রাশিদা আক্তার

১৭ অক্টোবর, ২০১৭ ০১:০৮

সাদা যাদুর দেশে

আটলান্টিক মহাসাগরের হ্রদ দিয়ে ঘেরা পশ্চিম আফ্রিকার একটি ছোট  দেশ টোগো; আয়তন ৫৭০০০ বর্গ কিলোমিটার এবং জনসংখ্যা প্রায় ১ কোটির কাছাকাছি। ভাষা মুলত ফ্রেন্স তবে ছোট ছোট জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা রয়েছে। টোগোর ইতিহাসে দেখা যায় ১৬ শতক থেকে ১৮ শতক পর্যন্ত টোগোর সমুদ্র তীরবর্তী এলাকাগুলো ছিল ইউরোপিয়ানদের দাস ব্যবসার প্রধান কেন্দ্র।

তাই টোগোকে বলা হত “the slave coast”. ১৯৬০ সালে ফ্রান্স কলোনির পরাধিনতা থেকে স্বাধিনতা লাভ করে দেশটি । স্বাধীনতা পরবর্তী টোগোর রাজনৈতিক নেতৃত্ব বেশ চোখে পরার মত। ১৯৬৭ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত চলে মিলিটারি শাসন, দেশটির প্রেসিডেন্ট হন গেমিংবে এইদেসা, তিনি ৩৮ বছর শাসন করেন। এরপর ২০০৫ সালে  তার মৃত্যুর পর তার ছেলে নির্বাচিত হন, যিনি বর্তমান প্রেসিডেন্ট।

টোগো দরিদ্র দেশ, সেটা বোঝার জন্য খুব বেশিদূর যেতে হয় না, রাজধানী  লোমে-র বড় রাস্তা পেরিয়ে আশেপাশের এলাকায় প্রবেশ করলেই মনে হত শহরটি যেন গ্রামের বর্ধিত অংশ।  টোগো ভ্রমন করেছি এ বছর জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে একটি গবেষণা সম্পর্কিত কাজের প্রয়োজনে। রাজধানি লোমে খুব জমজমাট শহর যদিও অধিক ঘনবসতি চোখে পরেনা। সন্ধ্যা নামলেই ভীর জমে খোলা খাবারের দোকান এবং অন্যান্য দোকান  গুলোতে। মানুষ মেতে ওঠে গানের তালে। গরিব দেশ কিন্তু জীবন বোধের চর্চা ছিল উপভোগ করার মত।

এখানে একদিকে ফ্রান্স কলোনির পরিত্যাক্ত  সংস্কৃতির অনেক কিছুই চোখে পরে তাদের ভাষা, খাদ্য, এবং সাজ পোশাকে, অপরদিকে ভারতীয় হিন্দি গান এবং চলচিত্রের অভিগমন শুরু হয়েছে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে। আবার ‘আফ্রিকান নেশন কাপ’ খেলায় জাতীয়তা বোধের নেশায় মেতে উঠেতে দেখেছি পুরো শহরের মানুষকে। আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে তাদের দৈনন্দিন জীবনে, হাতে মোবাইল ফোন, কানে হেডফোন লাগিয়ে দুলতে দুলতে হাঁটছে যেমন, মটর গাড়ির ব্যাবহার ও চোখে পরার মত। এসব কিছুর ভেতরেও যে বিষয়টি নজর কারে তা হোল বিশ্বাসের সুতোয় বোনা আফ্রিকান সংস্কৃতি, যার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে ফেতিস মার্কেট, যা ভুডু মার্কেট নামে পরিচিত। টোগো-র রাজধানির বুকে এই মার্কেটটি পৃথিবীর সব চাইতে বড় এবং পুরনো ভুডু মার্কেট। এটি আফ্রিকান উপমহাদেশের  তীর্থস্থানের সাথে তুলনা করা হয়। টোগোর এই ফেতিস মার্কেট শুধু টোগোলিজদের জন্য নয়, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষের আনাগোনা রয়েছে এই মার্কেটে ।

ফেতিস কি? বিভন্ন লেখক এবং গবেষক এর নানা রকম ব্যাখ্যা দিয়েছেন । তবে সব বিশ্লেষণের মুল যে ধারনা তা হল- ফেতিস একধরনের বস্তুতে অথবা প্রাণিতে ভক্তি যা ভুডু ধর্মের আনুষ্ঠানিকতায় কার্যকরী হয়ে ওঠে। সাধারন টোগোলিজদের মতে ফেতিস হল ‘সাদা যাদু’ । ‘সাদা যাদু’ শান্তি ও কল্যান বয়ে আনে যেখানে ‘কালো জাদু’ মানুষ ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর। ফেতিস শব্দটির সাথে আমি প্রথম পরিচিত হয়েছিলাম  এলেক্স হেলি-র রুটস বইটির মাধ্যমে (Roots, Alex Haley-1991) । বইটি তে বর্ণনা করা হয়েছে বন্দি দাসদের ফেতিস এর প্রতি বিশ্বাস আর ভক্তির কথা । মুক্তির জন্য দাসেরা আশ্রয় খুজত ‘ফেতিস’-এ । কখনও এই ফেতিস ছিল পাখির পালক, কখনও পাথর।  ফেতিস এর প্রতি এই বিশ্বাস একাকার হয়ে ছিল ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে। তাই যখন টোগো ভ্রমন করি একজন নৃবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হিসাবে এ ইতিহাসের বাস্তবতা দেখার আগ্রহটা একটু বেশিই ছিল। চলে গেলাম ফেতিস মার্কেটে।

প্রথমে তীব্র গন্ধের কারনে খুব কষ্ট হচ্ছিলো নিঃশ্বাস নিতে, কারণ ফেতিস মার্কেট এ বিভিন্ন জীবজন্তু যেমন, চিতা, হরিন, গরিলা, কুকুর, সাপ, পাখি এবং বিভিন্ন রকম সরীসৃপের  মাথা, চামড়া,  দাঁত রাখা হয়েছে।

ইতিহাস বলে যে অতিতে মানুষের কঙ্কালও পাওয়া যেত এই মার্কেটে যা বর্তমানে দেখা যায় না। এই মার্কেটে বিভিন্ন ধরনের ফেতিসের সরবরাহ করা হয়/ সংগ্রহ করা হয়। যতদূর ধারনা করা হয় এসব জীবজন্তুকে শিকার করে আনা হয় আফ্রিকার  বিভিন্ন এলাকা থেকে এবং পরে মেরে শুকানো হয়। যদিও ওখানকার দায়িত্বে যারা রয়েছেন তারা সেটি স্বীকার করেন না। কারণ এখান থেকে বেশ মোটা অংকের আয় হয় যা সরকারি খাতায় জমা হয়।

ফেতিস এর  দুটো প্রধান ব্যবহারিক দিক রয়েছে। প্রথমত মানুষের বিশ্বাস এবং দ্বিতীয়ত চিকিৎসা ব্যবসস্থায়। বিশ্বাস ব্যবস্থায় মানুষ সাদা যাদুর আশ্রয় নেয় নানা কারনে, যেমন ফসলের বৃদ্ধি, দাম্পত্য সম্পর্ক উন্নয়ন, ভালবাসার মানুষকে বশ মানান, কালো যাদুর শক্তি বিনাশ করা, নিরাপদে ভ্রমণ, ঋণ মুক্তি সহ নানা ধরনের উপকারের আশায়। অপরদিকে চিকিৎসা ব্যবস্থায় শুধু প্রাথমিক  চিকিৎসা নয়, সর্ব রোগের চিকিৎসা হয় ফেতিস এ।

বন্ধ্যা নারীর সন্তান হওয়া, পুরুষের যৌন রোগের চিকিৎসা কিংবা মানসিক রোগের চিকিতসায় ও ফেতিসের খ্যাতি রয়েছে।  প্রথাগত ওঝা আছেন ঝারফুঁক করেন এবং মন্ত্র পড়েন চিকিৎসা দেয়ার সময়।

ফেতিস কিভাবে কাজ করে: ফেতিস বুঝতে হলে ভুডু ধর্ম বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। ভুডু পশ্চিম আফ্রিকার একটি প্রধান ধর্ম । এই ধর্মীয় প্রথায় বিভিন্ন জীবিত বা মৃত প্রাণী যা ফেতিস রূপে পবিত্র হয়ে ওঠে। ট্রিনিটি কলেজের একজন প্রফেসর বলেছিলেন ভুডু শুধু বিশ্বাস ব্যবস্থা নয়, এটি একটি জীবনযাত্রার ধরন (Leslie Desmangles, 1996)।  

ভুদু ধর্মের উৎপত্তি আফ্রিকানদের প্রথাগত ধর্ম আর খ্রিষ্টান ধর্মের মিশ্রণে (syncretic religion)। ১৬৮৫ সালে একটি আইন করে আফ্রিকান দাসদের ধরে আনার ৮ দিনের মধ্যে খ্রিষ্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করার নীতি পাশ হয়। এ আইনে আফ্রিকানদের প্রথাগত ধর্ম পালন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। তাই নিরুপায় হয়ে আফ্রিকান দাসেরা তাদের নিজস্ব ধর্মের নানা প্রথা পালন করত খ্রিষ্টান আচার প্রথার সাথে। এভাবেই ভুডু ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে। ভুডু আচার প্রথায় একদিকে প্রাণী উৎসর্গ যেমন রয়েছে, তেমনি এর আরেকটি দিক হল অঙ্কন শিল্প এবং নৃত্য শিল্প। এই তিনের মাধ্যমেই ধারন করা হয় ফেতিস কে।

আজ আর দাসপ্রথা নেই, নেই ধর্ম ছিনিয়ে নেয়া প্রভু। তবুও ভুডু এবং ফেতিস এর উপর বিশ্বাস এর চর্চা রয়েছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।  প্রতিবছর বিখ্যাত ভুডু নাচের আয়োজন করা হয় টোগোর এই ফেতিস মার্কেটে । তাই চিকিৎসা কিংবা যাদু ছাড়াও এখানে বিক্রি করা হয় ঘোড়া এবং কুকুরের লেজ যা বিখ্যাত ভুডু নাচের সময় ব্যাবহার করা হয়। তাই বলা যায়, মানুষ যেখানে নিরুপায় বিশ্বাস সেখানে প্রবল।

এভাবেই সাদা যাদু দরিদ্র টোগোলিজদের চিকিৎসা ব্যবস্থা, ধর্মীয় এবং সামাজিক- সংস্কৃতিক জীবনের অবিছেদ্য অংশ হিসাবে মিশে রয়েছে যুগ যুগ ধরে।  

লেখক: গবেষক ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়

আপনার মন্তব্য

আলোচিত