মৌলভীবাজার প্রতিনিধি

১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ ০০:২০

কাঁদছে মৌলভীবাজার : ‘এমন নেতা ক’জন আছে?’

অসুস্থ হয়ে সিঙ্গাপুর যাওয়ার সপ্তাহখানেক আগের ঘটনা। মন্ত্রী তখন ঢাকায়। নিজ জেলা মৌলভীবাজার থেকে এক নারী মন্ত্রীর নাম্বার সংগ্রহ করে ফোন দিলেন। তাঁর সমস্যার কথা জানালেন। মন্ত্রী পরিচয় জানতে চাইলে ওই মহিলা জানান, তিনি তাঁর নির্বাচনী এলাকা রাজনগরের বাসিন্দা।

মন্ত্রী ওই নারীর পুরো বক্তব্য শুনলেন। বললেন মৌলভীবাজার আসলে যেন স্বামী/ বাবা বা ভাইকে নিয়ে তাঁর বাসায় যান। তাঁকে সর্বাত্মক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিলেন। সাথে ওই বিষয়ে বেশ কিছু পরামর্শ দিলেন।
মন্ত্রীর পরামর্শেই কাজ হয়ে যায় সমস্যাগ্রস্ত ওই নারী। তিনি তো অবাক ! একজন মন্ত্রী এভাবে নিজে সরাসরি ফোন ধরবেন। সময় নিয়ে আন্তরিকভাবে কথা বলবেন। অচেনা মানুষের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিবেন!

সোমবার মন্ত্রীর মৃত্যুর খবরে তাঁর বাড়িতে ছুটে আসেন সেই নারী। এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী মৃত্যুতে মৌলভীবাজার শহরের ৩৬ শ্রীমঙ্গল সড়কের তাঁর নিজ বাড়ি হাজারো শোকার্ত মানুষের ঢল নামে সোমবার। অনেকে এসময় কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, নিজ দল আওয়ামীলীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ সাধারণ মানুষেরা প্রিয় নেতার বাড়িতে ভিড় জমান। সোমবার সৈয়দ মহসিন আলীর বাড়িতে জড়ো হওয়া অনেকের সাথেই সাথেই কথা হয়। সকলেরই এক কথা- এমন জনদরদী নেতা আর পাওয়া যাবে না।

মৃত্যু সংবাদ শুনে সৈয়দ মহসিন আলীর বাড়িতে ছুটে আসা সদর উপজেলার কাগাবলা ইউনিয়নের বিধবা সুরমা বেগম আহাজারি করে বলেন, ‘এখন আমার পরিবারকে কে দেখবে? প্রতি মাসে মাসে কে সন্তাানদের ভরণপোষণ ও লেখাপড়ার খরচ দেবে?’ সুরমা জানান, তার স্বামীর মৃত্যুর পর সৈয়দ মহসিন আলী নিয়মিত তাঁকে আর্থিক সহায়তা করতেন।

সাইনবোর্ড পেইন্টার সুজিত জানান, তাঁর স্ত্রী ফুসফুস সমস্যায় ভুগছিলেন। আর্থিক অনটনে চিকিৎসা করাতে পারছিলেন না। সাহায্যের জন্য সৈয়দ মহিসন আলীর কাছে যান। মন্ত্রী ঢাকায় নিজ বাসায় তাদের রেখে উন্নত চিকিৎসা করান। সেখানে সুস্থ হয়ে ফেরেন সুজিতের স্ত্রী।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলীর ব্যক্তিগত ফটোগ্রাফার জনি দত্ত বলেন, ‘মন্ত্রীর মিন্টু রোডের বাসা যেন মিনি হসপিটাল। সব সময় ২০ থেকে ২৫ জন ক্যান্সার, লিভার, কিডনি ইত্যাদি রোগী থাকেন। নিজ জেলার বাইরেও সারাদেশ থেকে লোকজন আসেন। তাদের নিজ খরচে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিতেন তিনি।’ জনি জানান, অসুস্থ হওয়ার পর সিঙ্গাপুরে যাওয়ার সময় মন্ত্রী রোগীদের দেখভাল করার জন্য তাঁকে বলে যান। মন্ত্রী তাঁকে বলেন, ‘তুমি বাসায় যাও। আমার রোগীরা যেন সুচিকিৎসা পায়, তাদের যেন যত্মআত্তির কম না হয়। সেদিকে খেয়াল রেখো।’ একথাটি বলেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন জনি।

মন্ত্রীর ছোট ভাই সৈয়দ সলমান আলী বলেন, সাধারণ মানুষের জন্য নিবেদতি ছিলেন তিনি। মন্ত্রী-এমপি হওয়ার আগেও যেমন তাঁর দরজা সাধারণ মানুষের জন্য খোলা ছিলো। মন্ত্রী হওয়ার পরও ঠিক তেমনই। প্রতিদিন বাড়িতে কমপক্ষে হাজার খানেক আগন্তুক, নেতাকর্মী, শুভানুধ্যায়ী ্ও সমস্যাগ্রস্ত মানুষদের চা-বিস্কুট খাওয়াতে হয়। ভাত খাওয়াতে হয় কমপক্ষে শ’পঞ্চাশেক মানুষকে। বাড়িতে কখনও সীমানা প্রাচীর গড়ে তোলেননি। মন্ত্রী হওয়ার পরও ফোন নাম্বারটি সবার জন্য উন্মুক্ত ছিলো। নিজেই ফোন ধরতেন। মানুষের সাথে কথা বলতেন। সাধারণ মানুষকে নিয়ে থাকতেই পছন্দ করতেন।

জেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগের সভাপতি নাজমুল হক বলেন, সৈয়দ মহসিন আলী অসহায় দরিদ্র মানুষদের পাশে থেকেছেন সবসময়। নিজের উপার্জনের সবটুকু বিপদগ্রস্ত মানুষের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছেন। একটা কথা প্রচলিত ছিলো- ‘মহসিন আলী যে টাকা হাতে পেয়েছেন তা নিজের জন্য যতটা না খরচ করেছেন। তারচেয়ে বেশি অসহায়, দরিদ্র, সমস্যাগ্রস্ত মানুষের মাঝে বন্টন করে দিয়েছেন। হয়তো কারো মেয়ে বিয়ে দিতে পারছেনা, কেউ অসুস্থ, কারো লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম; কেউ খালি হাতে ফেরেননি।

মৌলভীবাজার চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি এবং সৈয়দ মহসিন আলী বাল্যবন্ধু ডা. এম এ আহাদ বলেন, ২০১৩ সালের নির্বাচনের সময় বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে সারাদেশে মন্ত্রী এমপিদের সম্পদের হিসাব নিয়ে নিয়মিত সংবাদ পরিবেশন হয়েছে। দেখা যায় অনেকের সম্পদ কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। কিন্তু সেখানে দেখা যায় তাঁর সম্পদ কমছে। জমি বিক্রি করে তিনি রাজনীতি করছেন।

ডা. আহাদ বলেন, ‘সৈয়দ মহসিন আলী বড়লোক ঘনিষ্ঠজনদের কাছ থেকে টাকা এনে গরীব অসহায় মানুষকে বিলিয়ে দিয়েছেন।

জেলা পরিষদ প্রশাসক, গণপরিষদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আজিজুর রহমান বলেন, ‘সৈয়দ মহসিন আলীর ছিলো প্রায় ৪০ বছরের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন। রাজনৈতিক অনেক উত্থান পতন গেছে, কিন্তু কখনই বিচলিত হননি। তিনি ছিলেন বিশাল হৃদয়ের অধিকারী, অসাম্প্রদায়িক চেতনার বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর।

মন্ত্রীর আরেক বাল্যবন্ধু মৌলভীবাজার প্রেসক্লাবের সভাপতি এম এ সালাম বলেন, সৈয়দ মহসিন ছিলেন একজন সঙ্গীতপ্রিয়, সংস্কৃতিমনা মানুষ। বাইরে কঠোরতা দেখালেও ভেতেরে ছিলেন একজন সরল মানুষ। কখনই কারো ক্ষতি করেননি।

মৌলভীবাজার পৌরসভার মেয়র এবং জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল করিম ময়ূন বলেন, আওয়ামীলীগ করলেও সকল দল ও মতের মানুষের সাথে তাঁর ছিলো বন্ধ্ত্বুপূর্ণ সম্পর্ক। তিনি ছিলেন এ অঞ্চলের মানুষের অভিভাবক।

পৌর কমিশনার নাহিদ হোসেন বলেন, সৈয়দ মহসিন আলীর হাত ধরেই মৌলভীবাজার পৌরসভা পরিচ্ছন্ন ও আধুনিকতার রূপ পেয়েছে।
জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক নেছার আহমদ বলেন, সৈয়দ মহসিন আলীর মৃত্যুতে এ জেলার মানুষের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে। তা কখনই পূরণ হবে না।

জেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুর রহমান বাবুল বলেন, আগামী ৫০ বছরেও এরকম বিশাল মনের অধিকারী, অভিভাবক, রাজনীতিবিদ পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ রয়েছে।

ব্যবসায়ী সৈয়দ মুনিম আহমদ রিমনের প্রশ্ন, রাজনীতি করে ব্যাংক ব্যালান্স নাই, পৈত্রিক সম্পদ বিক্রি করতে হয়। ঋণের বোঝা বাড়ে- এরকম নেতা কয়জন আছে ?

মৌলভীবাজার প্রেসক্লাবের জেষ্ঠ সহ-সভাপতি আবদুল হামিদ মাহবুব বলেন, তাঁকে নিয়ে অনেক সমালোচনা হলেও ব্যক্তিগত অনিয়ম-দুর্নীতির কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

সৈয়দ মহসিন আলীর মৃত্যুতে তাঁর বাড়িতে শোকবই খোলা হয়েছে। আয়োজন করা হয়েছে ক্বোরআন খতমের। বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করে মন্ত্রীর পরিবার থেকে সকলের কাছে দোয়া চাওয়া হয়েছে।

মন্ত্রীর ছোট ভাই সৈয়দ নওশের আলী খোকন জানান, লাশ দেশে আসার পর ঢাকায় আনুষ্ঠানিকতা শেষে মরহুমের নামাজে-জানাযা মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত হবে।

পরে হযরত সৈয়দ শাহ মোস্তফা (রঃ) এর দরগাহ প্রাঙ্গণে দাফন করা হবে। জানাযার সময় পরে জানানো হবে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত