দোদুল খান

১৪ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:৩২

সংসদ নির্বাচন ২০০৮: সিলেটে আওয়ামী লীগের ভূমিধ্বস বিজয়

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে আসছে। নির্বাচন কমিশন ঘোষিত পুণঃতফশিল অনুযায়ী, ৩০ ডিসেম্বর হবে ভোটগ্রহণ। সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ১৯৯১ সাল থেকে মোট ৫টি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। কেমন ছিল সেসব নির্বাচন? সিলেট বিভাগের ১৯টি সংসদীয় আসনে কোন দল কোন আসন জিতেছিলো?

সেসকল তথ্য ও উপাত্ত নিয়ে সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকম এর ধারাবাহিক আয়োজন।

ফিরে দেখা: সংসদ নির্বাচন ২০০৮
২০০১ সালের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট ক্ষমতা আসে। ৮ম জাতীয় সংসদের মেয়াদ শেষ হয় ২৭ অক্টোবর ২০০৬ তারিখে এবং সে অনুযায়ী ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি ছিল ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের শেষ তারিখ।

কিন্তু রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং সে সময় একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন সংগঠনের কোন পরিস্থিতি ছিল না। রাজনৈতিক অন্তর্কোন্দল, আওয়ামী লীগের অসহযোগ আন্দোলন এবং ক্ষমতাসীন বিএনপির অসহনশীলতার কারণে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমদ ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেন এবং ১২ জানুয়ারি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফখরুদ্দীন আহমদ।

ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন করার কথা থাকলেও নানা রাজনৈতিক কারণে তা না করে এ সরকারের মেয়াদ দীর্ঘায়িত করা হয়।

এ পরিস্থিতির মধ্যে ২০০৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহম্মদ ইউনুস।

একই বছরের ৭ মার্চ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। তারপর ১৬ এপ্রিল খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোকে একই অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান প্রক্রিয়ার আওতায় দুর্নীতির বিভিন্ন অভিযোগে ১৬ জুলাই গ্রেপ্তার করা হয় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এবং ৩ সেপ্টেম্বর বিএনপির খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়।

ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশনকে সক্রিয় করে সারাদেশে ছবিসহ ভোটার তালিকার আইন ও বিধিমালা সংশোধন করে নতুন ভোটার তালিকা প্রণয়ন করে এবং ১৯৭২ সালের গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধন করে সকল রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করে। নতুনভাবে নিবন্ধিত ৩৯টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ৩৮টি দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয় ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন।

এ সময় জিওগ্রাফিক্যাল ইনফর্মেশন সিস্টেমের মাধ্যমে ৩০০টি সংসদীয় আসনের নতুন সীমানা নির্ধারণ করা হয়। পরে ২০০৮ সালের ২ নভেম্বর নির্বাচনী তফশিল ঘোষণা করা হয় এবং সে বছরের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সালের নির্বাচনে মোট ৩৮টি রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে এবং দলীয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থীসহ মোট ১৫৬৭ জন প্রার্থী অংশগ্রহণ করেন।

এ সকল রাজনৈতিক দলের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৬৪টি আসনে, বিএনপি ২৬০টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করে। এছাড়া অংশগ্রহণকারী বাকী দলগুলোর মধ্যে ১৬টি দল হয় আওয়ামী লীগের সাথে ১৪ দলীয় মহাজোট বা বিএনপির চার দলীয় ঐক্যজোটের অংশ হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে সীমিত সংখ্যক আসনে প্রার্থীতা ঘোষণা করে।
এ নির্বাচনে সারাদেশে ৩০০ আসনের ভোটগ্রহণের জন্য মোট ৩৫,২৬৩টি টি ভোটকেন্দ্রে ১,৭৭,২৭৭ টি ভোটকক্ষ স্থাপন করা হয় এবং মোট ৮,১০,৮৭,০০৩ জন ভোটারের মধ্যে ৭,০৬,৪৮,৪৮৫ জন ভোটার ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন যা মোট ভোটারের ৮৭.১৩ শতাংশ।

এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সংসদ গঠন করে এবং বিএনপি দ্বিতীয় অবস্থানে থেকে বিরোধী দল হিসেবে সংসদে অংশগ্রহণ করে।

৩০০টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৬৪টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করে ২৩০ টি আসনে (মোট ভোটের ৪৮.০৪ শতাংশ ভোট) জয়লাভ করে। বিএনপি ২৬০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করে ৩০ টি আসনে (মোট ৩২.৫০ শতাংশ ভোট) বিজয়ী হয়।

সিলেট বিভাগের নির্বাচনী অবস্থা
২০০৮ এর নির্বাচনে সিলেটের ১৯টি আসনের মধ্যে সুনামগঞ্জ জেলার ৫ টি আসনে ১১,০২,৬১১ জন ভোটার, সিলেট জেলার ৬টি আসনে ১৪,২৯,৯১৮ জন ভোটার, মৌলভীবাজার জেলার ৪টি আসনে ৮,৮০,৯৫৪ জন ভোটার এবং হবিগঞ্জ জেলার ৪টি আসনে ৯,৪৯,২৬৭ জন ভোটার ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন।

এ নির্বাচনে সিলেট বিভাগের ১৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৭টি আসনে এবং আওয়ামী লীগের জোটের শরীক জাতীয় পার্টি ২টি আসনে জয়লাভ করে। এ নির্বাচনে বিএনপি সিলেট বিভাগের কোন আসনে জয়লাভ করেনি।

সুনামগঞ্জ ১ (ধর্মপাশা, তাহিরপুর ও জামালগঞ্জ উপজেলা)
এ আসনে আওয়ামী লীগের মোয়াজ্জেম হোসেন রতন ১,৫৫,২৫২ ভোটে জয়লাভ করেন এবং তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির রফিক চৌধুরী ৯৪,৪৫৮ ভোট পান।

সুনামগঞ্জ ২ (দিরাই ও শাল্লা উপজেলা)
আওয়ামী লীগের প্রার্থী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এ আসনে নির্বাচিত হন এবং তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিএনপির মো. নাসির উদ্দিন চৌধুরী।

সুনামগঞ্জ ৩ (জগন্নাথপুর ও দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলা)
সুনামগঞ্জ ৩ আসনে টানা তিনবারের বিজয়ী আওয়ামী লীগের সাংসদ আবদুস সামাদ আজাদের মৃত্যুর পর এ আসনে নতুন প্রার্থী দেয় আওয়ামী লীগ। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এমএ মান্নান ১,৩৪,৫৫৯ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী চার দলীয় জোটের শরীক ইসলামী ঐক্যজোটের প্রার্থী মাওলানা শাহীনুর পাশা চৌধুরী ৫৬,৭৬৫ ভোট পান।

সুনামগঞ্জ ৪ (সুনামগঞ্জ সদর ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা)
এ আসনে আওয়ামী লীগের সাথে থাকা জোটের শরীক জাতীয় পার্টির প্রার্থী বেগম মমতাজ ইকবাল ১,২৩,৮৮৩ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন এবং তার নিকটতম প্রতিন্দ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থী মো. ফজলুল হক আসপিয়া পান ৫৮,৯৬৪ ভোট।

সুনামগঞ্জ ৫ (ছাতক ও দোয়ারা উপজেলা)
এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মুহিবুর রহমান মানিক ১,৬৫,৬৯৭ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন এবং তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থী কলিম উদ্দিন আহমেদ ৮৫,১৯৭ ভোট পান।

সিলেট ১ (সিলেট সিটি কর্পোরেশন এবং সদর উপজেলা)
এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবুল মাল আবদুল মুহিত ১,৭৮,৬৩৬ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন এবং তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থী এম সাইফুর রহমান ১,৪০,৩৬৭ ভোট পান।

সিলেট ২ (বিশ্বনাথ ও বালাগঞ্জ উপজেলা)
এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শফিকুর রহমান চৌধুরী ১,০৯,৩৫৬ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন এবং তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির এম ইলিয়াস আলী ১,০৬,০৪০ ভোট পান।

সিলেট ৩ (ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা এবং দক্ষিণ সুরমা উপজেলা)
সিলেট ৩ আওয়ামী লীগের প্রার্থী মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী ৯৭,৫৯৩ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন এবং তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির শাফি উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ৫৪,৯৫৫ ভোট পান।

সিলেট ৪ (গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ এবং জৈন্তাপুর উপজেলা)
এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ইমরান আহমদ ১,৪৪,১৯৮ ভোট পেয়ে জয়লাভ করেন এবং তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থী দিলদার হোসেন সেলিম ৯৮,৫৪৫ ভোট পান।

সিলেট ৫ (কানাইঘাট ও জকিগঞ্জ উপজেলা)
সিলেট ৫ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হাফিজ আহমদ মজুমদার ১,০৯,৬৯০ ভোট পেয়ে সাংসদ নির্বাচিত হন এবং তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির জোটের শরীক জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের প্রার্থী মোহাম্মদ ফরিদউদ্দিন চৌধুরী ৭৮,০৬১ ভোট পান।

সিলেট ৬ (বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জ উপজেলা)
এ আসনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নুরুল ইসলাম নাহিদ ১,৩৮,৩৫৩ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন এবং তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির জোটের শরীক জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী মাওলানা হাবিবুর রহমান পান ৫১,৭৬৪ ভোট।

মৌলভীবাজার ১ (বড়লেখা ও জুড়ী উপজেলা)
মৌলভীবাজার ১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শাহাব উদ্দিন ১,০৬,৫৭০ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন এবং তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্ব বিএনপির এবাদুর রহমান চৌধুরী পান ৬৯,৬০৯ ভোট।

মৌলভীবাজার ২ (কুলাউড়া উপজেলা)
এ আসনে আওয়ামী লীগের জোটের অংশ জাতীয় পার্টির প্রার্থী নওয়াব আলী আব্বাছ খাঁন ১,৩০,৯৪১ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন এবং তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী এমএম শাহীন ৬৪,৯৪২ ভোট পান।

মৌলভীবাজার ৩ (রাজনগর ও মৌলভীবাজার সদর উপজেলা)
মৌলভীবাজার ৩ আসনে আওয়ামী লীগের সৈয়দ মহসিন আলী ১,৪৪,৯২১ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন এবং তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির এম সাইফুর রহমান পান ১,১২,৮৯৫ ভোট।

মৌলভীবাজার ৪ (কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গল উপজেলা)
মৌলভীবাজার ৪ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. আব্দুস শহীদ ১,৩১,৭৪০ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন এবং তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির মো. মুজিবুর রহমান চৌধুরী ৭৯,৫৯৯ ভোট পান।

হবিগঞ্জ ১ (নবীগঞ্জ ও বাহুবল উপজেলা)
এ আসনে আওয়ামী লীগের দেওয়ান ফরিদ গাজী ১,৫২,০৮০ ভোট পেয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো নির্বাচিত হন এবং তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির শেখ সুজাত মিয়া পান ৭৯,৪৮৮ ভোট।

হবিগঞ্জ ২ (আজমিরীগঞ্জ ও বানিয়াচং উপজেলা)
এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. আব্দুল মজিদ খান ১,২২,০২৫ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার নিকটতম প্রার্থী বিএনপির এএম সাখাওয়াত হাছান জীব পান ৬৭,০৫৯ ভোট।

হবিগঞ্জ ৩ (সদর ও লাখাই উপজেলা)
হবিগঞ্জ ৩ আসনে আওয়ামী লীগ মো. আবু জাহির ১,৪৭,৮২৭ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন এবং তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির আবু লেইছ মো. মুবিন চৌধুরী ৫৭,২৬০ ভোট পান।

হবিগঞ্জ ৪ (চুনারুঘাট ও মাধবপুর উপজেলা)
এ আসনে টানা চতুর্থবারের মতো নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী এনামুল হক। তিনি ১,৫৫,৮৯৬ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বিএনপির সৈয়দ মো. ফয়সল পেয়েছিলেন ১,২৪,৭৮৮ ভোট।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত