শাকিলা ববি

২১ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:৪৯

হারিয়ে যাচ্ছে মজুমদার দিঘী

সাগরদিঘীর পাড়, লালদিঘীর পাড়, রামেরদিঘীর পাড়- সিলেট নগরীর অন্তত ২০/২৫টি এলাকার নাম এরকম। দিঘীর নামে এলাকার নাম ঠিকই আছে, কিন্তু দিঘীগুলো নেই। ভরাট হয়ে গেছে অনেক আগেই।

একসময় সিলেটের পরিচিতি ছিলো দিঘীর শহর নামে। অপরিকল্পিত নগরায়নে এখন প্রায় সবগুলো দিঘীই ভরাট হয়ে গেছে। হাতেগোনা যে কয়েকটি টিকে আছে সেগুলোও রক্ষা করা যাচ্ছে না। নানা কৌশলে চলছে ভরাটের চেষ্টা। এরকম ভিন্ন কৌশলে চলছে নগরীর মজুমদারী এলাকার মজুমদারী দিঘী ভরাটের কাজ। দিঘীর উপর আবর্জনা ফেলে অনেকদিন ধরেই এই ভরাটের কাজ চলছে। এই আবর্জনার উপর রোপণ করা হয়েছে কলা গাছ। ফলে দিঘীর অস্তিত্বই এখন হারিয়ে গেছে। এই দিঘী ভরাট বন্ধে উচ্চ আদালত রায় থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। এভাবে প্রশাসনও কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলে অভিযোগ পরিবেশকর্মীদের।

নগরীর বিমানবন্দর সড়কের পাশে মজুমদারী এলাকায় প্রায় ৫১ শতক জায়গায় এই দিঘীর অবস্থান। ১৮৬৯ সালে তৎকালীন জমিদার সৈয়দ বখত মজুমদার এই দিঘী ও মাঠসহ তার জমিদারি ওয়াকফ সম্পত্তি হিসেবে দলিল করে দেন বলে জানা গেছে।

জানা যায়, এরআগেও একবার এই দিঘী ভরাটের তৎপরতা শুরু হয়। এর প্রেক্ষিতে দিঘীটি রক্ষায় ২০০৮ সালে উচ্চ আদালতে রিট করে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)। এই রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে ওই বছরের ১৯ আগস্ট রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত দিঘী ভরাট বন্ধের নির্দেশনা দেন আদালত। আদালতের এই নির্দেশনার পর কৌশলী হয়ে ওঠেন দখলদাররা। সরাসরি মাটি ফেলে ভরাট না করে রাতের আঁধারে আবর্জনা ফেলে ও কলা গাছের চারা রোপণ করে দিঘী ভরাট করে চলছেন তারা।

আদালতের ওই নির্দেশনায় দিঘী ভরাট বন্ধে ও দিঘী রক্ষার জন্য ব্যবস্থা নিতে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব, বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সচিব, পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক, সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার, ওয়াকফ প্রশাসক (ঢাকা), সুনামগঞ্জের ওয়াকফ পরিদর্শক, সিলেট বিভাগের পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালককে আদেশ দেন হাই কোর্ট। তবে দিঘী ভরাট বন্ধে তাদের কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।

সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা যায়, সৈয়দ বখত মজুমদার দিঘীটি ওয়াকফ সম্পত্তি হিসেবে দলিল করে দিলেও তাঁর উত্তরাধিকার মোনায়েম বখত মজুমদার, রায়হান বখত মজুমদার, শাহান বখত মজুমদার, মিলাদ বখত মজুমদার, আসাদ বখত মজুমদার, সাজ্জাদ বখত মজুমদার, মঞ্জুর বখত মজুমদার, মুহিব বখত মজুমদার নিজেদের এই দিঘীর মালিক হিসেবে দাবি করছেন। দিঘী ভরাটের সাথে তাদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠেছে। যদিও তারা তা অস্বীকার করেছেন।

এ ব্যাপারে বেলা, সিলেট’র বিভাগীয় সমন্বয়ক শাহ শাহেদা আক্তার বলেন, এই দিঘী ভরাট বন্ধে আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। দিঘীটি রক্ষায় সচিব, মেয়র, বিভাগীয় কমিশনারসহ কয়েকজনকে সরাসরি নির্দেশনা দিয়েছেন আদালত। কিন্তু তারা তা না মেনে কার্যত আদালত অবমাননা করছেন।

