নিজস্ব প্রতিবেদক

১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:২০

জরিপেই আটকে আছে লাউয়াছড়ার সড়ক সরানোর উদ্যোগ

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভেতর দিয়ে চলে গেছে রেল ও সড়ক পথ। এই দুই পথে অবাধ যান চলাচলের কারণে মারা যাচ্ছে বনের প্রাণি। বনের ভেতর থেকে সড়কগুলো সরানোর ব্যাপারে আলোচনা চলছে অনেকদিন থেকেই। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকেও সড়কগুলো স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত হয়।

সর্বশেষ গত জুনে বন থেকে সড়কপথ সরাতে যৌথ জরিপ চালায় বন বিভাগ এবং সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর। জরিপ শেষে বিকল্প সড়ক নির্মাণে ঐক্যমতে পৌঁছে দুই বিভাগের কর্মকর্তারা। তবে এখন পর্যন্ত এই জরিপেই আটকে আছে সড়ক সরানোর উদ্যোগ। এ বিষয়ে জরিপের পর আর কোনও পদক্ষেপ নেয়নি কেউই।

এ ব্যাপারে জরিপকাজে অংশ নেওয়া বন বিভাগের বন্য প্রাণি ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) মো. আনিসুর রহমান বলেন, জরিপে দেখা গেছে শ্রীমঙ্গলের রাধানগর থেকে কমলগঞ্জের বটতলা পর্যন্ত বিকল্প সড়ক নির্মাণ সম্ভব। এতে সড়কটি পুরো লাউয়াছড়া বনের বাইরে চলে আসবে। আমরা চেয়েছিলাম বিষয়টি আগে বন ও পরিবেশ মন্ত্রী শাহাব উদ্দিন আহমদের কাছে উপস্থাপন করবো। তিনি এই জেলার সাংসদ এবং সড়ক সরানোর ব্যাপারেও আগ্রহী। তাঁর ডিও লেটার নিয়ে বিষয়টি ঊর্ধ্বতন মহলে প্রেরণ করলে কাজটা তাড়াতাড়ি হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা মন্ত্রীর সাথে দেখা করতে পারিনি। ফলে জরিপের পর এই উদ্যোগ এখন পর্যন্ত তেমন এগোয়নি।

জরিপকাজে সওজ’র পক্ষে অংশ নেন এই অধিদপ্তরের শ্রীমঙ্গল কার্যালয়ের উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী রাশেদুল হক। তিনি সম্প্রতি বদলে হয়ে গেছেন। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন সাগরময় রায়। সাগরময় বলেন, লাউয়াছড়ার ভেতর থেকে সড়ক স্থানান্তরের বিষয়টি শুনেছি। কিন্তু আমি এখানে নতুন এসেছি। তাই জরিপের বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নই।

বনবিভাগ সূত্রে জানা যায়, ঢাকা-সিলেট রেলপথের ৫ কিলোমিটার আর শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সড়কের সাড়ে ৬ কিলোমিটার অংশ গেছে এই লাউয়াছড়া বনের ভেতর দিয়ে। প্রাণিবৈচিত্রের আঁধার এই সংরক্ষিত বনের ভেতর দিয়ে রেল ও সড়কপথ যাওয়ায় ট্রেন ও গাড়ির চাপায় পিষ্ট হয়ে প্রায় প্রতিদিনই মারা যাচ্ছে বনের প্রাণি।

লাউয়াছড়ার প্রাণিদের রক্ষায় বনের ভেতর থেকে সড়ক ও রেলপথ স্থানান্তরের দাবি দীর্ঘদিন ধরেই জানিয়ে আসছেন পরিবেশবাদীরা। পরিবেশবাদীদের দাবির মুখে ২০১৫ সালে লাউয়াছড়ার ভেতর থেকে সড়ক ও রেল পথ সরানোর একটি প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করে বন বিভাগ।

২০১৬ সালের ২ আগস্ট ‘লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণি অভয়ারণ্য এবং রাতারগুল জলারবন’ সুরক্ষায় করণীয় নির্ধারণে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় লাউয়াছড়া উদ্যানের প্রাণি রক্ষায় বনের ভেতর দিয়ে যাওয়া সড়ক সরিয়ে বিকল্প সড়ক নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়া বনের ভেতর থেকে কালাছড়া ও চাউতলি খাসিয়াপুঞ্জি সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, চা বাগান কর্তৃপক্ষ ও বনবিভাগ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সাথে সমন্বয় করে বিকল্প সড়ক বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়েছিলো ওই সভায়।

এই সিদ্ধান্তেরও ৩ বছর পর বিকল্প সড়ক নির্মাণের লক্ষ্যে গত জুনে যৌথ জরিপ সম্পন্ন করে নব বিভাগ ও সওজ। শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সড়কের বিকল্প হিসেবে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের বাইরে দিয়ে যে সব সড়ক গেছে, সেই সড়কের ওপর প্রাথমিক জরিপ চালানো হয়। জরিপে বিকল্প সড়ক নির্মাণে ঐক্যমতে পৌঁচে এই দুই বিভাগ।

জরিপ শেষে দুই বিভাগের কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন, শ্রীমঙ্গলের রাধানগর থেকে কমলগঞ্জের বটতলা পর্যন্ত বিকল্প সড়ক নির্মাণ সম্ভব। এতে সড়কটি পুরো লাউয়াছড়া বনের বাইরে চলে আসবে। বিকল্প সড়কের দূরত্ব ৮ থেকে ১০ কিলোমিটারের মতো হতে পারে। বিকল্প সড়ক নির্মাণ হলে উদ্যানের ভেতরের সড়কটি বন্ধ করে দেওয়া হবে। এ ছাড়া উদ্যান এলাকা থেকে নূরজাহান চা-বাগান হয়ে যে সড়কটি গেছে, সেটিও বন্ধ করা হবে। এতে যানবাহনের চাপায় পৃষ্ট হয়ে বন্যপ্রাণির মৃত্যুর আশঙ্কা থাকবে না।

তবে জরিপকাজ শেষ হওয়ার তিন মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরও সড়ক স্থানান্তরের বিষয়টি এখনও এই জরিপেই আটকে আছে। এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত আর কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তাই বনের ভেতরের সড়কটি আদৌ সরানো হবে কী না এই নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্সের হিসেব মতে, শুধু সড়কপথে গাড়ির চাকায় চাপা পড়ে লাউয়াছড়ায় প্রতিবছর মারা যায় প্রায় ৪৫টি বন্যপ্রাণি। আর রেলপথে মারা যাওয়া বন্যপ্রাণির হিসেব নেই কারো কাছে।

বনের ভেতর দিয়ে যাওয়া এই রেলপথ ও সড়কপথকেই বন্যপ্রাণির জন্য মরণফাঁদ হিসেবে মনে করেন লাউয়াছড়া বন ও জীববৈচিত্র রক্ষা আন্দোলনের আহবায়ক জলি পাল। তিনি বলেন, ‘ব্রিটিশরা মূলত সহজে বনের গাছ পাচারের জন্য সংরক্ষিত এসব বনের ভিতর দিয়ে রেল ও সড়ক যোগাযোগ তৈরি করেছিল। যা আমাদের বন্যপ্রাণিদের জন্য মরণ ফাঁদে পরিণত হয়েছে। আমরা বনের মধ্য থেকে সড়ক ও রেলপথ স্থানান্তরের দাবি জানিয়ে আসছি দীর্ঘদিন থেকে। পথগুলো স্থানান্তর করা না গেলে কোনভাবেই বন্য রক্ষা কারা যাবে না।’

১২৫০ হেক্টর জমি নিয়ে লাউয়াছড়া সংরক্ষিত বনাঞ্চল। ১৯৯৬ সালে এটিকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। উদ্ভিদ আর প্রাণিবৈচিত্রের আঁধার এই বন বিভিন্ন বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির প্রাণির আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত। বন বিভাগের হিসেব মতে, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৫৯ প্রজাতির সরীসৃপ (৩৯ প্রজাতির সাপ, ১৮ প্রজাতির লিজার্ড, ২ প্রজাতির কচ্ছপ), ২২ প্রজাতির উভচর, ২৪৬ প্রজাতির পাখি ও অসংখ্য কীট-পতঙ্গ রয়েছে। এই বনে বিরল প্রজাতির উল্লুক, মুখপোড়া হনুমান , চশমাপরা হনুমানও দেখতে পাওয়া যায়।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত