নিজস্ব প্রতিবেদক

২৩ নভেম্বর, ২০১৯ ০২:২২

অপুষ্টিতে খর্বকায় চা বাগানের ৪৫% শিশু, শীর্ণকায় ২৭%

পাঁচ বছর আগে মা হন কুলাউড়ার লুহাইনি চা বাগানের শ্রমিক সীমা উড়াং। এর দুই মাসের মাথায় কাজে ফিরতে হয় তাকে। চা বাগানে কাজে ব্যস্ত থাকায় নিয়মিত মাতৃদুগ্ধ থেকে বঞ্চিত হয় শিশু অনিল উড়াং। এর প্রভাব পড়ে তার বেড়ে ওঠায়। বয়স পাঁচে পড়লেও অনিল দেখতে এখনো দুই-আড়াই বছরের শিশুর মতো। উচ্চতা দুই ফুটও অতিক্রম করেনি।

বয়স অনুযায়ী উচ্চতা বাড়ছে না শ্রীমঙ্গলের ভাড়াউড়া চা বাগানের শিশু কাজল পাল ও জলি রবিদাসের। বেঁটে বলে প্রায়ই উপহাস শুনতে হয় কাজলকে। তাই অধিকাংশ সময়ই মন খারাপ করে ঘরে বসে থাকে সে।

কাজল, জলি ও সীমার মতোই অবস্থা চা বাগানের ৪৫ শতাংশের বেশি শিশুর। যদিও পুষ্টি পরিস্থিতির ধীরে ধীরে উন্নতি হওয়ায় কমে আসছে খর্বকায় শিশুর হার। দুই বছর আগে সারা দেশে ৩১ শতাংশ শিশু খর্বকায় থাকলেও এখন তা ২৮ শতাংশে নেমে এসেছে।

বৈশ্বিক মাল্টিপল ইনডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভের (এমআইসিএস) অংশ হিসেবে বাংলাদেশ অংশের জরিপ চলতি বছর সম্পন্ন করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। এতে কারিগরি সহযোগিতা দিয়েছে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ। আর অর্থায়ন করেছে জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ)। জরিপের ফলাফলের ভিত্তিতে প্রতিবেদন তৈরির কাজ চলতি মাসেই শেষ হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী খর্বকায় শিশুর হার ২৮ শতাংশ। ২০১৭ সালের তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি ২০১৮ সালের হেলথ বুলেটিনে এ হার দেখানো হয়েছে ৩১ শতাংশ।

সিলেট বিভাগের চা জনগোষ্ঠী নিয়ে প্রথমবারের মতো আলাদা জরিপ করা হয় গত বছর। ইউনিসেফের সহযোগিতায় বিবিএস পরিচালিত এ জরিপের ফলাফল সম্প্রতি প্রকাশ করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে সিলেটের চা বাগানের শিশুদের অপুষ্টির ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। জরিপের ফল বলছে, চা বাগানের পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ৪৫ দশমিক ১ শতাংশ খর্বকায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বল্প মজুরি, ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবার অভাব ও মাতৃত্বকালীন সেবার অপ্রতুলতায় পুষ্টিহীনতায় ভুগছে চা শ্রমিক পরিবারের সদস্যরা। এর প্রভাব বেশি পড়ছে শিশুদের ওপর। খর্ব ও শীর্ণকায় হয়ে বেড়ে উঠছে তারা।

ইউনিসেফের পুষ্টিবিষয়ক কার্যক্রমের সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়ক ডা. নিম্মি হোসাইন বলেন, চা শ্রমিকদের মধ্যে পুষ্টি নিয়ে সচেতনতার অভাব রয়েছে। এ বিষয়ে তারা তেমন জানেই না। শিক্ষার হারও কম চা শ্রমিকদের মধ্যে। এছাড়া বাগানে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী নেই। এসব কারণে চা বাগানের শিশুরা মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগছে।

অপুষ্টির কারণে শুধু খর্বকায় নয়, শীর্ণকায় ও স্বল্প ওজন নিয়েও বেড়ে উঠছে চা বাগানের শিশুরা। ইউনিসেফের জরিপ বলছে, চা বাগানের ২৭ শতাংশ শিশু শীর্ণকায়। আর স্বল্প ওজনের ৪৭ দশমিক ৫ শতাংশ শিশু। যদিও বিবিএস ও ইউনিসেফের সর্বশেষ জরিপে জাতীয়ভাবে শীর্ণকায় শিশুর হার ৯ দশমিক ৮ ও স্বল্প ওজনের ২২ দশমিক ৬ শতাংশ। তবে সিলেট বিভাগে এ হার আরেকটু বেশি—যথাক্রমে ১১ ও ৩২ দশমিক ১ শতাংশ।

চা বাগানের শীর্ণকায় শিশুদের একজন সিতেশ মুণ্ডার ছেলে তুতুল মুণ্ডা। প্রায় পাঁচ বছর বয়সী তুতুল লম্বায় বেড়েছে ঠিকই, তবে একেবারেই শীর্ণ। সিতেশ মুণ্ডা বলেন, আমরা গরিব মানুষ। ভালো ভালো খাওয়াতে পারি না। সারা দিন কাজে থাকি। নিয়মিত খোঁজখবর নিতে পারি না। ডাক্তারও পাই না। ফলে ছেলেটা দিন দিন আরো রোগা হয়ে যাচ্ছে।

তথ্যমতে, দেশে চা বাগান রয়েছে ১৬২টি। এর মধ্যে ১৩৮টিই সিলেট বিভাগে। আর চা জনগোষ্ঠী রয়েছে প্রায় ৭ লাখ। যৎসামান্য মজুরির কারণে দেশের সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর অন্যতম চা শ্রমিকরা। জীবনমানের সব সূচকেই পিছিয়ে তারা। দুর্বল স্বাস্থ্য ও অপুষ্টি তাদের প্রধান সমস্যা।

তবে চা বাগানে পুষ্টি পরিস্থিতি এখন অনেক ভালো বলে দাবি করেন চা শিল্পের উদ্যোক্তা ও সিলেট মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আফজাল রশীদ চৌধুরী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, চা বাগানের শ্রমিকরা এখন অনেক ভালো আছে। প্রতিটি বাগানে চিকিৎসক, নার্স, মিডওয়াইফের ব্যবস্থা রয়েছে। শিশুদের দেখভালের জন্যও রয়েছে আলাদা ব্যবস্থা। এর মধ্যেও অভ্যাসগত কারণে কিছু শ্রমিক ও তাদের সন্তানরা অপুষ্টিতে ভুগতে পারে।

চা বাগানের শিশুদের পুষ্টি পরিস্থিতি নিয়ে গত মাসে একটি খসড়া পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করে সিলেটের স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালকের দপ্তর। অপুষ্টিকে এখানকার প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করা হয় পর্যবেক্ষণে। বলা হয়, মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্য, শিশু স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সেবা প্রদানের জন্য চা বাগানে কোনো সুবিধা নেই। অভাব রয়েছে দক্ষ সেবাদানকারী, ডে কেয়ার সেন্টার এবং শিক্ষা ও সচেতনতার।

সিলেট বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. দেবপদ রায় বলেন, চা বাগানের শিশুরা অপুষ্টিসহ স্বাস্থ্যের নানা সূচকেই অনেকটা পিছিয়ে ছিল। তবে এখন অবস্থার অনেক পরিবর্তন হচ্ছে। বাগানে বাগানে স্বাস্থ্যকর্মীরা যাচ্ছেন। মাতৃত্বকালীন সেবা প্রদান, শিশুদের সব টিকা নিশ্চিত করা হয়েছে। ফলে আগের অবস্থা এখন অনেকটাই বদলেছে।

শ্রীমঙ্গলের ১০টি বাগানের শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সেবা প্রদানের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন শ্রীমঙ্গল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য সহকারী বিনয় সিংহ। তিনি বলেন, এখানকার নারীরা মাতৃত্বকালীন তেমন কোনো সেবাই পায় না। ফলে বেশির ভাগ শিশু জন্ম থেকেই পুষ্টি সমস্যায় ভোগে। এর প্রধান কারণ অর্থনৈতিক দুরবস্থা।

চা বাগানের শ্রমিকদের শিশু ভাতা প্রদান, মাতৃত্বকালীন ছুটি নিশ্চিত করা এবং স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিষয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে এ অবস্থার উন্নতির সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি চা শ্রমিকদের পুষ্টি নিশ্চিতে বিশেষ প্রকল্প গ্রহণের কথাও বলছেন তারা।

জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, চা বাগানের মানুষগুলো বংশানুক্রমিকভাবে প্রকট দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করছে। তাদের জীবনমানও সাধারণের তুলনায় অনুন্নত। পুষ্টির অভাবে চা বাগানের শিশুদের মধ্যে খর্বকায় হওয়ার ঝুঁকিও তাই বেশি। চা বাগানের শ্রমিকদের জন্য সরকারের বিশেষ কিছু কর্মসূচি রয়েছে। এর আওতায় বরাদ্দও দেয়া হচ্ছে। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর প্রতি সরকারের নজর রয়েছে। চা বাগানের শ্রমিকরাও এর অন্তর্ভুক্ত। তাদের জীবনমান উন্নয়নে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত