সোশ্যাল মিডিয়া ডেস্ক

০৮ জুলাই, ২০১৬ ২২:১৯

বিকাশ আকাশ ডন নামকরণের পোস্টমর্টেম‬

গুলশানে রেস্তোরাঁয় হামলাকারী ও পরে নিহত ৫ জঙ্গির নাম বিকাশ, আকাশ, ডন, বাধন এবং রিপন বলে প্রচার করে পুলিশ সদর দপ্তর। যদিও পরে ফেসবুকে ওঠে আসে হামলাকারীদের আসল পরিচয়। এতে দেখা যায় আকাশ, বিকাশ এসব জঙ্গিদের নাম নয়।

পুলিশের পক্ষ থেকে জঙ্গিদের এই ধরনের নাম প্রচার নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা দেখা দেয়। তবে ঘটনার সাতদিন পর এসব নাম প্রচারের যৌক্তিকতা ফেসবুকে তুলে ধরেছেন এক পুলিশ কর্মকর্তা। জঙ্গিরা বিভিন্ন ধাপে বিভিন্ন ছদ্ম নাম ব্যবহারের কারণেই এমনটি হয়েছে বলে দাবি করেছেন পুলিশ কর্মকর্তা সানি সানোয়ার।

এ পুলিশ কর্মকর্তা সাইট ইনটেলিজেন্স কর্তৃক দেওয়া হামলাকারীদের ভুল নামের পরেও তাদের সমালোচনা না হওয়া প্রসঙ্গে অভিযোগ করে লিখেন, "পুলিশ কর্তৃক ঘোষিত (পত্রিকা মারফতে জেনেছি) নিহত ০৫ জঙ্গির নামের সাথে SITE intelligence Group কর্তৃক প্রকাশিত ছবির জঙ্গিদের প্রকৃত নামের পার্থক্য থাকায় অধিকাংশ মানুষ পুলিশকে দোষারোপ করতে থাকে। কিন্তু SITE intelligence-ও সেই ০৫ জঙ্গির ছবির পাশাপাশি যে ০৫টি নাম প্রকাশ করেছে সেগুলোও কিন্তু প্রকৃত নামের থেকে পৃথক ছিল। তবুও কিন্তু কেউ SITE intelligence-কে ভুল নাম ছাপানোর জন্য দোষারোপ করেনি।" 

শুক্রবার ফেসবুকে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে সানি সানোয়ার লিখেন-

অনেকের মনেই একটি প্রশ্ন উত্তরহীন রয়ে গেছে:
পুলিশ এইসব কাল্পনিক নামগুলো কোথায় পেল? ৫টি নামই ভুল প্রমাণের পরও পুলিশের কোন বক্তব্য নেই কেন?

‪#‎এ_বিষয়ে_একটু_বলি‬,
জঙ্গি সংগঠনগুলো তাদের সদস্যদের নামকরণের ক্ষেত্রে একটা বিশেষ কৌশল অবলম্বন করে থাকে। রিক্রুটমেন্টের পর থেকে নতুন সদস্যের নাম ক্রমাগত পরিবর্তন হতে থাকে। আস্তানা পরিবর্তন, নতুন বাসা ভাড়া, প্রশিক্ষণগ্রহণ ও প্রদান, অস্ত্র-গোলাবারুদ সংগ্রহ ও হস্তান্তর, দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনাসহ প্রভৃতি ট্রাঞ্জিশন্যাল সময়ে তাদের নতুন নতুন নাম দিয়ে থাকে ইমেডিয়েট লিডাররা। একজন জঙ্গি সদস্য যতবার এইসব কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে ততবার তাকে নতুন নাম দেয়া হয়। এমনও দেখা গেছে, এই প্রক্রিয়ায় অনেক পুরাতন জঙ্গিকে তারা বিভিন্ন প্রয়োজনে ১২/১৩টি নাম দিয়েছে।
(শত শত জঙ্গি সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদের তথ্য-উপাত্ত থেকে সংগৃহীত)

গোয়েন্দাসূত্র থেকে গত ০১ জুলাই-এর গুলশান ট্র‍্যাজিডির কয়েকজন অ্যাটাকারের নাম গোয়েন্দাদের কাছে চলে আসে ঘটনা ঘটার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই। এখন, প্রশ্ন আসতে পারে যে, এত দ্রুত পুলিশ এই নাম কিভাবে পেল?

‪#‎এবার_একটু_বিস্তারিত_বলছি‬:
২০১৫ সালের সংঘটিত আশুলিয়ার ব্যাংক ডাকাতি ঘটনা থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত জেএমবি'র এই খণ্ডিত অংশটি দেশব্যাপী প্রায় ০৩ ডজন হামলা চালিয়েছে। এসকল ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে এই গ্রুপের শতাধিক সদস্যকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের সংশ্লিষ্ট কয়েকটি ইউনিট। এ পর্যন্ত সেসব ঘটনার প্রায় ৯০% -এর রহস্যভেদ করতে পেরেছে পুলিশ, আর বাকিগুলোর রহস্যভেদও সময়ের ব্যাপার মাত্র। সবগুলো ঘটনার ক্ষেত্রেই পুলিশ জানতে পেরেছে হামলাকারী ও নির্দেশদাতার নাম (কোড নেইম)। এই সব ঘটনা তদন্ত করে পুলিশের কাছে জমেছে এক বিশাল তথ্য ভাণ্ডার ও তথ্য প্রাপ্তির অসংখ্য চ্যানেল। পুলিশের এই তথ্য প্রবাহের রাস্তা থেকে ইতোপূর্বে জানা গেছে অসংখ্য হামালার পূর্বাভাস। ফলে ঢাকা ও দেশের প্রত্যন্ত এলাকার কয়েকডজন হামলা সংঘটন এবং হামলার প্রস্তুতি নস্যাৎ করতে পেরেছে পুলিশ।

উল্লেখ্য যে, একটি ঘটনা ঘটলে তার খবর পত্র-পত্রিকা আর ফেইসবুকে ভাইরাল হয়ে যায়, কিন্তু আগাম খবরের ভিত্তিতে কোন ঘটনা না ঘটতে দেয়ার সাফল্যের খবর গোয়েন্দাদের একই অফিসের পাশের দেওয়ালও জানতে পারেনা না। এই ধরনের সাফল্য প্রচার করার থেকে গোপন রাখাটাই জনমনে নিরাপত্তাবোধ সৃষ্টির জন্য অধিক কার্যকরী। তাই পুলিশ বা গোয়েন্দারা বাহবা নেওয়া থেকে বিরত থাকে।

জঙ্গি সংক্রান্তে পুলিশের বিশাল তথ্য ভাণ্ডার, তথ্য প্রাপ্তির অসংখ্য চ্যানেল এবং দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা তাদের অনেক দ্রুত এবং সহজে তথ্য পেতে সহায়তা করে। এটি ভিন্ন পেশার লোকজনের জানার বা বুঝার অবকাশ খুব কমই থাকে।

সেই প্রেক্ষিতেই গুলশানের সেই রেস্টুরেন্টে উল্লিখিত কোড/অস্থায়ী/ভুয়া নামের কয়েকজন জঙ্গি (বিকাশ, আকাশ, ডন, বাধন এবং রিপন )-এর শারীরিক অস্তিত্বের বিশ্বাসযোগ্য তথ্য পায় পুলিশ। তাৎক্ষণিক বিশ্লেষণে বুঝে যায় যে, সর্বশেষ আস্তানায় তারা এই নাম ধারণ করে এই অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। বিষয়টি পুলিশকে একাধিক সূত্র থেকে নিশ্চিত করে এবং সূত্রগুলোর তথ্যের পারস্পরিক পার্থক্য খুব কম ছিল, যা তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে।

ছবিগুলো রীতা কার্টজ-এর SITE Intelligence Group -এ প্রকাশের পর গোয়েন্দাসূত্রসমূহ ছবির মানুষগুলোকে নামসহ(সর্বশেষ আস্তানায় আসার আগে প্রদত্ত কোড/ভুয়া নামের ভিত্তিতে) সনাক্ত করে দিতে সাহায্য করে। সে বিষয়টিও একাধিক সূত্র সমর্থন করার পর নিশ্চিত হয়ে পুলিশ সেগুলো প্রকাশ করে।

সমাজের যে সকল ব্যক্তি সেই ০৫ জঙ্গিদের আগে থেকেই চিনতেন তারা অনলাইনে তাদের ছবিগুলো দেখে তাদের মধ্য থেকে ০৩ জনকে চিহ্নিত করে ফেইসবুকে তাদের আসল নাম-পরিচয় পোস্ট/শেয়ার দিতে থাকেন। পরবর্তিতে এটা ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পরে চারিদিকে।

এবার শুরু হয় তাদের (০৩ জনের) আসল নাম এবং পুলিশ প্রদত্ত নামগুলো নিয়ে বিতর্ক। আসল নামের সন্ধান পাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই পুলিশের তালিকাভুক্ত প্রকাশিত নাম নিয়ে দেখা দেয় সংশয় এবং অবিশ্বাস। বস্তুত: পুলিশ কর্তৃক ঘোষিত নামসমূহ (সাংগঠনিক কোড নামসমূহ) আর পরিচিতজনদের থেকে প্রাপ্ত আসল নামের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও ব্যক্তির অস্তিত্ব কিন্তু একই পাওয়া যায়। কিন্তু গ্রেফতার এড়াতে বা নিজস্ব নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জঙ্গিদের নামকরণের এই নিরাপত্তা কৌশলের জটিলতায় শুভংকরের ফাকিতে পরে যায় সাধারণ মানুষ।..... অত:পর ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে বগুড়া থেকে বাকি দু'জনের আসল পরিচয় উদ্ধার হলেও পুলিশের দেয়া নামগুলো নিয়ে বিতর্ক থেকেই যায়।

পুলিশ কর্তৃক ঘোষিত (পত্রিকা মারফতে জেনেছি) নিহত ০৫ জঙ্গির নামের সাথে SITE intelligence Group কর্তৃক প্রকাশিত ছবির জঙ্গিদের প্রকৃত নামের পার্থক্য থাকায় অধিকাংশ মানুষ পুলিশকে দোষারোপ করতে থাকে। কিন্তু SITE intelligence-ও সেই ০৫ জঙ্গির ছবির পাশাপাশি যে ০৫টি নাম প্রকাশ করেছে সেগুলোও কিন্তু প্রকৃত নামের থেকে পৃথক ছিল। তবুও কিন্তু কেউ SITE intelligence-কে ভুল নাম ছাপানোর জন্য দোষারোপ করেনি।

SITE-এ প্রকাশিত তাদের ০৫ জনের নাম:
আবু উমর, আবু সালমা, আবু রহিম, আবু মুসলিম ও আবু মুহারিব।

পুলিশ কর্তৃক প্রকাশিত তাদের ০৫ জনের নাম:
বিকাশ, আকাশ, ডন, বাধন ও রিপন।
(সূত্র:সংবাদ মাধ্যম)

জনগণ এবং পুলিশের অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তাদের ০৫ জনের নাম:
নিবরাস ইসলাম (সাংগঠনিক কোড নাম: রিপন)
মীর সামেহ মোবাশ্বের (সাং কোড নাম: আকাশ)
রোহান ইবনে ইমতিয়াজ (সাং কোড নাম: বিকাশ)
মো: খাইরুল ইসলাম পায়েল (সাং কোড নাম: বাধন)
শফিকুল ইসলাম (সাং কোড নাম: ডন)

SITE intelligence-এ প্রকাশিত ০৫ জঙ্গির নামগুলো সংগঠন কর্তৃক দেয়া ছদ্ম নাম, কেননা তারা সেসময় সর্বশেষ আস্তানা থেকে বিদায় নিয়ে অভিযানে আসার সময় এক্ষেত্রে যত্ন করে তাদেরকে একেকটা সুন্দর আরবীয়-টাইপ নাম দেয়া হয়েছে যেহেতু এই নামগুলোই বিশ্ববাসী প্রচার পাবে। কিন্তু আগে ক্ষণস্থায়ী প্রয়োজনে যখন যা মনে এসেছে সেই কোড নামেই একেকজনকে চিহ্নিত করে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিল।

আসলে যার যার পেশার রকম ফের আলাদা। ক্ষুদ্র জ্ঞান কত বিষয়ই আর নিতে পারে। জঙ্গি বিরোধি কাজ শুধু নাম দিয়ে হয় না, নামগুলো কোড হিসেবে কাউন্ট করে নামের ধারাবাহিকতা পর্যবেক্ষণ করে প্রকৃত জঙ্গিকে গ্রেফতার করতে হয়। এভাবেই কাজ হচ্ছে দেশে এবং বিদেশে।

‪#‎পুলিশ_তাহলে_কি_করলো‬?
০৫জনের প্রকৃত পরিচয় তো জনগণই বের করে দিল!
-এই টাইপের কথা শুনা যাচ্ছিল।

উত্তর হচ্ছে, সমাজ থেকে তথ্য পেতে পুলিশ জনগণের উপরই নির্ভরশীল। তাই জনতা পারে, কিন্তু পুলিশ কেন পারে না - এধরনের কথা বলে পুলিশকে জনতার বিপরিতে দাড় করানোর কোন যুক্তি নেই। পহেলা বৈশাখের যৌন হয়রানীর ঘটনায় জড়িত ৮জন সন্দিগ্ধ ব্যক্তির আর আনসার আল ইসলাম বা এবিটি'র ০৬ জন জঙ্গির ছবি পুলিশ গণমাধ্যমে প্রকাশ করেছে। পুলিশের উদ্দেশ্য জনগণের সহযোগিতা নেয়া। জনগণ তথ্য দিলে তবেই পুলিশ সহজে তাদের গ্রেফতার করতে পারবে । পুলিশ তার অন্যান্য নিজস্ব পদ্ধতিতে কাজ করে, তবে জনগণ তথ্য দিলে বিষয়টি সহজতর হয়। পুলিশ সব সময়ই জনতার উপর নির্ভরশীল। বেতনের জন্য, তথ্যের জন্য, সাক্ষ্যপ্রদানের জন্য, পারস্পরিক নিরাপত্তার জন্য, পারিবারিক বন্ধনের জন্য, বন্ধুত্বের জন্য..... ইত্যাদি ইত্যাদি।

পুলিশের অনেকগুলো সমস্যার মধ্যে একটা সমস্যা হচ্ছে নিজেদের অবস্থানটা স্মার্টলি বলতে পারে না, বললেও সবাই প্রি-কনসেপ্ট মাইন্ড নিয়ে সন্দেহের চোখেই দেখে। সমাজে অনেকেই কাজ না করেও শুধু স্মার্ট, ভুংভাং, পটু বক্তা এবং এক্সট্রোভার্ট হওয়ার কারণে অনেকই জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।

দিনশেষে আপনার শান্তির ঘুম কিন্তু এই বোবা পুলিশই নিশ্চিত করছে। একটু ভেবে দেখুন......

ভাল থাকবেন। জাযাকাল্লাহ খাইরুন .....

আপনার মন্তব্য

আলোচিত