মৌসুমী বিশ্বাস দাসগুপ্ত

০৮ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:৩৭

প্রথম বাঙালি ভূ-পর্যটক সিলেটের রামনাথ

[বিশ্বপর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের জন্ম ১৮৯৪ সালের ১৩ জানুয়ারি হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার বিদ্যাভূষণ পাড়ায়। ১৯৩০-এর দশকে বাইসাইকেলে চেপে তিনি বিশ্বভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। দুনিয়ার দুর্গমতম স্থানেও তিনি পা রেখেছেন। ভ্রমণের পাশাপাশি তিনি অক্লান্তভাবে লিখে গেছেন। উপন্যাস থেকে ভ্রমণবৃত্তান্ত মিলিয়ে তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা তিরিশের বেশি, যার মধ্যে আছে— অন্ধকারের আফ্রিকা, আজকের আমেরিকা, বেদুইনের দেশে, মরণবিজয়ী চীন, মাওয়ের দেশে, লাল চীন, সর্বস্বাধীন চীন প্রভৃতি। তার রচিত গ্রন্থে সংশ্লিষ্ট দেশের ইতিহাস, সমসাময়িক সমাজ ও রাজনীতির নির্মোহ বিবরণী পাওয়া যায়। ১৯৫৫ সালের ১ নভেম্বর চিরকুমার রামনাথ কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।]

বাংলার রেনেসাঁর আমল থেকেই বাঙালিরা দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে যাওয়া শুরু করে এবং একই সঙ্গে তাদের ভ্রমণবৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ করতেও উদ্যোগী হয়। তবে বিশ্বপরিব্রাজকের মানসিকতা নিয়ে দুনিয়ার সব মহাদেশ স্পর্শ করাটা অবশ্যই কঠিন কাজ। আর বাঙালিদের মধ্যে আধুনিককালে রামনাথ বিশ্বাসের আগে কোনও বিশ্বপর্যটকের কথা জানা যায় না। বহুকাল ধরে রামনাথ বিশ্বাসই বাংলার প্রথম বিশ্বপরিব্রাজক বলে পরিচিত ছিলেন। তার স্মৃতিকথা ও ভ্রমণবৃত্তান্ত ব্যাপকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। তারপর ১৯৯৫-৯৬ সালে একটি বাংলা ভ্রমণ ম্যাগাজিন বিমল মুখার্জীর লেখা স্বল্প পরিচিত ও আউট অব প্রিন্ট একটি বই ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ শুরু করে এবং তাকে প্রথম বাঙালি তথা ভারতীয় বিশ্বপরিব্রাজক বলে দাবি করে।

বাংলার রেনেসাঁর শক্তি স্বদেশী আন্দোলনের চেতনায় রূপান্তর হতে শুরু করে। আরও যেসব ক্ষেত্রে রেনেসাঁ বাঙালিকে প্রেরণা দিয়েছিল, তার মধ্যে আছে ঘর থেকে বেরিয়ে দুনিয়াটাকে জানা-বোঝা। কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন, ‘থাকবো নাকো বদ্ধ করে দেখবো এবার জগত্টাকে।’ তার এই লাইন দুটো নতুন অভিযানের প্রেরণাকেই তুলে ধরে। এ প্রেরণা ছিল জাতীয়তাবাদী জাগরণেরই একটি অংশ।

রামনাথ ছিলেন অনুশীলন সমিতির সভ্য। তিনিও কাজী নজরুল ইসলামের মতো প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের পক্ষে লড়তে বেঙ্গল রেজিমেন্টে নাম লিখিয়েছিলেন। এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। শুধু রামনাথ ও নজরুলই নন, আরও অনেকে রোমাঞ্চের তাড়নায় সেনাদলে নাম লিখিয়েছিলেন। তারা সেনাদলে নাম লিখিয়েছিলেন কারণ তারা যুদ্ধবিদ্যা শিখতে চেয়েছিলেন। তাদের ইচ্ছা ছিল, এ বিদ্যা তারা পরবর্তীতে ইংরেজদের ভারত থেকে বিতাড়ন করতে কাজে লাগাবেন। শিক্ষিত বাঙালিরা ক্রমেই রোমাঞ্চ, বীরত্ব ও সামরিক প্রেরণা দিয়ে প্রভাবিত হয়ে পড়ছিল।

বাঙালিরা নতুন নতুন আবিষ্কারের জন্য ঝুঁকি নিয়েছিলেন। রামনাথ তখন ইরাকে বেঙ্গল রেজিমেন্টের হয়ে যুদ্ধ করছেন কিন্তু এই যুদ্ধ পরিস্থিতিতেও নতুন জায়গা আবিষ্কারের নেশা তার মধ্যে জেগে ছিল। এ সময় দুনিয়ার পথে বাঙালির বেরিয়ে পড়াকে নতুন দেশ, মানুষ, সমাজ সম্পর্কে জানার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা যেতে পারে। তবে এটা ইউরোপীয়দের দুনিয়া ‘আবিষ্কার’-এর মতো সাম্রাজ্যবাদী কোনও প্রকল্প ছিল না। বরং এই বিশ্বপথিকরা প্রাচীন বাঙালি ও ভারতীয়দের স্থল ও সাগর ভ্রমণের ঐতিহ্যকেই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। আমাদের প্রাচীন সাহিত্যে জ্ঞানী পর্যটক (পরিব্রাজক), ব্যবসায়ী (বণিক) ও কপর্দকশূন্য ঘুরে বেড়ানো সন্ন্যাসীদের উপস্থিতি হরহামেশাই দেখা যায়। রামনাথ বিশ্বাস ও বিমল মুখার্জী এ ঐতিহ্যেরই অংশ, যেখানে ভ্রমণ কেবল তথ্য জড়ো করা নয়; বরং প্রজ্ঞা ও আত্মোপলব্ধির অনুসন্ধান।

তবে পরবর্তীকালে সেই প্রাচীন ঐতিহ্য বজায় থাকেনি। বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক কারণে বাঙালি তথা ভারতীয়রা গৃহেই বন্দি হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে এই বিশ্বপথিকরা নতুন করে যে দুনিয়ার পথে নেমেছিলেন, তা ছিল জাতীয়তাবাদী প্রেরণা। তারা ইতিহাসের বিগত পর্ব থেকে নিজেদের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়কে নতুন করে জীবিত করতে চেয়েছিলেন। প্রাচীনকালে সাগরপথে দুনিয়ার পথে চললেও মধ্যযুগে এসে ভারতীয়রা ঘরে আবদ্ধ হয়ে পড়ে, বিশেষত বাঙালিদের জন্য সমুদ্রযাত্রা নিষিদ্ধ হয়ে যায়। রামনাথ বিশ্বাস ও বিমল মুখার্জীর ভ্রমণকে প্রাচীন হারানো সেই প্রেরণার উদ্ধার প্রচেষ্টা বলা যায়।

বিমল মুখার্জী পশ্চিমে থাকার সময় গরুর মাংস খেয়েছেন। তিনি যেকোনো রকমের সংস্কার থেকে একেবারে মুক্ত ছিলেন এবং বর্ণপ্রথায় বিশ্বাসী ছিলেন না। তার ভ্রমণবৃত্তান্ত থেকে জানা যায়, একই সঙ্গে তিনি ছিলেন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরোধী, একজন হিন্দু এবং গর্বিত বাঙালি।

বিমলের ভ্রমণের সবচেয়ে বড় অর্জন ছিল যে, তিনি দুনিয়ার দূরতম প্রান্তেও বাঙালির পদচিহ্ন এঁকে দিয়েছিলেন। যেমন— তিনি তুরস্কে একজন বাঙালি সেনার বিধবা তুর্কি স্ত্রীর দেখা পেয়েছিলেন। সেই বাঙালি সেনার নাম বিমল জানতে পেরেছিলেন জনাব বোস হিসেবে। এই বোস প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের হয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। তিনি বিভিন্ন মহাদেশের দূরতম ও অদ্ভুত সব জায়গায় বাঙালিদের দেখা পেয়েছিলেন। তিনি তার লেখনীতে ভূগোল ও ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে সময় ও স্থানের ভেদ ঘুচিয়ে বাঙালি ডায়াস্পোরাকে একসূত্রে বেঁধেছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ মানুষকে স্থানচ্যুত করেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বেঙ্গল রেজিমেন্টের হয়ে যুদ্ধ করেছিলেন অনেক বাঙালি কিন্তু যুদ্ধের পর যখন রেজিমেন্ট ভেঙে দেয়া হয়, তখন তাদের অনেকে দেশে ফিরতে না পেরে আরব ভূমিতে বসবাস শুরু করেছিলেন। তারা অনেকেই আরব নারীদের বিয়ে করেছিলেন। বিমল মুখার্জীর লেখা থেকে এমনটাই জানা যায়।

রামনাথের সাব-সাহার আফ্রিকা ভ্রমণবৃত্তান্ত কয়েকটি নির্দিষ্ট কারণে বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। তিনি স্বচ্ছন্দে আফ্রিকার অধিবাসীদের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন (তখনকার প্রচলিত রীতি অনুসারে তিনি তাদের নিগ্রো বলে সম্বোধন করেছেন)। রামনাথ যখন কেনিয়ায় ট্রেনে তার ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে কয়েকজন আফ্রিকানকে নিয়েছিলেন, তখন তার সঙ্গী ভারতীয়রা এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। কারণ তারা আফ্রিকান নিগ্রোদের ক্ষেত্রে এক রকম অস্পৃশ্যতা বজায় রেখে চলতেন এবং তাই তারা রামনাথের এমন উদার আচরণের প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। আরেক জায়গায় ভারতীয় ও আফ্রিকান দম্পতির ঘরে জন্মানো শিশুদের দুরবস্থা নিয়ে লিখেছেন। কারণ ভারতীয়রা এই শিশুদের তাদের স্কুলে ও সমাজে প্রবেশ করতে দিত না। বিশ্বাস তার পর্যবেক্ষণ থেকে বলেছিলেন, যত দিন না ভারতীয়রা আফ্রিকানদের সঙ্গে সমতাভিত্তিক আচরণ করছে, তত দিন তাদের ইউরোপীয়দের কাছে সম-আচরণের দাবি করার নৈতিক অধিকার নেই। রামনাথ ন্যায়সঙ্গত কথাই বলেছিলেন। সে আমলে আফ্রিকায় বসতি করা ভারতীয়দের (বিশেষত গুজরাতি) জাতিবিদ্বেষী আচরণের তুলনায় জাতিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে রামনাথের এই নম্র মিশন ছিল একেবারে বিপরীত। ব্যতিক্রম অবশ্য ছিল। সেখানে রামনাথের সঙ্গে একজন গুজরাতির পরিচয় হয়েছিল, যিনি বাংলা ভাষা জানতেন। রামনাথ স্বদেশী যুগের বিখ্যাত বাংলা জার্নাল হিতবাদীর গ্রাহক ছিলেন, এ জার্নালেই তার ভ্রমণকথা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হচ্ছিল। সেই বাংলা জানা গুজরাতি ভদ্রলোক রামনাথের বর্ণবাদবিরোধী লড়াইকে সমর্থন দিয়েছিলেন। জাঞ্জিবারে সফরের সময় রামনাথ প্রত্যক্ষ করেছিলেন যে, কীভাবে আরবরা স্থানীয় আফ্রিকান ও সেখানে অবস্থান করা ভারতীয়দের নিপীড়ন করে। তিনি লিখেছেন, ব্রিটিশরা সেখানে জাতিগত দ্বন্দ্ব ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় উসকানি দিত। রামনাথ একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন, যেখানে আরবদের সহিংসতার জবাবে শিখরাও সহিংস জবাব দিয়েছিল এবং শিখদের জবাবের ধরন দেখে আরবরা সেই দাঙ্গা আর বাড়ানোর ঝুঁকি নেয়নি।

পৃথিবীর দূরতম প্রান্তেও সিলেটি বাঙালিকে পেয়ে যাওয়াটা ছিল বিমল ও রামনাথের ভ্রমণের সাধারণ ঘটনা। যেমন— বিমল কিউবায় এক সিলেটির দেখা পেয়েছিলেন আর রামনাথ পেয়েছিলেন জাঞ্জিবারে।

ব্যাপক ভ্রমণ তাদের দুজনের স্বাস্থ্যের ওপরই বিরূপ প্রভাব ফেলেছিল। তারা দুজনই বিভিন্ন কীটপতঙ্গের কামড় খেয়েছিলেন এবং সেগুলো তাদের ত্বকের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব বয়ে এনেছিল। পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছিল। কারণ ভ্রমণের সময় তারা সবসময় গোসল করতে পারতেন না, পরিষ্কার স্থানে থাকতে পরতেন না এবং ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতাও সবসময় রক্ষা করা সম্ভব হতো না।

মাঝে মধ্যেই তারা কপর্দকশূন্য হয়ে যেতেন। একজন বিশ্বপথিকের পকেটে বেশি টাকা-পয়সা থাকা এমনিতেও উচিত নয়, কারণ ডাকাতির ভয় থাকে। আর রামনাথের ভ্রমণবৃত্তান্তে দেখা যায়, তিনি ভ্রমণের সময় পকেটে অর্থ থাকাকে দুশ্চিন্তার কারণ হিসেবে দেখতেন। মাঝে মাঝে তিনি তার সব অর্থই গরিব মানুষদের দিয়ে দিতেন। বিমল মাঝে মাঝে আক্ষরিক অর্থেই অনাহারে থাকতেন, কারণ কলকাতা থেকে তার কাছে কোনও আর্থিক সহায়তা পৌঁছেনি। যদিও অনেকেই তাকে সফর শুরুর সময় আর্থিক সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি কলকাতা থেকে কোনও আর্থিক সহায়তাই পাননি এবং এভাবেই ১১ বছর বিশ্বপথিক হয়ে ভ্রমণ করেন। তবে নির্মম পরিহাস হচ্ছে, ১৯৩৭ সালে কলকাতায় ফিরলে লোকজন তাকে নিয়ে বেশ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিল। বিমলের লেখা থেকেই জানা যায় এ বিষয়ে।

বিমল ও রামনাথ উভয়ই সফর করেছিলেন ১৯৩০-এর দশকে। বিমল মুখার্জী যাত্রা শুরু করেছিলেন ১৯২৬ সালে এবং শেষ করেছিলেন ১৯৩৭-এ। রামনাথ তার তিনটি ওয়ার্ল্ড ট্যুর করেছিলেন ১৯৩১ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে। এদের দুজনের ভ্রমণবৃত্তান্তে একটি পার্থক্য রয়েছে। রামনাথ ভ্রমণকালীন অবস্থাতেই লিখেছেন এবং সেগুলো প্রকাশিত হয়েছে। অন্যদিকে বিমল মুখার্জী তার ভ্রমণবৃত্তান্ত লেখা শুরু করেছিলেন ১৯৮৯ সালে। ধারণা করা যায়, তিনি ভ্রমণের সময় ডায়েরিতে লিখে রাখতেন, তা না হলে এত পরে বিভিন্ন খুঁটিনাটি বিবরণ স্মরণ রাখা সম্ভব নয়। তবে ভ্রমণের অর্ধশতক পরে লেখা বিমলের বৃত্তান্তের শতভাগ প্রামাণিকতা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।

রামনাথ ব্রিটিশদের অনুগত বাঙালিদের সমালোচনা করেছেন, তিনি দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে এমন বাঙালির দেখা পেয়েছেন। তার লেখায় ১৯৩০-এর দশকে আফগানিস্তানে রুশ প্রভাবের বিবরণ পাওয়া যায়। রামনাথের লেখা থেকে আরও জানা যায়, সাধারণ আফগানদের ধারণা ছিল বাঙালিরা সাধারণত দুই প্রকারের মানুষ— এক. জাদুকর, যারা মন্ত্র ও জাদু জানে; আর দুই. হুলিয়া নিয়ে পালিয়ে বেড়ানো বিপ্লবী (বাহাদুর বাঙালি)।

রামনাথ একটি অদ্ভুত তথ্য দিয়েছেন যে, মুসলিম পাঠানরা নিজেদের আসলে হিন্দু বলে বিবেচনা করত। আমেরিকার ডেট্রয়েটে এই পাঠান ও পাঞ্জাবি মুসলমানরা মিলে প্রতিষ্ঠা করে হিন্দু অ্যাসোসিয়েশন। অথচ অন্য ভারতীয়রা প্রতিষ্ঠা করেছিল ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন। তিনি একজন কাবুলিওয়ালার দেখা পেয়েছিলেন, যিনি কলকাতায় লক্ষ্মী নামে এক নারীকে হিন্দু রীতি অনুসারে বিয়ে করেছিলেন। যদিও সেই লক্ষ্মী এখন বোরকা পরে। রামনাথ তার ভ্রমণবৃত্তান্তে হিজাবের বিরুদ্ধে কথা বলেননি, যদিও বিমল তা বহুবার করেছেন। সে যা-ই হোক, অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, রামনাথ আফগানিস্তানের দুর্গম এলাকায়ও বাঙালিদের বাস করতে দেখেছেন। সেখানে এই বাঙালিরা কেউ ব্যবসা আবার কেউ চাকরি করত।

রামনাথ তার লেখায় মানুষকে সবসময় জেনোফোবিয়া থেকে মুক্ত হতে শিক্ষা দিতে চেয়েছেন। আফগানিস্তান ও আফগান মানুষদের সম্পর্কে বাঙালিদের মধ্যে প্রচলিত অনেক নেতিবাচক গল্পকে তিনি বাতিল করেছেন। তার ভ্রমণবৃত্তান্ত আফগানদের নানা প্রশংসায় পূর্ণ। তিনি যখন আফগানদের সঙ্গে মিশেছেন, তখন নিজেকে বাঙালি হিন্দু বলেই পরিচয় দিতেন। তার কাছে এই দুই পরিচয় মধ্যে কোনও দ্বন্দ্ব নেই। যারা জেনোফোবিয়ার কারণ হিসেবে পরিচয়কে দায়ী করেন, তারা নিজেদের পরিচয় মুছে দিতে চান, তারা বিশ্বমানব। রামনাথ কিন্তু সে রকম কেউ ছিলেন না। তিনি জাতীয়তাবাদী ছিলেন এবং অন্য জাতিকেও ভালোবাসতেন।

রামনাথ ছিলেন একজন বিখ্যাত বিশ্বপর্যটক এবং তার ভ্রমণবৃত্তান্ত প্রকাশের সময়ই পাঠকদের মধ্যে সাড়া ফেলেছিল। তিনি ভ্রমণ করতে করতে অব্যাহতভাবে লিখতেন। কিন্তু বিমল তার বৃত্তান্ত লিখেছেন অনেক পরে। তার বৃত্তান্তে ভুল ও স্মৃতিবিভ্রাটের আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। (যেমন— দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝের সময়ে জার্মানি সফরের সময় অ্যাডলফ হিটলারের সঙ্গে তার সাক্ষাতের বিষয়টি গালগপ্পই মনে হয়)। রামনাথ ভ্রমণের সঙ্গে সঙ্গে লিখেছেন, তার লেখায় বিশ্বাসযোগ্যতার অনেক উপাদান আছে, যার অভাব রয়েছে বিমলের লেখায়। বিমল এ বিষয়ে কোনও ব্যাখ্যা দেননি। আমাদের অবাক হতে হয় যে, কেন তিনি তার ভ্রমণবৃত্তান্ত ৫২ বছর পরে লিখলেন!

বিমল মুখার্জী ১৯২৬ সালে সাইকেলে চেপে যাত্রা শুরু করেন। প্রথমে তিনি ভারত ভ্রমণ করে আফগানিস্তানে প্রবেশ করেন। অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক একটি তথ্য পাওয়া যায় ১৯৩৩ সালে রামনাথের লেখা ভ্রমণবৃত্তান্ত থেকে। তিনি লিখেছিলেন যে, খুব অল্প কয়েকজন ভারতীয়ই তখন পর্যন্ত আফগানিস্তান সফর করেছিলেন। তিনি সীমান্তের কর্মকর্তার কাছে জানতে পেরেছিলেন যে, তার আগে তিনজন পার্সি সাইকেলে চেপে ভারত থেকে আফগানিস্তানে প্রবেশ করেছিলেন। তারও আগে একজন বৈষ্ণব হাতে একতারা নিয়ে হরিনাম জপতে জপতে আফগানিস্তানে প্রবেশ করেছিলেন। শেষ ছয় বছরে রামনাথ ছিলেন আফগানিস্তানে প্রবেশকারী পঞ্চম ভারতীয় পর্যটক।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিমল যদি ১৯২৬ সালে কয়েকজন সঙ্গীসহ সাইকেলে চেপে আফগানিস্তানে প্রবেশ করেই থাকেন, তাহলে সেই সীমান্ত কর্মকর্তা কেন তার কথা রামনাথের কাছে উল্লেখ করলেন না? অবশ্য সেই কর্মকর্তা সর্বশেষ ছয় বছরের কথা বলছিলেন, সে হিসাবে সময়কাল শুরু হয়েছিল ১৯২৭ সাল থেকে। তবে সাইকেলে চেপে একদল বাঙালি কাবুল সফরে যাচ্ছে— এমন কথা তো সেই কর্মকর্তার ভোলার কথা নয়। তবে এটাও হতে পারে, তিনি ১৯২৬ সালের পরে সেখানে কাজে যোগ দিয়েছিলেন।

বিশ্বর্যটকদের কথা ভ্রমণ সাহিত্যে ঘুরেফিরে আসে। অন্যদিকে বিশ্বপর্যটকের নামে প্রতারণার আশঙ্কাও থাকে সবসময়। সেই প্রাচীনকাল থেকেই ভুয়া ভ্রমণ বিবরণী নিয়ে সন্দেহ চলে আসছে (জন ম্যান্ডেভিলের কথা স্মরণ করা যেতে পারে)। সত্যজিৎ রায়ের সোনার কেল্লায় একজন ভুয়া বিশ্বপর্যটক মান্দার বসুর দেখা পাওয়া যায়। একই পরিচালকের আগন্তুক সিনেমার কেন্দ্রীয় বিশ্বপর্যটক চরিত্রটি নিয়েও সন্দেহ কাটে না। তবে সিনেমার শেষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষা দেখানো হয়েছে যে, মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ। একইভাবে কেউ চাইলে বিমল বিশ্বাসের বিবরণীতে বিশ্বাস রাখতে পারেন। তবে বিশ্বপর্যটক প্রথম বাঙালি হিসেবে বিখ্যাত হয়েছিলেন রামনাথ এবং সঠিকভাবেই তিনি প্রথম বাঙালি বিশ্বপর্যটক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। তার সাইকেল ভ্রমণ বিদেশেও বিখ্যাত হয়েছিল, তিনি একজন হিন্দু পর্যটক হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিলেন। সমসাময়িক মানুষ তাকেই প্রথম বিশ্বপর্যটক বলে মনে করত। কোনও সন্দেহ নেই যে, তার ভ্রমণবৃত্তান্তই প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। বিমল ভ্রমণ করেছিলেন এক সফরেই— ১৯২৬ সালে কলকাতা ত্যাগ করে ১৯৩৭ সালে ফিরে আসেন। অন্যদিকে রামনাথ ১৯৩১ থেকে ১৯৪০ সময়কালে তিনবার বিশ্বভ্রমণে বেরিয়েছিলেন এবং এসব ভ্রমণের মধ্যবর্তী সময়ে তিনি বাড়িতেও ফিরেছিলেন। রামনাথ ছিলেন একজন দক্ষ লেখক। অন্যদিকে বিমল মাত্র একটি বই লিখেছিলেন। রামনাথ অনেক বই লিখেছিলেন এবং ভ্রমণরত অবস্থাতেই তিনি বাংলা সাময়িকীতে কলাম লিখতেন।

রামনাথ যে দেশেই যেতেন, সেখানকার ইতিহাস ও সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে তার আগ্রহী পর্যবেক্ষণ ছিল। তিনি যখন কোরিয়া ভ্রমণ করেছিলেন তখন সেখানে জাপানের শাসন চলছে। তিনি তার লেখায় জাপানি, চীনা ও কোরীয়দের মধ্যে জটিল সম্পর্কের বিবরণ দিয়েছেন। তিনি উপন্যাসও লিখেছেন। তার লেখা উপন্যাস আগুনের আলো বেশ কয়েকটি মহাদেশের প্রেক্ষাপটে লেখা হয়েছে। উত্তর আমেরিকায় গল্প শুরু হয়ে ব্রিটেন হয়ে এশিয়ার মালয়ে এসে কাহিনী শেষ হয়েছে। তার আরেকটি উপন্যাস আমেরিকান নিগ্রো লেখকের নিজের জবানিতে লেখা।

বিশ শতকের প্রথমার্ধে বাঙালির অনুসন্ধানী চেতনার উদাহরণ হয়ে আছেন রামনাথ বিশ্বাস ও বিমল মুখার্জী।

ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর: এসএম রশিদ
সৌজন্যে : বণিক বার্তা

আপনার মন্তব্য

আলোচিত