও কিছু হয়েছিল কিনা তা আর জানা গেল না। নিজের হাতে চা বানিয়ে মাকে খাইয়ে মায়ের বিব্রত চোখের সামনেই সকাল নয়টায় বেরিয়ে যান ঘর থেকে। আর ফেরেননি। তিনদিন পর ফিরেছে নিথর দেহে।

ভোলাগঞ্জের অপরূপ সাদাপাথরে বেড়াতে গিয়ে পা পিছলে যায় আবীরের। তার পর চোখের নিমিষে স্রোতের টানে তলিয়ে যান। প্রবল স্রোতের কারণে অনেক চেষ্টায়ও ডুবুরিরা কিছু করতে পারেনি। তিনদিন পর মঙ্গলবার সন্ধায় ভেসে ওঠে হাসানুর রহমান আবীরের মরদেহ।

আবীরের মৃত্যুতে একটি পরিবারের সব রঙই যেন মুছে গেছে। তার নিখোঁজের খবর পেয়েই দেশের উদ্দেশ্যে উড়াল দেয় বড় বোন নীলা। কিন্তু যুক্তরাজ্য থেকে যেদিন দেশে এসে পৌঁছান সে দিনই নদীতে ভেসে ওঠে আবীরের লাশ। প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা যে ছোট ভাইটিকে রেখে যুক্তরাজ্যে গিয়েছিলেন আরেক বোন নিশা। পাসপোর্ট জটিলতায় তিনি ফিরতে না পেরে সাতসমুদ্রের পারে বসেই চোখের জলে ভাসছেন তিনি। আরেক বোন লিজার চোখের জলও বাঁধ মানছে না। রাক্ষুসে ধলাইয়ের কাছে হয়ত এই চোখের জলের কোনো মূল্যই নেই! গত এক সপ্তাহে তাই একে একে কেড়ে নিয়েছে ৪ প্রাণ।

সিলেট শহরের খাসদবীর সৈয়দ মুগনী এলাকার তরঙ্গ ৪/১০ বাসায় বাবা-মার সাথে থাকতেন আবীর। সে বাড়িতে গিয়ে কথা বলার মতো কাউকে পাওয়া গেল না। সবার চোখেই এমন শূন্যতা যে তার সামনে দাঁড়ানো যায় না।

একটু পর কথা হল আবীরের খালু সোয়েব আহমদ এবং চাচাতো ভাই হাবিবুর রহমান সোহানের সাথে। তারা জানান, ছেলেকে হারিয়ে বাকশূন্য হয়ে পড়েছেন তার বাবা-মা। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা আব্দুল মতিন ও গৃহিনী মমতাজ বেগমের একমাত্র পুত্রসন্তান ছিল আবীর। জন্ম থেকেই পুরো পরিবারের রঙ ছড়িয়ে রাখতো সে। তিন মেয়ের পর একমাত্র ছেলে হিসেবে মা-বাবার কাছে যতটুকু যক্ষের ধন ছিলেন তার চেয়েও বেশি নিজের বিনয়-ব্যবহার দিয়ে জয় করে নিয়েছিলেন বন্ধু-বান্ধব আর আত্মীয়-অনাত্মীয়ের মন। একে একে তিন বোনের বিয়ে হয়ে গেলে বৃদ্ধ বাবা-মাকে দেখাশোনার দায়িত্বও সামলে নিচ্ছিলেন সিলেটের লিডিং ইউনিভার্সিটিতে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া আবীর। কিন্তু সব রঙই মুছে দিয়ে গেল রাক্ষুসে ধলাই।

মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে স্থানীয় এক মাঝি সাদাপাথর থেকে পর্যটক নিয়ে ফেরার পথে ধলাই নদীর ব্যাংকার এলাকায় একটি লাশ ভাসতে দেখে খবর দেন পুলিশে। লাশ উদ্ধার করে সুরতহাল শেষে রাত ১০টার দিকে স্বজনদের কাছে হন্তরান্তর করে পুলিশ। বুধবার সকালে তাকে হযরত শাহজালাল র. দরগাহ কবরস্থানে দাফন করা হয়।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত