নিজস্ব প্রতিবেদক

১৯ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:৪০

পেঁয়াজময় দিন, লবণময় রাত

দুটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পেঁয়াজ আর লবণ নিয়ে সোমবার সিলেটে যা ঘটে গেলো একে রীতিমত তুঘলকি কাণ্ডই বলা চলে। সোমবার সকাল থেকে নগরীতে ছিলো টিসিবির পেঁয়াজ বিক্রয় নিয়ে হুলস্থূল। বিকেল হতে পেঁয়াজের স্থান দখল করে নেয় লবণ। লবণ নিয়ে একেবারে লঙ্কাকাণ্ড ঘটে যায় সিলেটে। নগরী ছাড়া লবণকেন্দ্রীক গুজব ছড়িয়ে পড়ে বিভাগময়।

ফলে একদিনের মধ্যেই পেঁয়াজের ঝাঁঝ আর লবণের তেতো স্বাদ পেলেন সিলেটবাসী।

পেঁয়াজ নিয়ে প্যাঁচাল: ভারত থেকে অবৈধপথে আনা প্রায় ৭ হাজার কেজি পেঁয়াজ গত শুক্রবার আটক করেছিলো র‌্যাব। সোমবার সকাল থেকে এই পেঁয়াজ নগরীর তিনটি এলাকায় ৪৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি করবে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি), এমন ঘোষণা দেওয়া হয়েছিলো আগেরদিনই।

এই নিয়ে হুলস্থূলের শুরু। সকাল থেকেই নির্ধারিত তিনটি পয়েন্টে পেঁয়াজের জন্য দীর্ঘ লাইন ধরেন নগরবাসী। রীতিমত আবালবৃদ্ধবনিতা দাঁড়িয়ে যান লাইনে। অশীতিপর বৃদ্ধ, হুইল চেয়ারে করে আসা পঙ্গু- সকলেই দাঁড়ান পেঁয়াজের লাইনে।

এক কেজি করে পেঁয়াজ বিক্রি করা হয় প্রত্যেকের কাছে। এক কেজি পেঁয়াজের জন্য লাইন ছাড়িয়ে যায় এক কিলোমিটার। দুপুরে পেঁয়াজের এই লাইনে নতুন মাত্রা দেন সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে নগরীর কিন ব্রিজের পাশের টিসিবির ট্রাক ঘিরে সৃষ্ট লাইনের শেষে কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে দাঁড়িয়ে যান মেয় আরিফ। লাইনে দাঁড়িয়ে পেঁয়াজ ক্রয়ও করেন মেয়র। স্যোশাল মিডিয়ার কল্যাণে লাইনে দাঁড়িয়ে মেয়রের এই পেঁয়াজ কেনার দৃশ্য ভাইরাল হয়ে যায় দ্রুত। চলে আলোচনা-সমালোচনা।

এই নিয়ে মাতামাতির মধ্যে নগরীর রিকাবীবাজারে ঘটে যায় আরেককাণ্ড। রিকাবীবাজারে কবি নজরুল অডিটোরিয়ামের সামনে টিসিবির ট্রাকে ঘিরে ক্রেতাদের লাইনে হঠাৎ ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়। এই ধাক্কাধাক্কি সামলাতে এগিয়ে আসতে হয় পুলিশকে। লাইনের শৃঙ্খলা ফেরাতে ব্যস্ত এক পুলিশ সদস্যের শটগানের গুলিতে আহত হন দু’জন। পুলিশ বলছে, অসাবধনতাবশত ‘মিসফায়ার’-এ দুর্ঘটনা ঘটেছে।

এসময় গুলিবিদ্ধ হন এক নারীসহ দু’জন। ওই নারীর পরিচয় পাওয়া যায়নি। অপর আহত পথচারী চন্দ্রকান্ত সিংহকে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল ১০টার পর থেকে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) উদ্যোগে ৪৫ টাকা দরে রিকাবিবাজার পয়েন্টে পেঁয়াজ বিক্রি শুরু হয়। দুপুরে হঠাৎ ভিড়ের মধ্য থেকে ধাক্কাধাক্কি শুরু হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গিতে পুলিশের পক্ষ থেকে লাইন সাজাতে গিয়ে হঠাৎ গুলি বের হয়ে যায়। অবশ্য এ ঘটনার পর আবার পেঁয়াজ বিক্রি শুরু হয়।

কিন ব্রিজ পয়েন্টে পেঁয়াজ কিনতে তালতলা থেকে আসা শফিক উদ্দিন বলেন, পেঁয়াজের যে দাম তাতে বাজার থেকে কেনা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এক কেজি পেঁয়াজ দিচ্ছে তারা, ওটা কম হলেও আমাদের জন্যে লাভ হয়েছে। অন্তত পেঁয়াজ খেতে পারব।

এদিকে, বিকেলে নগরীর কালিঘাট এলাকায় অতিরিক্ত মূল্যে পেঁয়াজ বিক্রি বন্ধে অভিযান চালায় জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত।

টিসিবি সিলেটের ইনচার্জ মো. ইসমাইল মজুমদার বলেন, সোমবার সকাল থেকেই আমরা খোলাবাজারে পেঁয়াজ বিক্রি শুরু করি। আমাদের ডিলার সরকার নির্ধারিত মূল্যে নগরের ৩টি পয়েন্টে ৩টি ট্রাকের মাধ্যমে পেঁয়াজ বিক্রি করা হয়। তবে ক্রেতাদের অতিরিক্ত চাপে হিমশিম খেতে হয় টিসিবির কর্মীদের। তিনি বলেন, প্রত্যেক ক্রেতার কাছে এক কেজি করে পেঁয়াজ বিক্রি করা হয়েছে।

দুপুরে টিসিবির লাইনে দাঁড়িয়ে পেঁয়াজ কিনতে এসে সিলেট সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, পেঁয়াজ নিয়ে দেশজুড়ে এক ধরণের নৈরাজ্য তৈরি হয়েছে। ব্যবসায়ীরা অনায্যভাবে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। আবার সরকারও তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। আজ আমি সাধারণ মানুষের কাতারে এসে পেঁয়াজ নিয়ে চলমান অস্থিরতার প্রতীকী প্রতিবাদ জানাচ্ছি।

এসময় তিনি পেঁয়াজ, চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমানোর দাবি জানান।

মেয়র আরিফ আরও বলেন, পেঁয়াজের দাম বাড়াকে কেন্দ্র করে নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য দ্রব্যের, বিশেষ করে চালের দাম বাড়ানোর একটা অভিযোগ আমরা পেয়েছি। এজন্য আমরা সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ম্যাজিস্ট্রেট এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দিয়ে সন্দেহভাজন ব্যবসায়ীদের খুঁজে বের করতে তদন্ত করছি। যাতে পেঁয়াজ ইস্যুতে অন্যান্য পণ্যের দাম না বাড়ে।

উল্লেখ্য, গত শুক্রবার (১৫ নভেম্বর) সিলেট শহরতলীর বটেশ্বর বাইপাস এলাকা থেকে ভারত থেকে অবৈধপথে আনা ট্রাকভর্তি পেঁয়াজ উদ্ধার করে র‌্যাব-৯। ওই ট্রাকে ৭ হাজার ২শত কেজি পেঁয়াজ ছিলো বলে জানিয়েছিলেন র‌্যাব-৯ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) মো. মনিরুজ্জামান। পরে এই পেঁয়াজগুলো প্রথমে নিলামে ওঠানোর কথা থাকলেও পরবর্তীতে টিসিবির মাধ্যমে খোলাবাজারে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত হয়।

লবণ নিয়ে লঙ্কাকাণ্ড: পেঁয়াজ নিয়ে এই হুলস্থূল ছিলো দিনভর। বিকেল হতেই পেঁয়াজের জায়গা নেয় লবণ। সোমবার বিকেল থেকে লবণের দাম বেড়ে যাচ্ছে এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ে সিলেটজুড়ে। এমন খবরে ক্রেতারা হুমড়ি খেয়ে পড়েন সিলেট নগরীর ভোগ্যপণ্যের দোকানগুলোতে। বাড়তি চাপে নিমিষেই ফুরিয়ে যায় নগরীর বিভিন্ন দোকানের লবণের স্টক। আবার অনেক ব্যবসায়ী বেশি দামে বিক্রির জন্য লবণ মজুদ করে রাখেন বলেও অভিযোগ ওঠেছে।

সিলেট নগরী ছাড়াও পুরো বিভাগজুড়ে লবণ নিয়ে চলছে এই লঙ্কাকাণ্ড। প্রশাসন বলছে, লবণের দাম বৃদ্ধির খবর পুরোটাই গুজব। কেউ উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে এই গুজব ছড়াতে পারে।

ব্যবসায়ীরাও জানিয়েছেন, লবণের চাহিদামাফিক সরবরাহ আছে। শীঘ্রই দাম বাড়ার শঙ্কা নেই।

তবে ব্যবসায়ীরা এমনটি দাবি করলেও সোমবার রাতেই অনেক দোকানে বাড়তি দামে লবণ বিক্রির অভিযোগ পাওয়া গেছে।

সোমবার রাতে সিলেট নগরীর কালিঘাটে লবণ ভর্তি দুটি ভ্যান জব্দ করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এসময় বিভিন্ন কোম্পানির প্রায় ১ হাজার কেজি লবণ জব্দ করা হয়। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালত লবণের অতিরিক্ত মূল্য রাখার দায়ে ২ ব্যবসায়ীকে ১৫ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও ৪৫ হাজার টাকা জরিমানা করে। অতিরিক্ত দামে লবণ বিক্রির দায়ে সোমবার (১৮ নভেম্বর) জকিগঞ্জ, বড়লেখা, ছাতকসহ বিভিন্ন স্থানেও ব্যবসায়ীদের জরিমানা করা হয়েছে।

গুজবকে কেন্দ্র করে এই হুলস্থূলের প্রেক্ষিতে জনগণকে বিভ্রান্ত না হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে সিলেট জেলা প্রশাসন, সিলেট জেলা এবং মহানগর পুলিশ। শ্রীমঙ্গলে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গুজবে বিভ্রান্ত না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে মাইকিং করা হয়েছে।

সোমবার রাতে নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, লবণ কেনার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন ক্রেতারা। বেশিরভাগ মুদি দোকানেরই মজুদ ফুরিয়ে গেছে। দোকানে লবণ না পেয়ে ক্রেতারা আক্রমণাত্মক আচরণ করতেও দেখা গেছে।

সব ক্রেতারই দাবি, লবণের দাম বাড়তে যাচ্ছে এমন খবর শুনেছেন। তাই লবণ কিনতে এসেছেন তারা। তবে কোথায় এমন সংবাদ শুনেছেন একথা কেউ বলতে পারেননি।

সুপারশপ স্বপ্ন'র হাউজিং এস্টেট শাখার ব্যবস্থাপক নাহিদ তারানা চৌধুরী বলেন, সন্ধ্যার পর থেকেই ক্রেতারা লবণ কিনতে ভিড় করেন। একেক জন ৪/৫ কেজি করে লবণ কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।

তিনি বলেন, আমাদের এখানে লবণের যথেষ্ট সরবরাহ রয়েছে। আমরা নির্ধারিত দামেই ক্রেতাদের লবণ বিক্রি করছি। লবণের দাম দ্রুত বাড়ার শঙ্কা নেই বলেও জানান তিনি।

তবে স্বপ্ন'র জিন্দাবাজার শাখার এক কর্মী বলেন, সন্ধ্যার পরই তাদের লবণের স্টক শেষ হয়ে গেছে।

দক্ষিণ সুরমার গোটাটিকরের মুদি দোকানি কয়েছ উদ্দিন কুটি বলেন, সন্ধ্যার পর আচমকা কেবল কেনার জন্য ক্রেতারা এসে দোকানে ভিড় করতে থাকেন। অল্প সময়ের মধ্যেই আমার দোকানের সব লবণ শেষ হয়ে যায়।

এ ব্যাপারে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) মো. জেদান আল মুসা লবণ নিয়ে গুজবে সাড়া না দেওয়ার আহবান জানিয়ে বলেন, এ ব্যাপারে পুলিশ সর্তক অবস্থায় আছে। লবণ নিয়ে যারা গুজব রটাবে তাদের বিরুদ্ধে কঠিন আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত