মো. জাভেদ হাকিম

০২ ফেব্রুয়ারি , ২০১৭ ০২:২০

আদি ঢাকা হতে ‘হাকালুকি’

কাজ-কাম করি, সুযোগ করে ঘুরি। এই হলো দে-ছুট ভ্রমণ সংঘ বন্ধুদের নিয়ম নীতি। সেই নিয়মের ধারাবাহিকতায় ঘুরে এলাম হাকালুকি। ভৌগলিকভাবে সিলেট ও মৌলভীবাজার এই দুই জেলা নিয়ে হাকালুকি হাওরের বিস্তৃতি। কোন এক বৃহস্পতিবার, দিবাগত রাতে সাত ভ্রমণ পাগলা মাইক্রোতে মৌলভীবাজার ছুটি।

দে-ছুট-ছুটছে মন, দেহ শুধু গাড়ির আসনে হেলান। রাত প্রায় বারোটা। যাওয়ার পথে আড়াইহাজারের বাসিন্দা পিচ্চিকালে মধু খাওয়া এন্টিক শাহনূর ভাইয়ের খেজুর গাছের বাগানে হানা। আগে ভাগেই জানিয়ে রাখায় গাছি ভাইও বাগানে ছিলেন এ্যাকশন মুডে। যেন যেতে দেরী-নামাতে না হয় দেরী। এন্টিক ভাইয়ের প্রতি আমাদের আবদারও ছিল বেশ মারাত্মক। যাওয়ার আগেই রস নামানো চলবে না। আমরা যাবার পরেই রসের হাড়ি গাছ থেকে নামবে। তাই রাত দুপুরেও মডেল পাড়া সোসাইটি গ্রামটিতে ছিল অন্যরকম ভাব। আরে দে-ছুট ভ্রমণ সংঘ বলে কথা, ভাবতো অন্যরকম থাকতেই হবে। সবকিছুতেই ডিজিটাল হাওয়া বয়ে যাওয়ায় গাছেও মাটির হাড়ির বদলে ঝুলছিল প্লাস্টিকের জার।
 
হানিফ তার অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, নিপা ভাইরাস হতে রস মুক্ত রাখার জন্যই নাকি এমন পদ্ধতি। আসলেই বাগান মালিক একজন বুদ্ধির ভাগার। গাছের তলায় গ্লাস নিয়ে সবাই প্রস্তুত। ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে টর্চের আলোতে গাছি রস নামালো। রস নামাতে যতটুকুন দেরী মাগার গ্রোগ্রাসে সাবাড় করতে খুব একটা সময় লাগল না। সুস্বাদু রস পানে সব ফুর্তীতে মশগুল। এরপর শুরু হল মাল্টি ফারুকের তেলেসমাতি। শুরু হল মুরগী পোড়া আর লেটকা খিচুরী। উদর পূর্তি করতে করতে রাত প্রায় চারটা।

হাকালুকি যেতে হবে অথচ ফুর্তীবাজ গুলোর নেই কোন তাড়া। আর দেরি নয় চারটা পাঁচ মিনিটে আবারো গাড়ী স্টার্ট। গাউছিয়ার শাখা রোড ধরে উঠে যাই মহাসড়কে। ঘন কুয়াশা ভেদ করে গাড়ী চলে কচ্ছপ গতিতে। চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর নিষ্ফল চেষ্টা। ফজর পড়ি বি-বাড়ীয়া জেলার শেষ সীমানার কোন এক পথের ধারের মসজিদে। কুয়াশার চাদরে মোড়ানো পথে চলতে চলতে বেলা ১১.৩০ মিনিটে পৌঁছাই বড়লেখা উপজেলার দক্ষিণ বাজারে। স্থানীয় সাংবাদিক তপন কুমার দাস আগেই হোটেলে রুম বুকিং করে রাখায় বাড়তি ঝামেলা ছাড়াই সোজা রুমে। এবার জুম্মার প্রস্তুতি। তপনদা জানালেন দাসের বাজার এলাকায় প্রায় চারশত বছর আগের লঘাটি মসজিদে চলুন, সেখানেই নামাজ পড়বেন। বলেন কী? যেই কথা সেই কাজ ছুটছি মসজিদ মুখি।

কিন্তু আফসোস সময়ের গ্যাড়াকলে প্যাকেট বন্দি আমরা। অবশেষে পথেই এক মসজিদে জুম্মা আদায় করি। নামাজ শেষে যাই ঐতিহাসিক লঘাটি শাহ্ জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে। মসজিদটির ভিতরে-বাহিরে ছাদে উঠে খুটে খুটে দেখি।

স্থানীয়দের মাধ্যমে জানতে পারলাম প্রায় চারশত বছর পূর্বে মোঘল আমলে এর নির্মাণ কাল। পাশেই সবুজ ঘেরা এক বিশাল দিঘি। কালের স্বাক্ষী ঐতিহাসিক লঘাটি মসজিদ দর্শন শেষে ছুটি এবার হাকালুকি। হাকালুকি হাওর বাংলাদেশের মধ্যে সব চাইতে বড় হাওর। বড়লেখার তালিমপুর ইউনিনের হাল্লা গ্রামের পথ দিয়ে হাওরে ঢুকি। প্রথমেই চোখে পড়ে পানি শূণ্য ধুধু হাওড়ের বুকে দাঁিড়য়ে থাকা উঁচু এক পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। পাশেই বিট অফিস। যতটুকু পানি আছে এতে করে সুন্দর এক ক্যানেলের সৃষ্টি হয়েছে।

টাওয়ারে গিয়ে উঠি, দেখি চারপাশ। পড়ন্ত বিকেলে অন্য রকম ভালোলাগা। ভরা বর্ষায় থাকে সাগরের মত রূপ আর শীতে ফসলের মাঠ। হাকালুকি নামকরণের বেশ কিছু ধারণার মধ্যে অনত্যম হল “লুকিয়ে থাকা সম্পদ” থেকেই হাকালুকি হাওরের নাম এসেছে। তবে যাই হোক হাকালুকি হাওর বাংলাদেশের জন্য অফুরন্ত সম্পদের ভান্ডার।  

রাতে তাঁবু গাড়ব হাওরের কৈয়ারকোণা বিলের পাশে মনোহর আলী মাস্টার বাড়ির আঙ্গীনায়। স্থানীয়রা পাখিবাড়ি বলেই চিনে। বিট কর্মকর্তার আমন্ত্রণে চা-চক্র শেষে বিদায় নিয়ে যাই পাখি বাড়ি। পশ্চিম আকাশে সূর্য হেলে পড়ার পরপরই দেখি শত শত পাখির দল ছুটে আসছে সেই বাড়ির দিকে। আমরাও জলদি জলদি পৌঁছি।

ওয়াও ! অবিশ্বাস্য সব ব্যাপার, ঝাঁকে ঝাঁকে পাখির দল মাস্টার বাড়ীর গাছের ডালে বসছে। নানান জাতের প্রায় আড়াশ গাছ নিয়ে দুই একর আয়তনের বাড়ীটি যেন পাখিদের রাজ্য। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেল প্রায় ৪০ বছর যাবৎ এই বাড়ীর গাছে পাখিদের নিরাপদ আশ্রম।

হরেক জাতের পাখিদের মধ্যে উল্লেখ যোগ্য নিশীবক, সাদাবক, পান কৌড়ী, জলকুড়া, সরালি, কুদালিসহ আরো বিভিন্ন প্রজাতির বাস। শীত মৌসুমে অতিথি পাখির ঝাক দিনের আলোতে আশে পাশের বিল গুলোতে বিচরণ শেষে সন্ধ্যায় ফিরে এই বাড়ীতে। পাখি বাড়ীর কেয়ার টেকার জানালেন, পাখির দল এই বাড়ীর গাছ ছাড়া পাশের বাড়ীর গাছেও বসে না। তাঁর কথায় আশ্চর্য না হয়ে পারি না।  

নানান পাখির কিচির-মিচির শব্দ সত্যিই শুনতে লেগেছে অসাধারণ। আমরা গাছের ফাঁক ফোকর দিয়ে পাখি দেখায় ব্যস্ত। বাড়িটির জমিন বিষ্টা দিয়ে ঢেকে গেছে তবুও পাখিদের প্রতি রয়েছে বসবাস করা মানুষ গুলোর গভীর ভালোবাসা। সন্ধ্যা হবার সাথে সাথেই পাখি বাড়ীর পাশে তাঁবু ফেলি। শুরু হয় বোয়াল আর রুই মাছের ফিস ‘বার-বি-কিউ’ আর মজার মজার খেলার প্রতিযোগিতা।

বিশাল হাওরের বুকে রাতের তাঁবু বাস-সে এক ভয়ানক মজাদার আনন্দ। হাকালুকি হাওর এশিয়ার মধ্যে অন্যতম বৃহত্তম মিঠা পানির জলাভূমি। শুধুমাত্র বিলের আয়তনই ৪, ৪০০ হেক্টর। প্রায় ৩২২ প্রজাতির মিঠা পানির মাছের আবাস। জীব-বৈচিত্রে ভরপুর। সেই রকম এক অপার্থিব পরিবেশে হিজল করচ গাছের তলায় রান্নার আয়োজনে কেউ কাটে পিয়াজ কেউ বাটে আদা-রসুন কেউবা আবার হাড়ি পাতিল নিয়ে মহা ব্যস্ত।

সবাই যেন আজ-আদি ঢাকার ওস্তাদ বাবুর্চী সাজার চেষ্টায় মরিয়া আর সদ্য সদস্য কামাল ভাইয়ের কথা আজ আর নাই লিখি। সারা দিন ঘুরাঘুরি শেষে বিনোদন পর্ব যেমন খুশী তেমন সাজো, হাত পাঞ্চা আর মার্শাল আট খেলা উপস্থিত সবার মাঝেই বাড়তি আনন্দের রসদ জুগিয়েছে। পাঞ্চায় জসিম উদ্দিন যেমন খুশী তেমন সাজো’তে রনী মৃধা ও মার্শাল আর্টে আমি জাভেদ হাকিম বিজয়ী হই।

দে-ছুট সংগঠনের সৌজন্যে বিনোদন মূলক পুরষ্কার বিজয়ীদের মাঝে বিতরণ করেন সাংবাদিক তপন কুমার দাস, সুলতান আহমদ খলিল এবং এজে লাভলু।

ইতিমধ্যে ভাত-তরকারী ডাল-ফিস বার-বি-কিউ রেডি। প্রথমে বার বি কিউ ভোজ। পরে সমান তালে চলে ভাত-গোস্ত-মুগ ডাল দিয়ে উদর পুর্তী। কেন যেন শত পরিশ্রম করার পরেও কাইউম ভাইয়ের কপালে জুটলো লালকালি। গুণীদের মনে হয় আজকাল এমনই হয়। দিন শেষে ব্যাপক বিনোদনের পরে পরদিন স্ব-স্ব দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে মধ্য রাতেই তাঁবু গুটিয়ে ঢাকার পথ ধরি।

যোগাযোগ : ঢাকার সায়েদাবাদ হতে বড়লেখা উপজেলা সদরে বিভিন্ন পরিবহনের বাস সার্ভিস চলাচল করে। ভাড়া ৫০০/= টাকা হতে ৫৫০/=টাকা মাত্র। পাখি বাড়ির দূরত্ব উপজেলা সদর হতে মাত্র পনের কিলোমিটার পশ্চিমে। দক্ষিণ বাজার সিএনজি স্ট্যান্ড হতে কাননগো বাজার ভাড়া নিবে ২০টাকা সেখান থেকে আবারো ২০ টাকা ভাড়ায় সিএনজিতে খুটাউরা। কিছুটা পথ হেঁটে হাওরের কৈয়ারকোণা বিলের পাশেই পাখি বাড়িটির অবস্থান। সব চাইতে সুবিধা হবে ভ্রমণ পিপাসুরা যদি প্রথমেই নিজস্ব বা রেন্ট গাড়ী রিজার্ভ নিয়ে নেন।

থাকা-খাওয়া : উপজেলা সদরের দক্ষিণ বাজারে মোটামুটি মানের বেশ কিছু আবাসিক হোটেল ও রেস্টুরেন্ট রয়েছে। খরচ নাগালের মধ্যেই। এছাড়া স্থানিয়দের সহায়তায় রাতে হাওরে তাঁবু বাস ও নিজেরাই রান্না করে খেতে পারবেন।

সতর্কতা : কোন অবস্থাতেই পাখিদের বিরক্ত ও পরিবেশের  ক্ষতি হয় এরকম কিছু হতে বিরত থাকবেন। বর্জ্য পুঁতে ফেলবেন নতুবা চটের ব্যাগে করে নিয়ে আসবেন। স্থানীয়রা যে স্থানে তাঁবু ফেলার পরামর্শ দিবেন ঠিক সেই জায়গাতেই গাড়বেন। আশে পাশে কোন বাজার নেই সুতরাং সঙ্গে করেই সদাই-পাতি নিয়ে যাবেন।

পাখি দেখার সময় কাল : পাখি বাড়িতে সারা বছরই নানান প্রজাতির দেশীয় পাখির দেখা মিলে আর অতিথি পাখির প্রাচুর্যতা মিলবে মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত