রাজু আহমেদ

০৯ মার্চ, ২০১৬ ২১:৫৫

ব্যাংকিং সেক্টরের শনির দশা আর একটুখানি গল্প

ছোট বেলায় প্রায়ই সপ্তাহের শেষ দিন দু’টাকায় ঠেকে যেতাম। তখন প্রতি বৃহস্পতিবার বিকালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে বাংলা সিনেমা দেখাত। আমাদের গ্রামে তখন মাত্র একটাই টিভি ছিল। বাড়ী থেকে দীর্ঘ মাঠ পাড়ি দিয়ে টিভিওয়ালা বাড়ীতে যেতে হত। সেখানে ছবি দেখার চার্জ ছিল দু’টাকা। যে সময়টার কথা বলছি তখন দু’টাকা সংগ্রহ করা আমার জন্য সাংঘাতিক মুশকিলের কাজ ছিল। টাকা থাকলে তো ভালো আর না থাকলে যেকোনভাবে টাকা দু’টো সংগ্রহ করতেই হত। কেননা আলমগীর, জসীম, ইলিয়াস কাঞ্চন কিংবা রুবেলের ডিশুম ডিশুম না দেখতে পারলে পেটের ভাতই যে হজম হত না!

সিনেমা দেখতে যাব তাই সে টাকা বাসার বড় কারো কাছে চাওয়ারও সুযোগ ছিল না। সে বয়সে নৈতিকতা-অনৈতিকতার ব্যবধান বোধ না জাগলেও না বলে কারো কিছু নেয়াকে ভালোকাজ মনে করতাম না। অন্য কোথা থেকে টাকা জোগাড় করতে না পারলেও সমস্যা ছিল না! কেননা শেষ ভরসা হিসেবে বোনের মাটির ব্যাংকটি তো ছিলই। অনেক কষ্টে ব্লেড দিয়ে কৌশলে এক টাকার দু’টো কয়েন কিংবা পঞ্চাশ পয়সার চারটি কয়েন বের করে নিতাম! তবে তাতেই ঘর্মাক্ত হয়ে যেতাম! অথচ আজকের ব্যাংক চোরারা কোটি টাকার নিচে চুরিই করছে না।

সেদিনগুলোতে যে মনেই হোক টাকাটা না বলে নিতাম। কাজেই আজ সেটাকে চুরিই মনে হচ্ছে। তবে ছোটবেলার চুরি ভেবে অনেকেই হয়ত সেটা অপরাধ হিসেবে দেখবে না। সেদিনের সে ব্যাংক চুরির কথা আজ খুব করে মনে পড়ছে যখন জানতে পাড়লাম বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮০০ কোটি টাকা লাপাত্তা। এ সংবাদ ‍শুনে একটুও অবাক হইনি। মাত্র তো ৮০০ কোটি টাকা! যদি টাকাটা উদ্ধার না হয় তবে অবশম্ভাবীভাবেই শুনব সেটা তো টাকার অংকে মাত্র কয়েকটি টাকা ছিল! এ তুচ্ছ টাকার অঙ্ক গেলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ফান্ড দেউলিয়া হয়ে যাবে এমনটা তো নয়!

ভবিষ্যতে লাপাত্তা টাকার বিষয়ে যার মুখ থেকেই যা শুনি না কেন, বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরে যে রাহুর দশা ভর করেছে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নাই। সাধারণ মানুষ অবিশ্রাম পরিশ্রম করে ভবিষ্যতের সুখের জন্য টাকা জমা রাখছে আর দুষ্টু ভূত সে টাকা দেখে লালায়িত হয়ে মাঝে মাঝে এক খাবলা নিয়ে নিচ্ছে।

গত কয়েক বছরে দেশের ব্যাংকগুলোতে যা হয়েছে তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল ঘটনা। সেই হলমার্কের ৪ হাজার কোটি টাকা, বেসিক ব্যাংকের দুর্নীতি, সরকারী-বেসরকারি ব্যাংকের বিভিন্ন শাখার ভল্ট ডাকাতি এবং সর্বশেষ বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮০০ কোটি টাকা লুণ্ঠন। এর মাঝে আবার সম্প্রতি এটিএম বুথ ডাকাতি, বুথে জালিয়াতির মহোৎসব শুরু হয়েছে। এরপরেও কি সাধারণ মানুষ ব্যাংকে টাকা সঞ্চয়কে নিরাপদ মনে করবে?

বেসরকারি ব্যাংকগুলোর চেয়ে দুর্নীতিতে সরকারী ব্যাংকগুলো বেশি হওয়ার কারণ কি তাও খতিয়ে দেখা দরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাইবার নিরাপত্তায় যারা নিয়োজিত ছিল তারা নিশ্চয়ই রাস্তা থেকে তুলে আনা কোন অদক্ষ মানুষ নন। কাজেই হ্যাংকিয়ের সাথে কারা, কোথা থেকে জড়িত তার অদ্যোপান্ত আবিষ্কার করা আবশ্যক। ৪ হাজার কোটি হোক আর ৪’শ টাকা হোক-হুট করে এটাকে সামান্য টাকা না বলে অপরাধীরা যাতে শনাক্ত হয় এবং তাদের শাস্তি নিশ্চিত হয় তার বিহিত বিধান করার জরুরী।

আজ ৮০০ কোটি গেছে, আগামীর কোন দিন ৮ হাজার কোটি যাবে না তার নিশ্চয়তা কি? সাইবার ক্রাইম রোধে সরকার এত উদ্যোগী অথচ একের পর এক সাইবার ক্রাইম হয়ে যাচ্ছে আর সেটা রোধ করার যাচ্ছে না-এটা কিন্তু খুব বেমানান দেখায়।

ঘরের ইঁদুরে বান কাটছে কিনা সে বিষয়েও নিশ্চিত হওয়া জরুরী। বিড়ালকে দিয়ে দুধ পাহারা দেয়ানো হলে সে দুধে গৃহস্থ চুমুক লাগাতে পারবে এমন আশা করা বুদ্ধিমানের ধর্ম নয়। সময় থাকতে সচেতন হতে হবে।

এমনিতেই বিভিন্ন কারণে দেশের ব্যাংকগুলো অবস্থা নড়বড়ে, তার ওপরে যদি প্রায়ই বিভিন্ন ব্যাংক থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা খোয়া যেতে থাকে তবে সাধারণ মানুষ যেমন আস্থা হারাবে তেমনি যে উন্নয়নের তকমা লাগিয়ে সরকার টিকে আছে সে উন্নয়ন ঘটানোর সঙ্গতিও আর অবশিষ্ট থাকবে না।

রাজু আহমেদ : কলাম লেখক।
এ বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত