এস আলম সুমন ও তপন কুমার দাস পাথারিয়া থেকে ফিরে:

১৬ আগস্ট, ২০১৬ ১৯:৪০

বড়লেখার পাথারিয়া পাহাড়ের বুক চিরে ফুল ঝেরঝেরী ও ফুলবাগিচা ঝর্না

ঘন সবুজ অরণ্য, সুউচ্চ পাহাড় আর কান পাতলেই ঝর্নার সমধুর আওয়াজ। মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতের জন্য বড়লেখার পাথারিয়া পাহাড় বিখ্যাত হলেও ভরা বর্ষায় ওখানে দেখা মিলে ছোট বড় আরো কয়েকটি ঝর্না।  প্রকৃতিপ্রেমী, ভ্রমণপিপাসু ও অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়দের জন্য তেমনি এক সৌন্দর্যের আধার পাথারিয়ার ফুল ঢালনী ঝেরঝেরী ও ইটাহরী ফুলবাগিচা ঝর্না।



পাথারিয়া পাহাড়ের উঁচু-নিচু টিলার উপর সবুজ বৃক্ষরাজি ও পাহাড়ের বুক চিড়ে প্রবহমান ছড়া প্রবলভাবে আকৃষ্ট করবে দর্শনার্থীদের। ছড়ার ছোট বড় পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে চলা স্বচ্ছ স্রোতস্বিনী জলধারা বিমোহিত করে তাঁর আপন স্বকীয়তায়। দুর্গম এই ছড়া দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় যত বিপত্তি ও ক্লান্তি আসুক না কেন ছড়ার স্বচ্ছ শীতল পানি, চারিদিকের সবুজ প্রকৃতি, বনফুল, চাষনী লেবুর সুবাস, পাখি ও ঝিঁঝিঁ পোকার কলতানে প্রকৃতির সুরে মিলিয়ে যাবে সব ক্লান্তি।


মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার সীমান্তবর্তী ডিমাই বাজার থেকে বড়লেখা সদর বন বিটের আওতাধীন পাথারিয়া পাহাড়ের নির্জন পল্লী ডিমাই পুঞ্জির পাশ দিয়ে দুর্গম পাহাড়ি  ও ছড়ার পথে হেটে গেলে বিভিন্ন দিক থেকে বয়ে আসা ছড়ায় প্রথমে চোখে পড়বে কয়েকটি খুবই ছোট ঝর্ণা। ছোট হলেও এগুলো দৃষ্টিনন্দন। পাহাড়ি পথ ও ছড়া দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় দুপাশের সবুজ ছায়াশীতল দৃষ্টিনন্দন প্রকৃতি যে কারো নজর কেড়ে নিবে অনায়েসেই।


ঘণ্টা দেড়েক (প্রায় ৬ কিলোমটিার) পিচ্ছিল পাথুরে ছড়া দিয়ে হাঁটার পর এই ছোট ঝর্ণাগুলো বেয়ে ওপরে ওঠলে দুটি টিলার ভিতরে চোখের সামনে ভেসে উঠবে অনিন্দ্য সুন্দর ঝেরঝেরী জলপ্রপাত। দুর্গম পথ পাড়ি দেওয়ার পর ক্লান্ত হয়ে পড়লে ঝেরঝেরীর শীতল জলধারায় শরীরটা ভিজিয়ে নিলে ক্লান্তি অনেকটাই কমে যাবে। একটু অদূরে এটার ঠিক ডান পার্শ্বে রয়েছে ইটাহরী ফুলবাগিচা ঝর্ণা। ছড়ার পথ ধরে ফুলবাগিচায় যাওয়া অসম্ভব। কারণ ফুলবাগিচার পানি প্রবাহের যে ছড়া সেটির দুপাশে দুটি টিলা রয়েছে। এই টিলা দুটির মধ্যখানে ছড়ার রাস্তাটি খুব সরু। তাই এই পথে ফুলবাগিচায় পৌঁছানো যাবেনা। ফুলবাগিচায় যেতে হলে প্রায় ৬০-৭০ ফুট উঁচু খাড়া দুটি পাহাড়ের পিচ্ছিল পথ বেয়ে এগিয়ে গেলে চোখে পড়বে ফুলবাগিচা জলপ্রপাত। স্থানীয়দের কাছে এগুলো ঢালনী (ঝেরঝেরী) ও ইটাহরী ফুলবাগিচা জলপ্রপাত নামে পরিচিত। এই জলপ্রপাত থেকে আসাম প্রদেশের করিমগঞ্জ বর্ডারের দূরত্ব প্রায় ৩ কিলোমিটার।


এই পাথারিয়া পাহাড়ের আরেকটি অংশে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ জনপ্রিয় জলপ্রপাত মাধবকুণ্ড। মাধবকুণ্ড ও কমলগঞ্জের কুরমা বনবিটের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত হামহামের মত বড় না হলেও ঝেরঝেরী ও ফুলবাগিচা পারিপার্শ্বিক পরিবেশের ছোঁয়ায় এগুলো অনেক দৃষ্টি নন্দন। স্থানীদের ভাষ্যমতে ঢালনী (ঝেরঝেরী) ও ইটাহরী ফুলবাগিচার মত পাথারিয়া পাহাড়েরর এই অংশে হতে চোখে পড়বে ত্রিপল ঝর্ণা, জামিনীকুন্ড, মৌলভীঝর্ণা, জমজ ঝর্ণা ও রামাকুন্ড নামে আরও প্রায় ৫ টি জলপ্রপাত। এগুলোর বেশিরভাগই মৌসুমি ঝর্ণা। বর্ষাকালে এই ঝর্ণাগুলো যৌবনদীপ্ত হয়ে ওঠে। আর শুষ্ক মৌসুমে এগুলোর কয়েকটি শুকনো থাকে। এছাড়াও পাথারিয়া পাহাড়েরর ফুলছড়ি নামক স্থানে রয়েছে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট নান্দনিক একটি মাটির ব্রিজ যা স্থানীয়দের ভাষায় মাটির পুল বলা হয়। এই ব্রিজটি দুটি টিলার সংযোগস্থল। প্রায় ৩০ ফুট লম্বা ব্রিজটির নিচ দিয়ে ছড়া প্রবাহিত রয়েছে। যাতায়াত ব্যবস্থার অপ্রতুলতা ও দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় হওয়ায় এবং প্রচার প্রচারণার অভাবে প্রকৃতির নয়নাভিরাম সৌন্দর্যে  প্রতীক এই জলপ্রপাতগুলো দীর্ঘদিন পর্যন্ত লোকচক্ষুর অন্তরালে রয়েছে।


উপজেলা সদর থেকে গাড়ি ও মোটর সাইকেলযোগে ডিমাই বাজারে গেলে সেখান থেকে কাচা পথ ধরে একটু অদূরে পায়ে হেটে গেল চোখে পড়বে দুর্গম পাহাড়ি পথ ও ছড়া। ছড়ার পানি যেমন স্বচ্ছ তেমনি পিচ্ছিল ছড়ার পাথরগুলো। ছড়ার অনেক অংশে রয়েছে গভীর পানি। এছাড়াও অনেক পাথর খুবই ধারালো ও অনেক ছোট বড় গর্ত রয়েছে। এসব পাথরের গর্তে পা ঢুকে গেলে পা মচকে যাবে। তাই খুব সাবধানে পা ফেলতে হবে। একটু অসাবধান হলেই ঘটতে পারে মারাত্মক দুর্ঘটনা। পাহাড়ি পথগুলোও বিপদজনক। স্থানীয় গাইড তারেক মিয়া ও সামাজিক বনায়নের বাগান মালিক সুরমান আহমদ জানান বর্ষাকালে এই ঝর্ণা ও ছড়ায় পানি বেশি থাকে। এখানে জোঁক ও বিষধর সাপ ও পোকা আক্রমণ করতে পারে। শুষ্ক মৌসুমে এখানে পানির ¯্রােত কম থাকে। পুরো পাথারিয়ারর বুক চিড়ে প্রায় অর্ধশতাধিক ঝর্ণা রয়েছে।

বড়লেখা সদর ইউনিয়নের স্থানীয় ইউপি সদস্য সিরাজ উদ্দিন সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, পাথারিয়া পাহাড়ে আগে বাঁশ মহাল ছিল। বর্তমানে সেটি সামাজিক বনায়নের আওতায় রয়েছে। সামাজিক বনায়নের আওতায় নিয়ে আসার পর বিভিন্ন বৃক্ষের পাশাপাশি ফলদ বৃক্ষ রোপণের ফলে এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশেও বৈচিত্র্য রূপের সৃষ্টি হয়েছে। প্রাকৃতিক ঝর্ণা আর ছড়া ও চারপাশে সবুজের সমারোহ যেটি দর্শনার্থীদের নজর কেড়ে নিতে পারে।

তিনি বলেন, "এখানে যদি যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করা যায় তাহলে দেশ বিদেশের পর্যটকরা প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে আসবেন। পর্যটকরা দুর দূরান্ত থেকে বড়লেখায় এসে শুধু মাত্র মাধবকুণ্ড ভ্রমণ করে যায়। এগুলোর প্রতি পর্যটন কর্পোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সুদৃষ্টি দেন তাহলে মাধবকুণ্ডসহ আশেপাশের দর্শনীয় স্থান দেখার পাশাপাশি এই জলপ্রপাতগুলোও দেখেও মুগ্ধ হবেন। এতে করে দেশের পর্যটন শিল্পের যেমন বিকাশ ঘটবে তেমনি সরকারও এর থেকে রাজস্ব আয় করতে পারবে। এছাড়াও স্থানীয় বেকার যুবকেরা পর্যটকদের গাইড হিসেবে কাজ করার সুযোগ পাবে ও এলাকায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি পাবে। ফলে এখানকার স্থানীয় লোকদের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে।"


মৌলভীবাজার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক প্রকাশ কান্তি চৌধুরী (রাজস্ব) সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সরকার দেশের পর্যটন শিল্পের বিকাশে খুবই আন্তরিক। বড়লেখার পাথারিয়ার জলপ্রপাত ও সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া হবে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ সমস্ত পর্যটন স্পট গুলোকে সার্বিক ব্যবস্থাপনা, যোগাযোগ, পর্যটকদের সার্বিক সুবিধা ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

যেভাবে যাবেন ও থাকবেন:
ঢাকা থেকে বড়লেখা যাওয়ার সরাসরি বাস সার্ভিস চালু আছে। এছাড়া ট্রেনযোগে কমলাপুর ও বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন থেকে কুলাউড়া স্টেশনে নামতে হবে। এবং সিলেট থেকে সকালে কালনী ট্রেনযোগে কুলাউড়া স্টেশনে নামতে হবে। সেখান থেকে সিএনজি অটোরিকশা অথবা রেন্ট এর মাধ্যমে প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করে বড়লেখায় যাওয়া যায়। এছাড়া সড়ক পথে ফেঞ্চুগঞ্জ অথবা বিয়ানীবাজার হয়ে বড়লেখায় যাওয়া যায়। বড়লেখা শহর থেকে সিএনজি অটোরিক্সাযোগে ডিমাই বাজারে নামতে হবে। প্রাইভেট গাড়িতে আসলে বড়লেখা পাখিয়ালা চৌমুহনীতে এসে পূর্বদিকের সড়ক দিয়ে গেলে ডিমাই বাজারে পৌঁছানো যাবে। ডিমাই বাজারে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সহযোগিতায় একজন গাইড জোগাড় করতে হবে। গাইডকে সঙ্গে নিয়ে প্রায় ৬ কিলো মিটার পথ হেটে গেলেই দেখা মিলবে ঝেরঝেরি ও ফুলবাগিচা জলপ্রপাত। তবে অবশ্যই সকাল ৮-৯টার দিকে রওয়ানা দিতে হবে নতুবা পুরো এলাকা ও সবকটি জলপ্রপাত ঘুরে দেখা যাবেনা। থাকার জন্য বড়লেখা শহরে কয়েকটি হোটেল রয়েছে। এছাড়াও কুলাউড়া ও মৌলভীবাজার সদরে বেশ কয়েকটি হোটেল রয়েছে।

সতর্কতা ও করণীয়:

গাইডের কাছ থেকে এলাকা সম্পর্কে ভালো করে জেনে নিন। পাহাড়ি ও পাথুরে ছড়া পথে শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করে চলার জন্য লাঠি সঙ্গে নিতে হবে। বর্ষাকালে রেইনকোট অথবা কাঁধে ঝুলানো ট্রাভেল ব্যাগটি ওয়াটার প্রুফ হতে হবে। কারণ বৃষ্টি হলে সঙ্গে থাকা মোবাইল, ক্যামেরা ও কাপড়গুলো ভিজে নষ্ট হয়ে যাবে। সাথে শুকনা খাবার, বিশুদ্ধ পানি আর খাবার স্যালাইন, জীবাণুনাশক ক্রিম, ব্যান্ডেজ ও তুলা সঙ্গে রাখবেন। পাহাড়ের ভিতরে মোবাইল নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়না এই বিষয়টিও লক্ষ্য রাখবেন। অবশ্যই সঙ্গে থাকা গাইডকে অনুসরণ করতে হবে। জোঁক ও সাপ থেকে সাবধান।
 

ভিডিও : ফুল ঝেরঝেরী

আপনার মন্তব্য

আলোচিত