তিনি বলেন, আমরা মাঝে মাঝে চিঠি পাঠালে জেলা প্রশাসক ও সিটি কর্পোরেশন থেকে ওই জায়গায় কয়েকজনকে পাঠানো হয়। তারা গিয়ে দেখে আসেন। কিন্তু এরপর আর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না।

সরেজমিনে ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মজুমদারি দিঘীতে এখন আর পানি নেই। দিঘীর পশ্চিম দিকে আবর্জনা দিয়ে ভরাটের পর উপরে মাটি ফেলা হয়েছে। দিঘীর উত্তরপূর্ব কোনের একাংশে মাটি ভরাট করা হয়েছে। মাঝখানে কলাগাছের বাগান করা হয়েছে। দক্ষিণের অংশ ভরাট করে ১০টি দোকান কোটা গড়ে তোলা হয়েছে। আর বাকি অংশটুকু আবর্জনা ফেলে ভরাটের প্রক্রিয়া চলছে।

কে বা কারা এই দিঘী ভরাট করছেন এ ব্যাপারে প্রকাশ্যে কিছু বলতে চাননি স্থানীয়দের কেউ। তাদের সকলের দাবি, আগে মাটি ভরাট করে দিঘী ভরাট করার চেষ্টা করা হয়েছিলো। আদালতের রায়ের পর থেকে আবর্জনা ফেলে দিঘীটি ভরাট করে ফেলা হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মজুমদারী এলাকার কয়েকজন প্রবীণ বলেন, মজুমদার বাড়ির উত্তরাধিকার যারা আছেন তারাই এই দিঘী ভরাট করাচ্ছেন। কখনো ময়লা আবর্জনা ফেলে, কখনো কলা গাছের চারা রোপণ করে আবার কখনো রাতে ট্রাক দিয়ে মাটি এনে দিঘী ভরাট করছেন তারা।

তবে মজুমদার বাড়ির উত্তরাধিকারী আসাদ বখত মজুমদার বলেন, এই দিঘীটা অনেক আগেই আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। কারা ভরাট করছে, কলা বাগান করছে কিছু জানি না।

এই দিঘীতেই সাঁতার কেটে বড় হয়েছেন নগরীর হাউজিং এস্টেট এলাকার আব্দুল মুহিত। তিনি বলেন, আশপাশের প্রায় পাঁচ থেকে ছয়টি এলাকার মানুষজন এই দিঘী ব্যবহার করতেন। ২০০৮ সালে এই দিঘীতে কিছু পানি ছিল। তবে এর আগ থেকেই দিঘীটি বিভিন্ন দিক থেকে দখল হওয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল।

তিনি বলেন, এই দিঘীটা রক্ষা করা অনেক প্রয়োজন। কারণ এই এলাকায় এখন আর কোনো জলাধার নেই। তাই এই মজুমদারি এলাকায় আগুন লাগলে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হবে।

দিঘী ভরাট বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ না নেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, আদালতের নির্দেশনা থাকা স্বত্বেও অদ্যাবধি দিঘীটির দখল উচ্ছেদে কোন উদ্যোগ তো নেয়া হয়নি উপরন্তু নতুন করে দখল ও ভরাট প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে।

তবে সিলেট জেলা প্রশাসনের রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর (আরডিসি) উম্মে সালিক রুমাইয়া বলেন, গত ৩ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের রাজস্ব শাখা থেকে মজুমদারি দিঘী ভরাট বন্ধকরণে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক ও সিলেট সদর উপজেলার ভূমি অফিসের সহকারী কমিশনারকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত তাঁরা এ ব্যাপারে কোনো প্রতিবেদন দেননি বলে জানিয়েছেন রুমাইয়া।

এ ব্যাপারে সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. আসলাম উদ্দিন বলেন, উচ্চ আদালতের আদেশ সংশ্লিষ্ট সকলে মিলেই বাস্তবায়ন করতে হবে। এ ব্যাপারে বিভিন্ন দপ্তরে ইতোমধ্যে চিঠিও দেওয়া হয়েছে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত