জাহিদুর রহমান তারিক, ঝিনাইদহ থেকে

২৩ জুলাই, ২০১৬ ১৩:২২

র‍্যাবের ‘নিখোঁজ’ তালিকায় মৃত ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী, ঝিনাইদহে বিভ্রান্তি

ঝিনাইদহে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে দেশব্যাপী অনুসন্ধান চালিয়ে র‌্যাবের করা নিখোঁজ ২৯ ব্যক্তির নামের তালিকা নিয়ে। র‌্যাবের তালিকায় নিহত, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও বাড়ি ফিরে আসা ব্যক্তিদের নাম রয়েছে। বৃহস্পতিবার র‌্যাবের তালিকা নিয়ে জেলাব্যাপী অনুসন্ধান করে এ তথ্য মিলেছে। র‌্যাব সদর দপ্তর থেকে প্রকাশিত তালিকায় দুইজন নিখোঁজ থাকার প্রমাণ মিলেছে।

এরা হলেন ঝিনাইদহ শহরের উপশহরপাড়া মসজিদের মুয়াজ্জিন সোহেল রানা ও সদরের হলিধানী গ্রামের রাশেদুজ্জামান রোজ। তবে পুলিশের নিখোঁজের তালিকায় সোহেল রানা থাকলেও রোজ নেই।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, র‌্যাবের তালিকায় ঝিনাইদহ পৌর এলাকার চরখাজুরা গ্রামের দেলোয়ার হোসেন দুলাল (৩০) ও একই গ্রামের গোলাম আজম পলাশ (৩২) এর নাম রয়েছে। অথচ ২০১৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি সদর উপজেলার ডেফলবাড়ি গ্রামের মাঠে এই দুই যুবকে কে বা করা গুলি করে হত্যা করে। পরিবারের ভাষ্যমতে ডিবি পুলিশ পরিচেয়ে এই দুই যুবককে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর থানায় জিডি করা হয়।

এ দিকে র‌্যাবের তালিকায় বাড়ি ফিরে আসা, বিদেশে চাকরী করা ও প্রতিবন্ধীদের নামও পাওয়া গেছে। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিচয় দিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া জেলার নিখোঁজ থাকা ১০ ব্যক্তির নাম ওই তালিকায় নেই। র‌্যাবের তালিকায় ৬২ নং ক্রমিকে সোহেল ও ৬৩ নং ক্রমিকে মামুন রায়হান নামে দুই প্রতিবন্ধীর নাম রয়েছে।

মামুনের বোন জেসমিন ও সোহেলের বোন শারমিন জানান, প্রতিবন্ধী হওয়ার কারণে প্রায় তারা হারিয়ে যেত। এ জন্য থানায় জিডি করা হয়েছিলো।

তথ্যানুসন্ধান করে জানা গেছে, র‌্যাবের তালিকায় থাকা কালীগঞ্জ উপজেলার হেলাই গ্রামের মাজেদুল হক (৩৫), দাদপুর গ্রামের আবু সাইদ ও বলরামপুর গ্রামের মো. হাসান আলী (৩০) নিখোঁজ না। তালিকা প্রকাশের আগ থেকেই তারা বাড়িতেই আছেন।

তিনজনের পরিবারের সাথে কথা বলে জানা গেছে, রাগারাগি ও অভিমান করে তারা বাড়ি থেকে চলে গেলে থানায় জিডি করা হয়। হয়তো সেই জিডির ভিত্তিতে এই তালিকা হয়েছে, যোগ করেন তারা। ২০৬ নং ক্রমিকে মহেশপুরের গোয়ালহুদা গ্রামের বাপ্পি ও ২৩২ নং ক্রমিকে একই গ্রামের ওয়াফিলকেও বাড়ি পাওয়া গেছে।

ওয়াফিলের বাবা ইয়াকুব হোসেন জানান, ১১ বছর বয়সে তার ছেলে ও বাপ্পি নামে তার এক বন্ধু নিখোঁজ হয়ে যায়। পরে জানতে পারি ইংরেজি পরীক্ষা ভাল না হওয়ার কারণে বাপ্পি ও ওয়াফিল ৬ দিন পালিয়ে ছিল। এ ঘটনায় আমি থানায় জিডি করি। ৩ বছর পর র‌্যাবের করা তালিকা দেখে তিনি বিস্মিত হয়েছেন বলে জানান।

ইয়াকুব আরো জানান, ২/৩ দিন আগে মহেশপুর থানার ওসি তাকে ডেকেছিলেন। আমি সেখানে সব বলে এসেছিলাম। এখন র‌্যাব অফিস থেকে ফোন করে দেখা করার কথা বলা হচ্ছে।

হরিণাকুন্ডু উপজেলার কাচারিতোলা গ্রামের ছব্দুল হোসেন জানান, তার জামাই মো. মতিয়ার রহমান (৩০) মেয়ের সাথে রাগ করে সাগান্না গ্রামে তার নিজ বাড়ি চলে যায়। আমি বিপদের কথা ভেবে থানায় জিডি করি। র‌্যাব আমার বাড়িতে তদন্ত করতে আসে। আমি বলি পারিবারিক ঝামেলার কারণে আমি জিডি করেছিলাম। র‌্যাব চলে যাওয়ার ৩ দিনের মাথায় দেখি তালিকায় আমার জামাইয়ের নাম।

একই উপজেলার আদর্শ আন্দুলিয়া গ্রামের আকাশ জানান, তার ভাই র‌্যাবের তালিকায় থাকা ৮১ নং ক্রমিকের মো. শফিকুল ইসলাম বিদ্যুৎ এক বছর ধরে নিখোঁজ ছিলেন। পরে সে বাড়ি ফিরে আসে।

ঝিনাইদহ সদর উপজেলার পদ্মাকর ইউনিয়নের সাবেক মেম্বর আইয়ূব হোসেন জানান, তার এলাকার কাশিপুর গ্রামের মোঃ শামীম আলী (২৬) ও মো. মোজাম্মেল মোল্লা (২৮) কে র‌্যাব খুঁজতে এসেছিলো। কিন্তু তারা কেও নিখোঁজ না। শামিম বাড়িতে আছে আর মোজাম্মেল বিদেশে চাকরী করে। তিনি জানান, মোজাম্মেল ঝিনাইদহ শহরের হামদহ থেকে অপহরণ হয়েছিলো। পরে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে। এ ঘটনায় আমরা জিডি করি।

র‌্যাবের তালিকায় শৈলকূপার নিখোঁজ থাকা ৮ জনের মধ্যে সবাই বাড়িতে আছেন, কেউবা আছেন বিদেশে।

শৈলকূপার হুদা মাইলমারী গ্রামের আমিজ উদ্দীন জানান, তার ছেলে মাসুমকে সন্ত্রাসীরা ধরে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় আমি জিডি করি। পরে আমার ছেলে ফিরে আসে। একই উপজেলার চরআউশিয়া গ্রামের নাইমের নাম র‌্যাবের তালিকায় ৮৪ নং ক্রমিকে রয়েছে। কিন্তু তার পরিবারের ভাষ্য নাইম বিদেশে চাকরী করছে। শৈলকূপার সাতগাছি গ্রামের মো. মজিবর খা (২৮) বোয়ালিয়ার উজ্জল, ওয়াসিম আকরাম (২৫), উমেদপুরের মো. রবিউল ইসলাম (২৫), বাজারপাড়ার মো. রফিকুল ইসলাম (২২) ও কৃষ্ণপুর গ্রামের মোঃ তোতা (২৫) মিয়া নিখোঁজ না বলে তাদের পরিবার থেকে জানানো হয়েছে।

গান্না ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান জানান, র‌্যাবের তালিকায় নিখোঁজ থাকা কালুহাটী গ্রামের মো. আশিকুর রহমান রিপন (২৪) ও আক্তারুজ্জামান বাড়িতেই আছেন। ২০১৫ সালের অক্টোবর মাসে এরা নিখোঁজ থাকার কারণে জিডি করা হয়।
এদিকে ঝিনাইদহের বিভিন্ন গ্রাম থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিচয় দিয়ে নিয়ে যাওয়া ১০ জন নিখোঁজ রয়েছেন। দীর্ঘদিনেও তাদের কোন সন্ধান মেলেনি।

নিখোঁজ থাকা ব্যক্তিরা হলেন, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার ষাটবাড়িয়া মসজিদের ইমাম আব্দুল হাই (৩৫), ঝিনাইদহ সদর উপজেলার চাপড়ী গ্রামের দশম শ্রেণীর ছাত্র হাসান আলী, ঝিনাইদহ সদর উপজেলার পাগলাকানাই ইউনিয়নের কোরাপাড়া বটতলা এলাকার হোসেন আলী মোল্লার ছেলে যুবলীগ কর্মী জাহিদ ওরফে কোবরা জাহিদ, শৈলকূপা উপজেলার চরফুলহরি গ্রামের আমিরুল ইসলাম মণ্ডলের ছেলে শাহিন হোসেন পরশ, শহরের আদর্শপাড়া কচাতলার আবুল কালাম আজাদের ছেলে মাদ্রাসা ছাত্র আব্দুর রব, ঝিনাইদহ শহরের সোনালী পাড়ার সাবেক সেনা সদস্য কওছার আলী, তার দুই ছেলে বিনছার আলী ও বেনজির আলী, আরাপপুর চানপাড়ার মাদ্রাসার শিক্ষক শাহ আলমের ছেলে আজমুল হুদা ও কালীগঞ্জ উপজেলার ষাটবাড়িয়া গ্রামের আকরামের ছেলে। তাকে ঢাকার খিলগাঁও এলাকার জনৈক মাহবুবের বাসা থেকে র‌্যাব পরিচয় দিয়ে নিয়ে যায়।

জেলাব্যাপী নিখোঁজ থাকা ব্যক্তিদের তালিকা নিয়ে ঝিনাইদহ পুলিশ সুপার আলতাফ হোসেন এ প্রতিবেদককে জানান, বিভিন্ন সময় জেলায় ২৪ জন নিখোঁজের খবর তাদের কাছে ছিল। কিন্তু নিখোঁজ থাকা সবাই বাড়ি ফিরে এসেছে। কেউবা বিদেশ গেছে চাকরী করতে। সর্বশেষ পুলিশের পক্ষ জেলা ৪ জন নিখোঁজ থাকার কথা বলা হচ্ছে।

এরা হলেন মসজিদের মুয়াজ্জিন সোহল রানা, শৈলকূপার উজ্জল, মজেদুল ও তোতা মিয়া। তবে সোহেল রানা ব্যতিত বাকী তিনজনের সর্বশেষ তথ্য পুলিশের কাছে নেই।

তালিকা নিয়ে র‌্যাবের একটি সূত্র জানায়, বিভিন্ন সময় ঝিনাইদহের বিভিন্ন থানায় করা জিডির ভিত্তিতে নিখোঁজের এ সব তালিকা করা হয়েছে। হারিয়ে বা রাগ করে বাড়ি ছাড়া ব্যক্তিরা ফিরে আসার কারণে নিখোঁজের তালিকা এখন হাল নাগাদ করে দেখা হচ্ছে বলেও সূত্রটি জানায়।

র‌্যাবের করা তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, জেলার ২৯ জন নিখোঁজের মধ্যে ২ জন নিহত হয়েছেন। ২ জন প্রকৃত নিখোঁজ আছেন। বাকী ২৫ জনের মধ্যে কেও বিদেশে আবার কেও বাড়িতে রয়েছেন।

উল্লেখ্য, র‌্যাবের অনলাইন মিডিয়া সেলের ফেসবুক পাতায় গত মঙ্গলবার (১৯ জুলাই) রাত সোয়া ১১টার দিকে নিখোঁজ ২৬২ জনের তালিকা প্রকাশ করা হয়।  র‍্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়, এদের বিষয়ে কোনো তথ্য পেলে র‌্যাবের নিকটতম ক্যাম্পে জানাতে অনুরোধ করা হয়েছে। অথবা ০১৭৭৭৭২০০৫০ মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।

এছাড়া ফেসবুকে www.facebook.com/rabonlinemediacell/ এবং [email protected] অ্যাড্রেসে মেইল করে তথ্য জানানোর অনুরোধ করা হয়।

গত ১ জুলাই গুলশানে ক্যাফেতে হামলা চালিয়ে ১৭ বিদেশিসহ ২০ জিম্মিকে হত্যার পর কমান্ডো অভিযানে নিহত পাঁচ জঙ্গি বেশ কিছু দিন ধরে নিখোঁজ ছিলেন বলে তাদের পরিবারের ভাষ্য।

এর ছয়দিনের মাথায় ঈদের সকালে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় পুলিশের তল্লাশি চৌকিতে হামলা চালিয়ে নিহত আবীর রহমানও কয়েক মাস ধরে নিখোঁজ ছিলেন।

গুলশানে হামলাকারীদের তিনজন নিবরাস ইসলাম, মীর সামেহ মুবাশ্বের ও রোহান বিন ইমতিয়াজ এবং শোলাকিয়ায় হামলাকারী আবীর ছিলেন ঢাকার উঁচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। তাদের দুজনের নিখোঁজের তথ্য জানিয়ে কয়েক মাস আগেই থানায় জিডি করেছিল পরিবার।

এছাড়া ওই হামলার পর মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসের নামে একটি ভিডিও বার্তায় বাংলাদেশে আরও হামলার হুমকিদাতা তিন যুবকও বেশ কিছুদিন ধরে নিখোঁজ বলে পরিচিতরা জানান।

নিখোঁজ তরুণ-যুবকদের জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি প্রকাশের পর ঘরছাড়াদের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু হয়। এর প্রেক্ষিতে নিখোঁজদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে র‍্যাব এক তালিকা প্রকাশ করে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত