রিপন দে, মৌলভীবাজার

০৮ এপ্রিল, ২০১৯ ২১:৩৩

রোমাঞ্চকর কালা পাহাড় ভ্রমণ

যারা টেকিং (পাহাড়ে উঠা) পছন্দ করেন তারা যখন একটি পাহাড় থেকে ফিরে আসেন তখনই মনে মনে আরেকটি ট্রেকিংর জায়গা খুঁজতে থাকেন। কয়েকদিন গেলে ভেতরে ভেতরে আফসোস জাগে "আহারে! কবে যাব পাহাড়ে" । ১৫ দিন আগেই ঠিক ছিল আমরা যাচ্ছি বাংলাদেশের অন্যতম উচ্চতার পাহাড় "কালা পাহাড়ে" । কিন্তু এই কয়টা দিন অপেক্ষা করাটাই ছিল কষ্টের।

অবশেষে কালা  পাহাড়ের র্সবোচ্চ চূড়ায় উঠেতে পেরে আমাদের ১৫ সদস্যের দলের সবাই আনন্দে পরিপূর্ণ।

মৌলভীবাজারে কুলাউড়া উপজেলার কর্মধা ইউনিয়নের কালা পাহাড় উচ্চতায় এক হাজার ১০০ ফুট। এই পাহাড়ের ৬০ শতাংশ বাংলাদেশে পড়েছে,বাকি অংশ পড়েছে ভারতের উত্তর ত্রিপুরা। এর সর্বোচ্চ বিন্দু থেকে দেশের সর্ববৃহৎ হাওর যাকে মিনি কক্সবাজার বলা হয় সেই হাকালুকি হাওরের নীল পানি দেখা যায়। 

কালা পাহাড়কে স্থানীয় ভাষায় লংলা পাহাড় নামে ডাকা হয়। বাংলাদেশ জিওগ্রাফিক সোসাইটির মতে, কালা পাহাড়টি ‘হারারগঞ্জ পাহাড়’ নামেও পরিচিত। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় অবস্থান করা বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা এখানে আসে এক্সট্রিম অ্যাডভেঞ্চারাস ট্রেকিং ট্রেইলের ট্রিপ দেওয়ার জন্য। আরো আছে অপূর্ব সুন্দর আজগরাবাদ চা বাগান। মোটকথা একদিনে এক্সট্রিম ট্রেকিংয়ে জন্য এরচেয়ে আদর্শ জায়গা আর হতেই পারে না।

 এখানে খাসিয়া জাতি-গোষ্ঠীর মানুষ প্রায় সবাই খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। প্রায় ৫শ’ পরিবার নিয়ে সীমান্তবর্তী বেগুনছড়া, পুঁটিছড়া, লবণছড়া পুঞ্জির লোকজনের বসবাস। আশপাশে আরো বেশ ক’টি খাসিয়া পুঞ্জি রয়েছে। এখানকার মানুষের আয়ের প্রধান উৎস হচ্ছে পান চাষ।  ভারতের বিখ্যাত প্রাচীন পত্নতাত্ত্বিক লল ধর্মীয় স্থান ঊনকোটি এই পাহাড়টির পাদদেশে অবস্থিত।

কুলাউড়া শহর থেকে  কালা পাহাড়ের দূরত্ব আনুমানিক ৩৫ কি.মি.। প্রথমে যেতে হবে  আজগরাবাদ চা বাগানের গেইটে সেখান থেকে প্রায় ৪০ মিনিট পায়ে হেঁটে পৌঁছাতে হবে বেগুন ছড়া খাসিয়া পুঞ্জিতে। সেখান থেকে পুন্জির মন্ত্রী (হেডম্যান) কে বলে গাইড নিয়ে ৩ থেকে সাড়ে তিন ঘন্টার ভেতরে পৌছে যাবেন কালা পাহাড়ের সর্বোচ্চ চূড়ায়।

আজগরাবাদ চা বাগান থেকে বেগুনছড়া পুঞ্জি যাওয়ার পথে ফানাই নদীসহ আরো ৮ টি পাহাড়ি বড় খাল পাওয়া যায়। বাঁশের সাঁকো দিয়ে যাবার সময় পাহাড়ি উচুনিচু পথে অন্যরকম ভাললাগা কাজ করে । যতটা সামনে এগিয়ে যাবেন বুঝতে পারবেন প্রকৃতি আপনাকে স্বাগত জানানোর জন্য দুই হাত প্রসারিত করে অপেক্ষা করছে ।

বেগুনছড়া পুঞ্জি থেকে কালা পাহাড় যাবার পথে আপনি উপভোগ করবেন অন্যরকম এক্সট্রিম অ্যাডভেঞ্চার। কখনো ঝিরি পথে কখনো খাড়া পাহাড়ি পথে ঘন জঙ্গলের দিয়ে এগোতে থাকবেন। হাটতে হাটতে পথে দেখা পাবেন হাতির মলের , ভাগ্য ভাল থাকলে হাতির দেখাও পেতে পারেন। স্থানীয়দের মতে একসময় প্রচুর হাতি ছিল যা বর্তমানে নেই। ভারত সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া থাকায় বন্যহাতিরা এই এলাকায় এখন আর আসেনা।  তবে প্যেষ্য হাতিদের বিচরণ আছে এখানে। নানা রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা পেতে পেতে ৩ থেকে সাড়ে ৩ ঘণ্টা হাটার পর আপনি পৌঁছে যাবেন কালা পাহাড়ের স্বচ্ছ চুড়ায়।

পাহাড়ের চুড়া থেকে এই পথেই আবার ফিরতে পারেন তবে পূর্নাঙ্গ অভিজ্ঞতা পেতে এবং আপনি ট্রেকিং প্রিয় হলে কালা পাহাড়ের উল্টো দিকে মুড়াইছড়া ইকোপার্ক হয়ে জুড়ী উপজেলায় ফুলতলা হয়ে বের হতে পারেন। এ ক্ষেত্রে আগেই গাইডকে বলতে হবে কারণ সব গাইড এই রাস্তা চিনে না।

যেহেতু কালা পাহাড়ের একটি অংশ ভারতে এবং পাশেই সীমান্ত তাই ভূল পথে গেলে বড় বিপদ হতে হবে। গাইডের কথার বাইরে এক পাও এগুনো যাবেনা এবং দলছুট হওয়া যাবেনা।   আমরা আগেই ঠিক করে  রেখেছিলাম কালা পাহাড় থেকে আমরা উল্টো পথে জুড়ী উপজেলার ফুলতলা হয়ে বের হব । সেভাবেই আমরা ট্রেকিং করি । এই পথে মানুষ কম যায় তাই সম্পর্ন নতুন এক অভিজ্ঞতা হবে।

প্রায় ৪ থেকে সাড়ে ৪ ঘন্টার রাস্তা পুরু রাস্তাটাই চ্যালেঞ্জিং, পরতে পরতে এডভ্যঞ্জার। কোথাও একেবারে খাড়া হয়ে নামতে হবে আবার কোথাও একবারে খাড়া পাহাড়ি পথে উঠতে হবে। তার উপর প্রচুর ঝিরি পথ এবং পাহাড়ি ছড়া এবং বাশ বাগানের ভেতর সরু খাড়া রাস্তায় বাঁশের শুকনো পাতার ১/২ ফুট প্রলেপ। খাড়া রাস্তায় বাঁশের পাতায় পা দিয়ে মাঝে মাঝে ৪/৫ হাত জায়গা গড়িয়ে চলে যাবেন। অর্থাৎ প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন  অ্যাডভেঞ্চার আপনার ভালোলাগাকে দ্বিগুণ করে দেবে।


এভাবে আমাদের ১৮ জনের দল কালা পাহাড় থেকে মুড়াইছড়া ইকোপার্কের  ভারত সীমান্তবর্তী জুড়ী উপজেলার রাজকি চা বাগন দিয়ে বের হয়ে লোকালয়ের দেখা পেলাম সামনে সবুজ মাঠ। তখন কারো পা চলছিল না সবাই তখন ক্লান্ত,  এই লম্বা ট্রেইলে আমরা কোথাও একটু বিশ্রাম করতে পারিনি কারন সাড়া পথেই প্রচুর জোঁক যার কারনে কোথাও বাসার সুযোগ ছিলনা। তাই এই মাঠের সবুজ ঘাসকেই মনে হয়েছে সবচেয়ে নিরাপদ বিছানা। সেখানে আমরা ২০ মিনিট বিশ্রাম নিই। সেখান আমরা জুড়ীর ফুলতলা বাজারে পৌঁছে  ফিরতি বাসে যার যার গন্তব্যে চলে এলাম।

রোমাঞ্চকর এই কালা পাহাড় এবং সেখান থেকে মুড়াইছড়া ইকোপার্ক বিচরন করে লোকালয়ে ফেরার স্মৃতি দীর্ঘদিন আনন্দের সাথে মনে থাকবে। তবে সুন্দর এই পাহাড় ভাল নেই মানুষের থাবা থেকে। এত বড় দূর্গম এলাকা তবুও বনের ভেতরে পুরাতন গাছ তেমন একটা নেই। পথে পথে প্রচুর পোষ্য হাতির মল থেকে সহজেই বুঝা যায় গাছ চোরেরা এখানে সক্রিয় এবং তারা হাতি দিয়ে গাছ বহন করে।

এখানে পর্যটনের জন্য সরকারী কোন উদ্যোগ নেই এমনকি একটা সাইবোর্ড পর্যন্ত নেই যেখানে অন্তত জায়গার নামটি লেখা থাকবে। নেই প্রশিক্ষিত কোন গাইড।

যেভাবে যাবেন: ঢাকা থেকে সরাসরি কুলাউড়াগামী ট্রেন এবং বাস পাওয়া যায়। প্রথমে কুলাউড়া থেকে নেমে গাড়িযোগে রবিরবাজার হয়ে আসগরাবাদ চা বাগানে যেতে হবে। লোকাল গাড়িতে গেলে চল্লিশ টাকার মতো খরচ পড়বে। রিজার্ভ করলে ৩-৪শ’ টাকা। এরপর বেগুনছড়া পুঞ্জির মন্ত্রীর কাছ থেকে স্থানীয় গাইড নিয়ে  পাহাড় আরোহন করে পৌঁছে যাবেন কালা পাহাড়ের চূড়ায়।

সর্তকতা: পাহাড়ি পথে হাটার প্রস্তুতির জন্য মানসিকতার পাশাপাশি ট্রেকিং উপযোগী পোষাক এবং জুতা নিতে হবে । অবশ্যই এনার্জি ধরে রাখার ব্যাপারে খোয়াল রাখতে হবে।

১. প্রচুর পানি (অন্তত ২.৫ লিটার। ১/১.৫লিটার করে দুইটা নিতে পারেন)
২.পাওয়ার ব্যাংক
৩. গামছা/ক্যাপ/ছাতা
৪. ট্রেকিং স্যান্ডেল/শু
৫. গ্লুকোজ/স্যালাইন/এনার্জি ড্রিংক্স

আপনার মন্তব্য

আলোচিত