রিপন দে, মৌলভীবাজার

১৪ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:৩৪

লাউয়াছড়ায় শতবর্ষী বৃক্ষসহ অর্ধশতাধিক গাছ কাটার উদ্যোগ

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের অর্ধশতাধিক গাছ কাটার উদ্যোগ নিয়েছে বন বিভাগ। এ উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে কাটা পড়বে বনের চাউতলী বিট থেকে শতবর্ষী গাছসহ আমলকি, জারুল, বহেরা, ডুমুরসহ বিভিন্ন ফলের গাছ।

খাবারের অভাবে যখন লাউছড়ার বন্যপ্রাণি প্রায়ই ছুটে আসছে লোকালয়ে, তখন বন্যপ্রাণিদের খাবারের প্রয়োজনে নতুন ফলের গাছ না লাগিয়ে উল্টো গাছার কাটার উদ্যোগের সমালোচনা করেছেন পরিবেশবাদীরা। গাছ কাটা হলে লাউয়াছড়া বনে থাকা বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির প্রাণিরা খাদ্য ও বাসস্থান হুমকিতে পড়বে বলে আশঙ্কা তাদের।

জানা যায়, লাউয়াছড়ার পার্শ্ববর্তী বিট চাউতলী। এ বিটের আয়তন ৩২ হেক্টর। ৩২ হেক্টরের ১০ ভাগ জায়গায় ১০ বছর আগে সামাজিক বনায়ন করে বন বিভাগ। সামাজিক বনায়নের নামে এখানে আকাশমণি ও বেলজিয়াম গাছ লাগানো হয় । ১০ বছর পর গাছ কেটে উপকারভোগীদের টাকা ফিরিয়ে দেবে বনবিভাগ সেই হিসেবে কাটা হবে সামাজিক বনায়নের ১০ বছর আগে লাগানো গাছ।

উপকারভোগীদের সামাজিক বনায়নের গাছ কাটার পাশাপাশি বনের দুর্লভ এবং বন্যপ্রাণিদের খাবারের প্রয়োজনীয় গাছ কাটার জন্য বাচাই করেছে মৌলভীবাজারের বন্যপ্রাণি ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ। যদিও ৫০ থেকে একশ বছর বয়সী এই গাছগুলো ১০ বছর আগে সামাজিক বনায়ন করার পূর্বেই এখানে ছিল।

চাউতলি বন বিটে ঘুরে দেখা যায়, ফলের গাছসহ বিভিন্ন বিরল প্রজাতির গাছ কাটার জন্য বিশেষ চিহ্ন (লাল নম্বরযুক্ত) দিয়ে রাখা হয়েছে। এই গাছগুলোর বয়স ৫০ থেকে ১০০ বছর। এর মধ্যে রয়েছে বহেরা, ডুমুর, হরিতকি, আমলকি, জারুল, রিঠা, ডেউয়া, লটকন, কাঠ বাদাম, লুকলুকি, কাউফল, বন উরি, কাটা জামসহ অর্ধশতাধিক ফল গাছ। যা থেকে ফল আহরণ করে বন্যপ্রাণিরা।

উল্লুক, চশমাপরা হনুমানসহ যে সব প্রাণি ফুলফল খেয়ে বেঁচে থাকে তাদের খাবারের গাছ এমনিতেই কমে গেছে লাউয়াছড়ায়। যার কারণে প্রায়ই লোকালয়ে ছুটে আসে বন্যপ্রাণি। তার উপর এভাবে গাছ কাটার আয়োজন বন্যপ্রাণির খাবারের অভাবকে আরও তীব্র করবে বলে মনে করেন বন্যপ্রাণি বিশেষজ্ঞরা।

এছাড়া কাটার জন্য বাচাই করে রাখা হয়েছে অতি মূল্যবান ধূপ গাছ, শতবর্ষী চাপালিক গাছ এবং সাতটি বড় বড় আকারের লোহা কাঠের গাছ। এই সব গাছ অতি মূল্যবান হওয়ার কারণেই কাটা হবে বলে অভিযোগ রয়েছে।

কেন এই সব গাছ কাটার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে বনবিভাগের প্রকৃতি ও বন সংরক্ষণ বিভাগের শ্রীমঙ্গল রেঞ্জ কর্মকর্তা মোনায়েম হোসেন জানান, ১০ বছরের রোটেশনে এখন গাছের আবর্তন কাল তাই গাছ কেটে উপকারভোগীদের টাকা দেওয়া হবে। উপকারভোগীরা এত দিন বাগান রক্ষা করেছে তাদেরকে এখন তাদের পাওনা বুঝিয়ে দিতে হবে।

তবে এই কর্মকর্তা জানান, ১০ বছর আগে যখন সামাজিক বনায়ন করা হয় তখন এই গাছগুলো এর আগে থেকেই এখানে ছিল।

সামাজিক বনায়নের আগের গাছ কেনো গাছ কাটা পড়বে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বনের উপকারভোগীরা চায় এই গাছ কাটা হোক। তবে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বিভাগীয় বন কর্মকর্তা নেবেন।

এ দিকে লাউয়াছড়ার মত সংরক্ষিত বন থেকে ৫০ থেকে একশ বছর বয়সী গাছ কাটার পরিকল্পনাকে অপরাধ বলে মন্তব্য করেছেন পরিবেশবাদীরা।

বন্যপ্রাণি গবেষকরা জানান, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান জীববৈচিত্র্যপূর্ণ সংরক্ষিত বন। এখানে পৃথিবীব্যাপী মহাবিপন্ন উল্লুক, চশমাপরা হনুমান, লজ্জাবতী বানর, উড়ন্ত কাঠবিড়ালিসহ বিপন্ন এবং সংকটাপন্ন অনেক প্রাণি রয়েছে। এরা পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল ফলের গাছের ওপর। তাদের খাদ্যসম্ভার ফল গাছ কেটে ফেললে হুমকির মুখে পড়বে বন্যপ্রাণিদের অস্তিত্ব। প্রয়োজনের তুলনার ফলের গাছের সংখ্যা কমে এসেছে লাউয়াছড়ায় যার কারণে প্রায়ই বন্যপ্রাণিরা বের হয়ে আসে লোকালয়ে।

এ বিষয়ে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স এন্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ড. বিশ্বাস করবী ফারহানা জানান, এই গাছগুলো কাটা হলে বন্যপ্রাণিরা খাবার এবং বাসস্থানের সংকটে পড়বে। প্রাণিরা অন্যত্র ছুটে যাবে, এর ফলে কিছু প্রাণি মারাও যেতে পারে। ব্যক্তিগত লাভের জন্য এত পুরাতন গাছ কেটে নেওয়ার ফলে হুমকিতে পড়বে ন্যাচারাল ইকো সিস্টেম। যেকোনো ভাবেই হোক এই গাছ কাটা বন্ধ করতে হবে। যে সব ফলের গাছ কাটার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে তার সবগুলাই বন্যপ্রাণিদের খাবারের জন্য দরকারি। খাবার অভাব থাকলে বন্যপ্রাণিরা বন থেকে বের হয়ে লোকালয়ে চলে আসতে পারে।

এ ব্যাপারে সিলেটের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (বন্যপ্রাণি ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ) আবদুল ওয়াদুদ জানান, আমি জানার পর ফলের গাছ এবং পুরাতন গাছ কাটার বিষয়টি বাতিল করে দিয়েছি ফলে এই গাছগুলো রক্ষা করা হবে। তবে সামাজিক বনায়নের আওতায় লাগানো আকাশমণি ও বেলজিয়াম গাছগুলোকে কাটা হবে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত