ফারুখ আহমেদ

২৭ এপ্রিল, ২০১৬ ১১:০৬

থেগামুখ, কর্ণফুলীর উৎসে...

কর্ণফুলীর উৎসমুখ ঠেগামুখ নামটাতেই রয়েছে অদ্ভুত মাদকতা। ভয় আনন্দ রোমাঞ্চ-এসব মিলিয়ে এবার অচেনা থেগামুখ ভ্রমণ ছিল স্বপ্নের এক অভিজ্ঞতা। স্বপ্নিল ছুটে চলার গল্প, এক অন্য জীবনের কয়েক মূহুর্ত, মুক্তির আস্বাদ পাওয়া ২৫ ঘণ্টা। রাঙামাটি থেকে ঠেগামুখ আমাদের এক অনবদ্য যাত্রা। পাহাড়ি রোদ্দুর, ডানা মেলা প্রকৃতি, উদরপূর্তি ভুলে গিয়ে চলতে চলতে এক সময় তৃপ্তির ঢেকুর তোলা, আশ্চর্যজনকভাবে এর সবই ছিলো আমাদের যাত্রাপথে। সীমান্ত চৌকিতে বোর্ডার গার্ড বাহিনী(বিজিবি)র মায়াবী আপ্যায়নসহ ঠেগামুখবাসির  অনেক ভালবাসায় ভিজিয়ে দেবার গল্প ছিল, ছিল অদ্ভুত শান্ত পরিবেশ আর নির্জনতা। রোমাঞ্চ হৃদয় স্পর্শ করে গিয়েছিল সে সব ঘটনা দিনক্ষণ। থেগামুখ ঘুরে ফিরে আসার পর ৭১ টিভির বন্যপ্রাণী ও পরিবেশ বিষয়ক সিনিয়র রিপোর্টার বন্ধু হোসাইন সোহেল দারুণ বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করেছিল আপনি ঠেগামুখ ঘুরে আসলেন, তাও আমাকে ছাড়া, গাইড কে ছিল, তার এমন অনেক অনেক প্রশ্ন শুনে শুনে এক সময় তার কাছে থেগামুখের  গল্প শুরু করি!



ঠেগামুখ বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী শেষ গ্রাম, কর্ণফুলী নদীর উৎসমুখ। স্থানীয়রা বলেন থেগামুখ। এখানে চাকমা ও মারমা নৃ-গোষ্ঠীর বসবাস। থেগামুখের কথা পত্রিকা পড়ে জেনেছিলাম, সেই জানাটাকে উসকে দিয়েছিল বন্ধু সমীর মল্লিক। থেগামুখে এখন পর্যন্ত কোনো পর্যটকের পদচিহ্ন পড়েনি শুনে যাবার জন্য পাগল হলাম, শুরু হল পরিকল্পনা। পরিকল্পনার সঙ্গে সুযোগ হয়ে এলো বাংলা নববর্ষের ছুটি। সহযোগিতা পেলাম সাংবাদিক হরি কিশোর চাকমা, বন্ধু গ্লোরি চাকমা এবং কমিউনিটি ম্যানেজার ও গুগল ড্রাইভার জাবেদ সুলতান পিয়াসের। প্রথমে ১৬ জনের দল ঠিক হলেও অনুমতি না পাওয়ায় ১৬ জন শেষ পর্যন্ত ৯ জনে গিয়ে ঠেকলো। আমরা ১৩ তারিখ রাতে দেশ ট্রাভেলসের গাড়িতে সওয়ার হলাম। নববর্ষের দিন আমরা রাঙামাটিতেই ছিলাম, পুরোদিন গ্লোরি চাকমার আপ্যায়নে কেটেছে। পরদিন ভোরবেলা বের হয়ে চলে আসি সমতাঘাট। এখানে আগে থেকই ঠিক করা মিল্টন চাকমার ট্রলারে চেপে যখন থেগামুখের উদ্দেশ্যে সমতাঘাট ছাড়ি তখন পুব আকাশে মেঘেদের আনাগোনা!



মেঘেদের আনাগোনা ছিল ঐ পর্যন্তই বাকিটা বৃষ্টি না পড়ার আফসোস, সেদিন মেঘ আর বৃষ্টি হয়ে ঝরেনি। তবে কর্ণফুলীর সেই সকালটা ছিল দারুণ। সেই দারুণ সকালে অসম্ভব ভাল লাগার পরশ বুলালো শুভলং-এর কাছের বৌদ্ধবিহার। পাহাড় ভেদ করে দাঁড়িয়ে থাকা বুদ্ধমুর্তিটির গায়ে পরা সূর্যালোকে স্বর্ণের মতোই ঝিকিমিকি করছিলো। বুদ্ধমূতির্র এমন অসাধারণ রূপে সঙ্গীরা সবাই আবেশে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লে সেখানেই আমাদের প্রথম যাত্রা বিরতি নিলাম, তারপর তো কেবল ছুটে চলার গল্প। এভাবেই শুভলং, বরকল ও বাঙাল টিলা হয়ে ঠিক সন্ধ্যে বেলা আমরা ছোট হরিণা পৌঁছি। সীমান্ত এলাকা বিধায় জোন কমান্ডার ল্যাফটেনেন্ট কর্নেল ফেরদৌসের পরামর্শে সেদিন আর সামনে না গিয়ে ছোট হরিণাতেই রাত্রিযাপনের সিদ্ধান্ত নেই। সাজানো গোছানো খুব সুন্দর ছোট হরিণা আর ভূষণ ছড়ার গল্প বলে শেষ করা যাবে না। মনে থাকবে বিজিবির জোন কমান্ডার থেকে শুরু করে নায়েক রহমতসহ প্রতিটি সদস্যের আন্তরিক সহযোগিতার কথা। সবার সঙ্গে মনে থাকবে অবশ্যই বাথুয়া রাখাইনকে। বাথুয়াদা’র ঘরের রান্না আর তার আতিথিয়েতার গল্প অনেক। আমরা ভোর চারটায় ছোট হরিণা ছাড়বো বিধায় তিনিও সে রাত আমাদের সঙ্গে জেগে কাটিয়েছেন। এভাবে চলতে চলতে কতভাবে কত জনের কাছেই আমরা ঋণী হয়ে পরি। বাথুয়াদাকে সে কথা বলতে তিনি দুহাত নেড়ে বললেন, আমি মুখ্য-সূখ্য মানুষ তবু বলি দাদা, ‘ভালবাসার আবার ঋণ হয় নাকি’ শুনে আমরা স্তব্ধ।



ভোর চারটা। ভোরের আলো তখনও ফোটেনি। অন্ধকার ভেদ করে আমরা বের হয়ে পড়লাম। ট্রলার চলা শুরু করতেই অনুভব করি স্বপ্নের মত ঠান্ডা হাওয়া বইছে চারিদিক। নিঝুম চারিপাশ কিন্তু আমাদের ভেতর উত্তেজনা। আমরা টান টান উত্তেজনার মধ্য দিয়ে রাঙামাটি জেলার বরকল উপজেলার গ্রাম ছোট হরিনা থেকে এগিয়ে চলি বড়হরিণার দিকে। বড় হরিণাতে আমাদের সেদিনের প্রথম যাত্রা বিরতি। বড় হরিণা সীমান্ত চৌকি বা বর্ডার আউটপোষ্টে (বিওপি) আমাদের ঠেগামুখ যাত্রা বিষয়ে ইনফরমেশন দেয়া ছিল। আমরা নাম এন্ট্রি করে বিজিবির দেয়া হালকা চা-নাস্তার আতিথিয়তা নিয়ে তবলাবাগ হয়ে ছুটে চলি থেগামুখ পানে।



বড় হরিণা পেরোতে পেরোতে কর্নফুলির উদ্দমতা মাতোয়ারা করেছিল আমাদের। পাশেই সবজু গাছে ভরা পাহাড়। পাহাড়ের ধাপে ধাপে ছোট ছোট বাড়ির মুগ্ধতা। এমন মুগ্ধতার মধ্যে আবারো হুহু ঠান্ডা বাতাস আমাদের জড়িয়ে ধরল। আরাম পেয়েই কিনা সঙ্গী সাথীরা ঘুমের অতলে হারালো। আমি না ঘুমিয়ে সারারাতের ক্লান্তি সরিয়ে ট্রলারের ছাদে গিয়ে বসলাম, একটু পর দেখি আনিচ মুন্সি চলে এসেছেন। তারপর সঙ্গী হলেন সাংবাদিক নওরিন আক্তার এবং চিকিৎসক নাদিয়া। এভাবেই এক সময় ঘুম সরিয়ে আরমান, লিওন, জিলানী, নাসরিন ও চিকিৎসক নাজমুল হকসহ বাকি সবার যায়গা হয়েছে ট্রলারের ছাদ। প্রচন্ড গরমের দিনেও কেমন কুয়াশা ভেজা প্রকৃতি। মধ্য এপ্রিলেও ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব আমাদের আঁকড়ে ধরেছিল। এভাবেই এক সময় সূর্যের আলোরা পাখা মেলতেই কর্ণফুলি নদী যেভাবে  চকচক করে উঠলো। সেই চকচকে সৌন্দর্য বর্ননাতীত, কেবল মাত্র হৃদয় দিয়ে উপলব্ধির। পাখির ডাক আলো ফোটার আগে থেকেই ছিল, এবার শুরু হল আমাদের কিচিরমিচির। দুপাশে পাহাড় আর সে পাহাড়ের ঘন জঙ্গলের মধ্যিখানে প্রবাহিত কর্ণফুলি নদী দিয়ে বড় হরিনা পেছনে ফেলে আমাদের ট্রলার এগিয়ে চলল আরো সামনে বাংলাদেশের শেষ এবং সীমানা গ্রাম থেগামুখের দিকে। এখানে আমাদের ট্রলার ও এলাকার অন্যান্য ট্রলারের সঙ্গে ভারতের পতাকাবাহি ট্রলার চলতে দেখে দারুণ রোমাঞ্চিত আমরা। এ এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা, মনে মনে ভাবলাম সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক একেই বলে। এমন আন্তরিকতার মধ্যেই পুরো চলার পথে একটা উপলদ্ধি খুব পীড়া দিয়েছে, এখানে খাবার পানির বড্ড অভাব। কতনা চড়াই পার হয়ে এলাকার মানুষকে দেখেছি খাবার পানি সংগ্রহ করতে কর্নফুলির তীরে ছুটে এসেছে। খাবার পানি বলতে স্বচ্ছ নদীর পানিই তাদের ভরষা। সে জন্য এলাকায় ডায়রিয়ার প্রকোপ বেশী বলে জানিয়েছিলেন এলাকার একমাত্র ডাক্তার বিজিবির মেডিক্যাল অফিসার ক্যাপ্টেন সজীব। কর্নফুলি নদী ও তার আশেপাশের সুন্দও প্রাকৃতিক দৃশ্য দুচোখ ভরে দেখতে দেখতে এবং নদীতে পানি কম হওয়ায় একটু পর পর মারো ঠেলা হেইয়ো বলতে বলতে এক সময় পৌঁছে যাই বাংলাদেশে সীমানা প্রাচীরের শেষ গ্রাম থেগাদোর বা ঠেগামুখ।


পুরো থেগামুখ এলাকা অনাবিল মুগ্ধতা নিয়ে দাঁড়িয়ে। সে মুগ্ধতা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল থেগামুখ বিওপির প্রবেশমুখের টাইটানিক জাহাজের ডিজাইন। দূর থেকে থেগামুখ চৌকিকে মনে হচ্ছিল যেনো একটা আস্ত টাইটানিক জাহাজ দাঁড়িয়ে। ধারণার চেয়ে আধাঘণ্টা দেরীতে থেগামুখ পৌঁছায় থেগাদোরের জোন কমান্ডার তার উৎকণ্ঠার কথা আমাদের জানালেন, তারপর আমাদের হালকা নাস্তা দিয়ে আপ্যায়িত করলেন। সেই ভোরবেলা বড় হরিণায় একবার চা নাস্তা পেটে পড়েছিল সুতরাং সবাই মোটামুটি ক্ষুধার্ত ছিলাম। বিজিবির দেয়া চা-বিস্কিট-পেঁয়াজু ও সিঙ্গারা তৃপ্তি নিয়েই খেলাম। নাস্তা সেরে এবার আমরা বের হই থেগা গ্রাম ঘুরে দেখতে, পাশেই সাজেকের দিকে বয়ে গেছে থেগা নদী।

 থেগামুখ সম্পর্কে যেমন ভেবেছিলাম তার উল্টোই দেখলাম। দুর্গম এলাকা হলেও সীমান্তঘেরা থেগামুখ বা থেগাদোর গ্রাম ছিমছাম, বেশ সাজানো গোছানো। এখানে ১০০ পরিবারের বসবাস। তার মানে সব মিলে এখানে একশটির মত বাড়ি বা ঘর আছে। একটা চমৎকার বাজার আছে। এখানকার কারবারি বা গ্রাম প্রধানের নাম পুলিন চাকমা। একমাত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তখন ক্লাস চলছিল। আমাদের দেখে ছাত্ররা বের হয়ে বিস্ময় নয়নে তাকালো, তারপর আমাদের ক্যামেরায় পোজ দেয়া শুরু করল। এখানে রেস্ট হাউস বা রাত্রী  যাপনের ব্যবস্থাও আছে। রেস্ট হাউস বলতে এখানকার চাকমা বা মারমাদের ঘর। খাবার হোটেল আছে, খেতে চাইলে আগে থেকে খাবারের ফরমাশ দিয়ে রাখতে হবে। রেস্ট হাউসে আশেপাশের এলাকার লোকজন বা পাশের ভারতে মিজোরামের ডেমাক্রির অতিথি ছাড়া অন্য আর কারো থাকার সৌভাগ্য হয়নি, খাবার ব্যবস্থাও তাদেও জন্যই জানালেন কারবারি পুলিন চাকমা। সপ্তাহের বুধ ও শুক্রবার এখানে হাঁট বসে। সে দুদিন এলাকা বেশ সরগরম থাকে। হাঁটে আসা ক্রেতার বেশীর ভাগই ওপার মিজোরামের। ভারতের ত্রিপুরা ও মিজোরামে বাংলাদেশী পণ্যের ব্যাপক চাহিদা। আরেকটা মজার তথ্য হল মিজোরামে বাংলাদেশের কুকরের কদর খুব বেশী। স্কাই টিভির অ্যানটেনা প্রতিটি ঘরে ঘরে। বাজারে আছে ভিডিও ও মোবাইলের দোকান। এখানে বাংলাদেশের মোবাইল নেটওয়ার্ক কাজ না করলেও ভারতের মিজোরামের ডেমাক্রির মোবাইল টাওয়ার একেবারে কাছে হওয়ায় সেই নেটওয়ার্ক দিয়ে তারা ছোট হরিনাসহ বরকল হয়ে রাঙামাটি তথা সারাদেশেই যোগাযোগ রক্ষা করতে পারে। আমরা পুরো গ্রাম ঘুরে থেগামুখ বাজারের বটগাছ তলায় বসে কারবারি পুলিন চাকমার আতিথিয়তা নেই। চা-বিস্কিট খাই, সঙ্গে মিজোরামের কোমল পানিয়। এভাবেই ঠেগামুখে ঘণ্টা দুয়েক কাটিয়ে লুসাই পর্বতমালা বা মিজোরামের নীল পাহাড়ের (ব্লু মাউন্টেইন) জলধারার ¯স্রোতের  মিলন স্থল কর্ণফুলী নদীর উৎসমুখ দেখে ফিরতি পথ ধরি, থেগামুখ তখন পেছনে!  


প্রয়োজনীয় তথ্য
বর্ষাকাল থেগামুখ যাওয়ার মোক্ষম সময়। রাঙামাটি থেকে ছোট হরিণা পর্যন্ত লঞ্চ সার্ভিস রয়েছে। ছোট হরিণা পর্যন্তই সাধারণের চলাচলের অনুমতি, তারপর আর অনুমতি নেই। কারণ এরপরের ছয় কিলোমিটার এলাকার পুরোটাতেই আদিবাসীদের বসবাস এবং সীমান্ত এলাকা। এখানে নদীর অর্ধেক বাংলাদেশের বাকি অর্ধেক ভারতের। নো ম্যানস ল্যান্ড বলতে যা বোঝায় পুরো ছয় কিলোমিটার এলাকা তাই। সুতরাং বড় হরিণা হয়ে থেগামুখ যেতে হলে অবশ্যই বিজিবির অনুমতি না নিয়ে যাওয়া যাবেনা। অনুমতির জন্য আপনাকে রাঙামাটির জিএসও (ইন্টেলিজেন্স) ৩০৫ পদাতিক ব্রিগেড বরাবর অনুমতির জন্য আবেদন করতে হবে, শুধুমাত্র অনুমতি পেলেই আপনি থেগামুখ যেতে পারবেন, তানা হলে নয়। দল যত ছোট হবে ততই সুবিধা ও অনুমতি পাওয়ার সুযোগ থাকবে। সুতরাং প্রথমে অনুমতি তারপর রাঙামাটি, তারপর সমতাঘাট বা রিজার্ভ বাজার থেকে ছোট হরিণা হয়ে থেগামুখ। যাত্রাকালে পর্যাপ্ত শুকনা খাবার ও পানি সঙ্গে রাখবেন। থেগামুখে সাধারণের রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা নেই। অনুমতি সাপেক্ষে ছোট হরিণঅ থেকে থেগামুখ দিনে গিয়ে দিনেই ফিরে আসতে হবে। এক কিংবা দুই রাত আপনাকে ছোট হরিণা থাকতে হবে। রাত্রিযাপনের জন্য ছোট হরিণার বিদ্যুৎ ও টয়লেট বিহীন রেস্ট হাউসে ছোট্ট ঘরই একমাত্র ভরসা। দু’তিনটা খাবারের হোটেল থাকলেও আগে থেকে ফরমাশ না দিলে খাবার পাওয়া যাবে না। তবে খাওয়া-দাওয়ার জন্য আপনি বাথুয়া রাখাইনের উপরই ভরসা করেতই পারেন। খরচ সর্বসাকুল্যে মাথাপিছু ৬৫০০টাকা!

আলোকচিত্র: লেখক


আপনার মন্তব্য

আলোচিত