রিপন দে, মৌলভীবাজার

২২ জুলাই, ২০১৯ ১৪:৩২

মৌলভীবাজারে ‘ছেলেধরা গুজবে’ ৭ জনকে গণপিটুনি, একজনকে হত্যা

'ছেলেধরা' গুজবে ভাসছে মৌলভীবাজারের প্রতিটি উপজেলা। ইতিমধ্যে এ গুজবের শিকার হয়ে প্রাণ দিতে হয়েছে এক বৃদ্ধকে। আহত হয়েছেন ৭ জন। এরই মধ্যে হেনস্তার শিকার হয়েছে অন্তত ১৩ জন। এখনই উপযুক্ত ব্যবস্থা না নিলে আরও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতে পারে।

বেশ কিছুদিন যাবত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে 'ছেলেধরা' নামে গুজব রটানো হয়। বিভিন্ন ব্যক্তিগত আইডি এবং ফেসবুক পেজ থেকে এ সব গুজব রটানো হয়েছে বলে জানা যায়।

রোববার (২১ জুলাই) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মৌলভীবাজার শহরের চাঁদনীঘাট ব্রিজের পাশে রিকশাচালক এক যুবককে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি দিয়ে গুরুতর আহত করেছে পথচারীরা। সাথে সাথে পুলিশ ঘটনাস্থলে না গেলে তার প্রাণহানি ঘটতে পারত।

এই ঘটনার খবর পেয়ে মৌলভীবাজার মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আলমগীর হোসেনের নেতৃত্বে ঘটনাস্থল থেকে আহত অবস্থায় ওই যুবককে পুলিশ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসে পুলিশ।

মৌলভীবাজার মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আলমগীর হোসেন জানান, আহত যুবক পেশায় রিকশাচালক। যুবকের নাম চন্দন পাল। সে শ্রীমঙ্গলের ভূনবীর এলাকার কালিপদ পালের ছেলে বলে জানা গেছে। শ্রীমঙ্গল শহরে সে রিকশা চালায়। মৌলভীবাজার শহরে তার পূর্বপরিচিত এক লোকের সন্ধানে স্থানীয় চাঁদনীঘাট এলাকায় খোঁজ করা অবস্থায় সন্দেহ হলে সে জনতার রোষানলে পরে গণপিটুনির শিকার হয়।

অন্য দিকে রোববার সকালে জেলার জুড়ী উপজেলার মাধবটিলা গ্রামে এক যুবককে ছেলে ধরা সন্দেহে গণপিটুনি দিয়েছে এলাকাবাসী। পরে এলাকায় কয়েকজন মুরব্বির সহযোগিতায় এই যুবককে উদ্ধার করা হয়। বর্তমানে সে চিকিৎসাধীন আছে।

একই দিনে কমলগঞ্জ উপজেলায় ছেলেধরা সন্দেহে ২ জনকে আটক করে পুলিশে দিয়েছে এলাকাবাসী। এর মধ্য একজন গণপিটুনিতে গুরুতর আহত হয়েছেন।
সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে রহিমপুর ইউনিয়নের দেওড়াছড়া চা বাগান এলাকায় এক অপরিচিত যুবককে সন্দেহজনকভাবে ঘুরাফেরা করতে দেখে স্থানীয়রা তাকে আটক করে। পরে ছেলেধরা সন্দেহে স্থানীয় জনতা পুলিশে সোপর্দ করা হয়।

পুলিশ জানায়, আটক যুবকের নাম সানাউল্যাহ (২৫)। সে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল থানার বাসিন্দা। সে মানসিক ভারসাম্যহীন।

অপরদিকে উপজেলার মুন্সীবাজার ইউনিয়নের উবাহাটা গ্রাম এলাকা থেকে ছেলে ধরা সন্দেহে শহীদুর রহমান (৩২) নামের যুবককে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেছে এলাকাবাসী।

রোববার বিকাল সাড়ে ৫টায় এ ঘটনা ঘটে। আটক শহীদুর রহমান কমলগঞ্জ উপজেলার ৫নং কমলগঞ্জ সদর ইউনিয়নের সরইবাড়ি গ্রামের মখলিছুর রহমানের ছেলে।

পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে সে ওই রাস্তা দিয়ে সিলেট যাওয়ার কথা বলেছে।

অন্য দিকে সন্ধ্যায় কুলাউড়ার পীরের বাজার এলাকায় বন্ধুর প্রেমিকাকে তার বাড়িতে মোবাইল ও প্রেমপত্র দিতে গিয়েছিলেন বসন্ত শব্দকর (২৪) নামের এক যুবক। এ সময় স্থানীয়রা তাকে ছেলেধরা সন্দেহে আটক করে গণধোলাই দেয়। পরে পুলিশ গিয়ে তাকে উত্তেজিত জনতার হাত থেকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসে।

এর আগে শনিবার (২০ জুলাই) রাত ১০টার দিকে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে ছেলেধরা সন্দেহে অজ্ঞাত পরিচয়ের এক বৃদ্ধকে (৫০) পিটিয়ে হত্যা করেন স্থানীয়রা।

উপজেলার রহিমপুর ইউনিয়নের দেওড়াছড়া চা বাগান এলাকায় এ ঘটনাটি ঘটে। ওই ব্যক্তির পরিচয় এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে এই ঘটনায় রোববার সকালে ৩শ থেকে ৪শ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেছে কমলগঞ্জ থানা পুলিশ।

এর আগের দিন শুক্রবার (১৯ জুলাই) রাত সাড়ে ৮টায় মৌলভীবাজারের বড়লেখায় মানিক ও শাহনুর নামে দুইজন মদ খেয়ে মাতলামি করছিল। তাদের অসংলগ্ন কথাবার্তায় স্থানীয়দের সন্দেহ হয়।

একপর্যায়ে স্থানীয়রা ছেলেধরা সন্দেহে তাদের আটক করে ব্যাপক মারধর করেন। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে রাত ১১টায় তাদের উদ্ধার করে। পরে তাদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তাদের ভর্তি করা হয়।

বড়লেখা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. ইয়াছিনুল হক বলেন, আটককৃতরা ওই দুই যুবক ছেলে ধরা নয়। এরা মাদকসেবী।

এ দিকে শুক্রবার (১৯ জুলাই) বিকেল খেলার মাঠ থেকে নিখোঁজ হয় শ্রীমঙ্গল শহরের নিউ পূর্বাশা এলাকার বাসিন্দা ফরিদ মিয়ার ছেলে ও উদয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাথমিক শাখার ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থী নাদিম। এর পর থেকেই শ্রীমঙলে ছেলে ধরা আতংক ছড়িয়ে পরে।

তবে নিখোঁজ নাদিমকে শনিবার কুমিল্লা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।

নাদিমের পরিবার সূত্রে জানা যায়, শনিবার বিকেল ৫টার দিকে কুমিল্লা রেলস্টেশন থেকে নাদিম শ্রীমঙ্গলে তার মাকে ফোন করে কুমিল্লা রেলস্টেশনে অবস্থানের কথা জানায়। এরপর নাদিমের মা কুমিল্লায় অবস্থানরত তার আত্মীয়স্বজনদের ফোন করে কুমিল্লা রেলস্টেশনে পাঠান। পরে তারা নাদিমকে উদ্ধার করে বাসায় নিয়ে যান।

ছেলে ধরা আতংকে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া পৌরসভার ৮নং ওয়ার্ডে বাসিন্দারা শনিবার মধ্যরাত পর্যন্ত নিজ এলাকায় তল্লাশি চালিয়েছেন।

কুলাউড়ার সাংবাদিক এস আলম সুমন জানান, শনিবার সন্ধ্যায় হঠাত রটে যায় এলাকায় ছেলেধরা এক মহিলা ঢুকেছে। পরে সেই মহিলার খোঁজে মধ্যরাত পর্যন্ত তল্লাশি চালায় এলাকাবাসী। তবে পরে কিছুই খুঁজে পাওয়া যায়নি।

এদিকে একই পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ডে ছেলেধরা সন্দেহে শনিবার দিবাগত রাত ২টা পর্যন্ত এলাকায় তল্লাশি চালায় এলাকার লোকজন এবং মধ্যরাতে অজ্ঞাত দুই ব্যক্তিকে ধাওয়া করেছেন এলাকাবাসী।

এর কয়েকদিন আগে চাঁদনীঘাট ইউনিয়নের গুজারাই গ্রামে সন্ধ্যা বেলায় এক লোক তার ফুফাতো ভাইকে খোঁজতে আসেন। সেখানে ছেলেধরা সন্দেহে এলাকার ছেলেরা মারতে গেলে স্থানীয় যুবক আব্দুল কাইয়ুম মুন্না সে ব্যক্তিকে উদ্ধার করে নিজের হেজাফতে নেন।

আব্দুল কাইয়ুম মুন্না জানান, যখন জিজ্ঞেস করি ভাই কার কাছে এসেছেন লোকটা জানালো ওনার এক ফুফাতো ভাইকে খোঁজতে এসেছেন। নাম বলেছেন। কিন্তু ওনার ছবি কিংবা মোবাইল নাম্বার নাই। লোকটি ভদ্রলোক। পরে খবর নিয়ে দেখলাম এ নামে আমাদের এলাকায় একজন লোক আছে যিনি কিছুদিন আগে জায়গা কিনে নতুন এসেছেন। তবে যদি ওনাকে না সরাতাম তাহলে নিহত হতে পারতেন। এই হল আমাদের সন্দেহের অবস্থা।

এর আগে সদর উপজেলার কামালপুরে মানসিক ভারসাম্যহীন এক ব্যক্তিকে ছেলেধরা সন্দেহে আটক করে মারধোর করে এলাকাবাসী। সে ঘটনার ভিডিও ফেসবুক আপলোড করলে মুহূর্তেই শতশত শেয়ার হলে গুজব রীতিমত সারা জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। পরে এলাকার সচেতন কয়েকজন নাগরিকের সহযোগিতায় পুলিশ এসে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে।

একই এলাকায় এর ২-৩ দিন পরে আরেক ব্যক্তিকে আটক করে এলাকাবাসী। পরে সে ব্যক্তিকে উদ্ধার করে নিজের হেফাজতে নেন কামালপুরের স্থায়ী বাসিন্দা এবং মৌলভীবাজার জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. রাসেল আহমদ।

তিনি জানান, এই ব্যক্তিকে উদ্ধার করে আমি পুলিশে খবর দেই। পরে পুলিশ এসে তাকে নিয়ে যায়।

এ বিষয়ে মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার শাহ জালাল জানান, ছেলেধরা একটি ভুয়া ও মিথ্যা কথা। প্রতিটি এলাকার মেম্বার-চেয়ারম্যানের সাথে আলাপ করে সচেতনতার লক্ষ্যে মাইকিং করানো হচ্ছে। যে সব ফেসবুক আইডি থেকে এইসব গুজব রটানো হয়েছে তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত