হৃদয় দাশ শুভ, শ্রীমঙ্গল

১৪ জুলাই, ২০১৯ ০০:৩৯

টুরিস্ট ভিসায় এসে দুই বিদেশির বন্যপ্রাণি নিয়ে গবেষণা, নেপথ্যে বাংলাদেশি গবেষক

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান

ভ্রমণ (ট্যুরিস্ট) ভিসায় বাংলাদেশে এসে বন্যপ্রাণী নিয়ে গবেষণা করছেন দুই বিদেশি নাগরিক। এর নেপথ্যে বাংলাদেশি এক তরুণ গবেষক সম্পৃক্ত রয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠেছে।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, গত ঈদে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার লাউয়াছড়া উদ্যানে পর্যটক হিসেবে ঘুরতে আসা দুই মার্কিন গবেষক স্কট ট্রাগেসার ও এলেক্স উইলস। লাউয়াছড়া বনে এসে তারা বনরুইয়ের নমুনা সংগ্রহ করেন। এই কাজে তাদেরকে সহযোগিতা করেছেন বেসরকারি সংগঠন ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্সের কর্মকর্তা সিজার।

অভিযোগ আছে, লাউয়াছড়া থেকে বন্যপ্রাণীর নমুনা সংগ্রহ করে তা নিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ব্র্যাকের ল্যাবে যান এবং জিন সংগ্রহের চেষ্টা করেন।

ব্র্যাকের বায়োলজি ল্যাব সূত্রে জানা যায়, সালমান নামের সেখানকার এক সাবেক কর্মচারির মাধ্যমে ল্যাবে যান স্কট ও এলেক্স। তারা দেশের বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী রক্ষায় কাজ করেন দাবি করে বনরুইয়ের জিন নিয়ে ব্র্যাকের ল্যাবে গবেষণা করতে চান। তবে ল্যাব খালি না থাকা ও পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি না থাকায় সেসময় তারা কাজ করতে পারেননি বলে জানিয়েছেন ল্যাব সহকারী আসমা আফজাল।

এ সময় কাজের সুযোগ দেয়ার বিনিময়ে ব্র্যাক ল্যাবকে যন্ত্রপাতি কিনে দেয়ার আশ্বাসও দেন স্কট। তবে ব্র্যাক সরকারি অনুমতিপত্র চাইলে পরবর্তীতে কাগজপত্রসহ আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন করবেন বলে চলে যান তারা।

এই দুই মার্কিন গবেষক পরবর্তীতে আরও তথ্য সংগ্রহ করতে শ্রীমঙ্গলের বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনে যান। কিন্তু সেবা ফাউন্ডেশন তাদেরকে সহযোগিতা করেনি জানিয়ে বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনের পরিচালক সজল দেব বলেন, কয়েকজন এসেছিল। তাদের সঙ্গে দুইজন বিদেশিও ছিল। তারা বনরুই হাতে নিয়ে দেখতে চাইলে আমরা তাদের হাতে দেইনি। এমনকি খাঁচা থেকেই বের করিনি।

এদিকে ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্সের দাবি, সংগঠনের অগোচরে এসব করছেন সিজার। সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা আসিফ ইবনে ইউসুফ বলেন, সিজার গত তিন মাসে সিসিএ’র নাম ব্যবহার করে যে কাজগুলো করছেন সেগুলো নিজের উদ্যোগে করছেন। গত ৩ মাস যাবত ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্সের (সিসিএ) সঙ্গে যুক্ত না হয়েও বিভিন্ন জায়গায় নিজেকে সিসিএর কর্মকর্তা পরিচয় দিচ্ছেন, সিসিএর হয়ে মিটিং করছেন, ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছেন, ভাওয়াল যাচ্ছেন, প্রোজেক্ট চালাচ্ছেন।

বনবিভাগের সুত্রে জানা গেছে, মার্কিন নাগরিক স্কট বাংলাদেশের বনরুই নিয়ে বিদেশি একটি প্রকল্পে কাজ করার জন্য বনবিভাগের কাছে অনুমতি চাইলেও বনবিভাগ অনুমতি দেয়নি। এরপর তিনি সিজারকে সাথে নিয়ে এবং তার সহযোগিতায় ট্যুরিস্ট ভিসায় এসে কাজ শুরু করেন।

সিজার বর্তমানে অনুমোদন নিয়ে বনরুইয়ের একটি প্রকল্পে কাজ করলেও গত ২৬ জুনের আগে তার কোনো অনুমোদন বন বিভাগ থেকে ছিল না। অনুমোদন না পেয়েও তিনি নিজে বিভিন্ন বনে বিদেশিদের নিয়ে যান এবং বনরুইয়ের নমুনা সংগ্রহ করেন। যেটা বন আইনে সম্পূর্ণ অবৈধ।

এই খবর জানাজানি হলে গেলে গত ২৬ জুন তড়িঘড়ি করে শাহরিয়ার সিজারকে অনুমতি দেয় বন বিভাগ।

তবে প্রভাবশালীর চাপে তাদের অনুমতি দেয়া হয়েছে বলে গনমাধ্যমকে জানিয়েছেন বন অধিদফতরের বন সংরক্ষক (অর্থ ও প্রশাসন) জাহিদুল কবির। তিনি জানান, আমরা অনুমতি দিয়েছি গত ৪/৫ দিন আগে। সরকার দলীয় এক প্রভাবশালী এমপির সুপারিশ তাকে এই অনুমতি দেয়া হয়েছে।

কিন্তু এ অনুমোদন নিয়মবহির্ভূত দাবি করেন বন অধিদফতরের বন্যপ্রাণী গবেষণা কমিটির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক মোস্তফা ফিরোজ। তিনি জানান, বন্যপ্রাণী সংরক্ষন কমিটি যদি সিদ্ধান্ত দেয় তাহলে আমাদের প্রধান বন সংরক্ষক অনুমোদন দিতে পারেন। এছাড়া অন্য কেউ দিতে পারবে না।

এ দিকে এই খবর গন্যমাধ্যমে আসার পর থেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে সিলেটের বিভিন্ন সংঘঠন । শুক্রবারে (১২ জুলাই) মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ফটকে নাগরিকবন্ধন করে “সংক্ষুব্দ নাগরিক আন্দোলন সিলেট”  ঘন্টাব্যাপী এই মানবন্ধনে বক্তারা বলেন, সম্প্রতি দেশীয় গবেষক শাহরিয়ার সিজারের সঙ্গে দুজন মার্কিন গবেষক পর্যটক হিসেবে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে প্রবেশ করেন। তাঁরা অবৈধভাবে উদ্যান থেকে নানা জাতের সাপের ডিম সংগ্রহ করেন। অথচ গবেষণার কাজে আসতে হলে বিদেশিদের প্রয়োজনীয় সরকারি অনুমতি নিতে হয়। তাঁরা সরকারি অনুমতির তোয়াক্কা না করেই জাতীয় উদ্যানে ঘুরে এ বনের জীববৈচিত্র্য সংগ্রহ করেছেন। তাঁদের এ ধরনের কাজে লাউয়াছড়া বনে বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে। শাহরিয়ার সিজারসহ পর্যটকবেশে গবেষকদের এ ধরনের কাজের তদন্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান বক্তারা। বিদেশীদেরকে সহযোগীতার কারনে সিলেটের সব বনে। সিজারকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত গবেষক শাহরিয়ার সিজার গনমাধ্যমকে বলেন,  আমার সঙ্গে দুই বিদেশি পর্যটক হিসেবে লাউয়াছড়ায় এসেছিলেন। তাঁরা কোনো গবেষণা করেননি। বনের জীববৈচিত্র্য পর্যবেক্ষণ করে গেছেন।  তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সঠিক নয় বলে দাবি করেন সিজার।

বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের শ্রীমঙ্গল কার্যালয়ের সহকারী বন সংরক্ষক আনিসুর রহমান জানান, উদ্যানের ভেতরে দীর্ঘ সময় অবস্থান করে গবেষণা করতে হলে অনুমতি নিতে হয়। এ ধরনের কেউ উদ্যানে ঢুকে গবেষণা করেছেন কি না, তা তাঁর জানা নেই। তবে অভিযোগটি তিনি খতিয়ে দেখবেন।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত