নিজস্ব প্রতিবেদক

৩০ আগস্ট, ২০১৮ ০০:৫০

আলতাফ মাহমুদের অন্তর্ধান দিবস আজ

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের এদেশীয় দোসরদের সহযোগিতায় আলতাফ মাহমুদকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট। পরে আর ফেরেননি এ সংগীতজ্ঞ।

আজ (৩০ আগস্ট) একুশের গানের অমর সুরকার শহীদ আলতাফ মাহমুদের ৪৭তম অন্তর্ধান দিবস। গান, কবিতা, স্মৃতিকথা ও পদক প্রদানের মাধ্যমে স্মরণ করা হবে দিনটিকে।

শহীদ আলতাফ মাহমুদ, অনেকের কাছেই ঝিলু নামে পরিচিত। একাধারে ছিলেন কবি, সুরকার এবং গীতিকার, সংগীত পরিচালক, নৃত্য পরিচালক, প্রযোজক। প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে যে গানটি গাওয়া হয়, সেই ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি' গানের সুরকার আলতাফ মাহমুদ।

১৯৩৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর বরিশাল জেলার মুলাদি উপজেলার পাতারচর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন গুণী এই ব্যক্তি। ১৯৪৮ সালে বরিশাল জিলা স্কুল থেকে তিনি মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা পাশ করে ভর্তি হন বিএম কলেজে। পরে তিনি চিত্রকলা শিখতে ক্যালকাটা আর্টস স্কুলে যান। প্রসিদ্ধ ভায়োলিন বাদক সুরেন রায়ের কাছে প্রথম সংগীতে তালিম নিয়ে তিনি গণসংগীত গাইতে শুরু করেন এবং প্রচুর জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।

১৯৫০ সালের দিকে তিনি ভাষা আন্দোলনের পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য বিভিন্ন জায়গায় গণসংগীত গাইতেন। গান গাওয়ার মাধ্যমে মাহমুদ এই আন্দোলনকে সর্বদাই সমর্থন যুগিয়েছেন।

১৯৫৩ সালের প্রভাত ফেরীতে আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো শিরোনামের আলোড়ন সৃষ্টিকারী গানটিতে প্রথম আলতাফ মাহমুদের সুরে একুশের গানটি গাওয়া হয়। ধরে নেওয়া হয় ১৯৫২ সালের শেষদিকে তিনি একুশের গানের সুর দিয়েছিলেন। এরপর ১৯৬৯ সালে 'জীবন থেকে নেয়া' চলচ্চিত্রের জন্য একুশের গানের শুরুতে হামিং সংযোজন করেন আলতাফ মাহমুদ।

১৯৭১ সালে আলতাফ মাহমুদ স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ক্র্যাক প্লাটুনের একজন সক্রিয় যোদ্ধা ছিলেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে তাঁর ঢাকার রাজারবাগের আউটার সার্কুলার রোডের নিজ বাসায় গোপন ক্যাম্প স্থাপন করেন। কিন্তু ক্যাম্পের কথা ফাঁস হয়ে গেলে ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট বাসা থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কিছু এ দেশীয় দোসরদের সহায়তায় চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে যায় তাঁকে। পরবর্তীতে আর খোঁজ মিলেনি তাঁর। আজও সবার অজানা কী নির্মমতার মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি!

আলতাফ মাহমুদকে হত্যার অভিযোগে যুদ্ধাপরাধী ও আল বদর নেতা আলী আহসান মুজাহিদের শাস্তি ঘোষিত হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে। ট্রাইব্যুনাল ও আপিল বিভাগের রায়ে মুজাহিদকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয় আলতাফ মাহমুদ সহ অন্যান্যদের নির্যাতন ও হত্যার কারণে। অপর অভিযোগ মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, এবং তা ইতোমধ্যেই কার্যকর হয়েছে।

আলবদর নেতা ও যুদ্ধাপরাধী আলী আহসান মুজাহিদের বিপক্ষে এ সংক্রান্ত অভিযোগে বলা হয়- মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সুরকার আলতাফ মাহমুদ, জহিরউদ্দিন জালাল, বদি, রুমি, জুয়েল ও আজাদকে আটক করে ঢাকার নাখালপাড়ায় পুরনো এমপি হোস্টেলে রাখা হয়। ৩০ আগস্ট রাত ৮টার দিকে পূর্ব পাকিস্তান ইসলামি ছাত্রসংঘের সেক্রেটারি মুজাহিদ ও সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী সেখানে গিয়ে এক সেনা কর্মকর্তাকে পরামর্শ দেন, রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আগেই তাদের হত্যা করতে হবে। এ সিদ্ধান্তের পর সহযোগীদের নিয়ে মুজাহিদ আর্মি ক্যাম্পে আটকদের অমানবিক নির্যাতনের পর জালাল ছাড়া বাকিদের হত্যা করেন।

১৯৭৭ সালে বাংলা সংস্কৃতি ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদান রাখার জন্য আলতাফ মাহমুদকে একুশে পদক দেওয়া হয় এবং সংস্কৃতি ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখায় শহীদ আলতাফ মাহমুদকে ২০০৪ সালে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করা হয়।

আলতাফ মাহমুদ পদক
আলতাফ মাহমুদকে স্মরণ রাখতে তাঁর পরিবার ও ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলাদের সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয় শহীদ আলতাফ মাহমুদ ফাউন্ডেশনের। এ ফাউন্ডেশন ২০০৫ সাল থেকে গুণীজনদের আলতাফ মাহমুদ পদক দিয়ে আসছে।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে ধারাবাহিকতা হিসেবে এবার নাট্যজন সৈয়দ হাসান ইমাম ও ফেরদৌসী মজুমদারকে সম্মাননা দেবে ফাউন্ডেশনটি।

৩০ আগস্ট সন্ধ্যায় শহীদ আলতাফ মাহমুদ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমীর সংগীত ও নৃত্যকলা ভবনে ওই দুই গুণীজনের হাতে আলতাফ পদক, সম্মানী এবং উত্তরীয় তুলে দেয়া হবে।

পদক প্রদান প্রসঙ্গে শহীদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা এবং ফাউন্ডেশনের সদস্য সচিব শাওন মাহমুদ জানান, শহীদ আলতাফ মাহমুদ ফাউন্ডেশন সম্পূর্ণ পারিবারিক এবং ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে গঠন ও পরিচালিত হয়ে আসছে। এবং ২০০৫ সাল থেকে এ ফাউন্ডেশন গুণীজনদের পদক দিয়ে আসছে। এর ধারাবাহিকতায় এবার আলতাফ মাহমুদ পদক দেওয়া হবে সৈয়দ হাসান ইমাম ও ফেরদৌসী মজুমদারকে।

উল্লেখ্য, ৩০ আগস্ট ২০০৫ তারিখে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে বিশিষ্ট চিত্রগ্রাহক বেবি ইসলামকে সম্মাননা প্রদানের মাধ্যমে শহীদ আলতাফ মাহমুদ ফাউন্ডেশন-এর যাত্রা শুরু হয় ।

এরপর ৩০ আগস্ট ২০০৬ তারিখে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে প্রখ্যাত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ড. এনামুল হক, ৩০ আগস্ট ২০০৭ তারিখে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে বাংলাদেশের অন্যতম সংগীতশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন, ৩০ আগস্ট ২০০৮ তারিখে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংগীতশিল্পী অজিত রায় এবং সঙ্গীত পরিচালক খোন্দকার নুরুল আলম, ৩০ আগস্ট ২০০৯ তারিখে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংগীতশিল্পী এবং বিশেষজ্ঞ সুধীন দাস, ৩০ আগস্ট ২০১০ তারিখে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠসৈনিক বিপুল ভট্টাচার্য, ২৩ ডিসেম্বর ২০১১ তারিখে শিল্পকলা একাডেমিতে উদীচী আয়োজিত শহীদ আলতাফ মাহমুদ এর জন্মদিন উদযাপন অনুষ্ঠানে ফাউন্ডেশন সংগীত পরিচালক আলম খান, ৩০ আগস্ট ২০১২ তারিখে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম এবং নায়ক রাজ রাজ্জাক, ৩০ আগস্ট ২০১৩ তারিখে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে চিত্রশিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার এবং সংগীত পরিচালক মো. শাহ্‌নেওয়াজ এবং ৩০ আগস্ট ২০১৪ তারিখে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী এবং সংগীত পরিচালক আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল-এর হাতে শহীদ আলতাফ মাহমুদ পদক তুলে দেওয়া হয়।

২০১৫ সালের ৩০ আগস্ট শহীদ আলতাফ মাহমুদ-এর ৪৪তম অন্তর্ধান দিবসে ওই বছরের আলতাফ মাহমুদ পদক পেয়েছিলেন কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক ও সংগীতপরিচালক আলাউদ্দীন আলী। ২০১৬ সালে এ পদক পেয়েছিলেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, এবং ২০১৭ সালের এ পদক পান নাট্যজন আলী যাকের এবং লেখক-প্রাবন্ধিক ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত