মাসকাওয়াথ আহসান

২৮ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০২:৩৪

তরুণ-যুবাদের সঙ্গে বাংলা একাডেমির জেদাজেদি মানায় না!

বাংলা একাডেমি একটি বয়স্ক প্রতিষ্ঠান। সাহিত্যের আলোকিত উঠোন। সাহিত্য চর্চার মূল উদ্দেশ্য প্রতিদিনের যাপিত জীবনের বাইরে একটু উৎকর্ষ খোঁজার আনন্দময় ভ্রমণ। এই ভ্রমণে তিক্ততার কোন জায়গা নেই। উঠোনটা প্রশস্ত। সেখানে সংকীর্ণতার কোন স্থান নেই।

কিছুদিন আগে লেখক রতনতনু ঘোষের মৃতদেহ নিয়ে তার লেখক বন্ধুরা লেখকের প্রিয় উঠোন বাংলা একাডেমির গেটে পৌঁছুলে বাংলা একাডেমির একজন সেবক জানিয়ে দেন, উনি বিশিষ্ট কোন লেখক নয়। সুতরাং সম্মান জানানোর জন্য কিছুটা সময় লেখকের মৃতদেহটি বাংলা একাডেমিতে রাখা যাবে না। অবাক হলাম। এটা কী সাহিত্যের একাডেমি! এরকম রুচিবোধ সম্পন্ন সেবক বা কর্মচারি সাহিত্য একাডেমির জন্য একদম উপযোগী নয়। এদেরকে মানায় থানার দারোগা হিসেবে।

খুব অবাক লাগে; এককালে বাংলা একাডেমির আধিকারিক মানেই এক একজন লেখক, আলোর মানুষ ছিলেন। তারা ঔদার্যে আর স্নেহে সত্যিকার অর্থেই বাংলা একাডেমির সেবক হবার যোগ্য ছিলেন। তারা অবসরে চলে যাবার পর আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কী সাংস্কৃতিক রুচির মানুষ তৈরি করছে, যারা একজন লেখক বিশিষ্ট না অবিশিষ্ট সেই শব ব্যবচ্ছেদ করছে লেখকের মৃতদেহ সামনে রেখে।

সম্প্রতি বাংলা একাডেমির কিছু সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রকাশক রবিন আহসান অভিমত প্রকাশ করায় একাডেমি রবিনের শ্রাবণ প্রকাশনীকে দুইবছরের জন্য একুশে বইমেলায় নিষিদ্ধ করেছে। ভিন্নমত প্রকাশ করা কী করে বাংলা একাডেমির মতো সাহিত্য আয়োজনে অপরাধ হয়ে দাঁড়াতে পারে এটা বোধগম্য নয়। নিঃসন্দেহে বাংলা একাডেমি তার নিজের আউট ডেটেড হয়ে যাওয়াটাকে উন্মোচিত করছে এসব স্থূল ও অশিষ্ট আচরণের মাঝ দিয়ে।

চিন্তার দ্বন্দ্ব থেকেই সভ্যতার বিকাশ ঘটে; আর সাহিত্য নানামুখী চিন্তার আনন্দময় দ্বান্দ্বিক পরিসর। সুতরাং বাংলা একাডেমির কর্মচারিদের সমসাময়িক হতে গেলে বা প্রাসঙ্গিক থাকতে গেলে তাদের নিজস্ব চিন্তার আলোকায়ন ঘটাতে হবে। বাংলা একাডেমিকে আমরা ভালোবাসি। এ আমাদের নস্টালজিয়ার জায়গা। আমরা এই বাতিঘরের আলোকে স্মৃতির মুঠোয় লালন করি।

অনলাইন মিডিয়ার যে বিকাশ ঘটেছে; সেখানে যেভাবে সাহিত্য-সংস্কৃতি-বিতর্ক বিকশিত হচ্ছে; তাতে আমাদের চিন্তার বাংলা একাডেমি আকাশে নতুন ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে। আগে যাদের বইমেলার মাসে বছরে একবার দেখা হতো একুশে বইমেলায়; তাদের এখন প্রতিদিন দেখা হয়। ফলে এমনিতেই ভবিষ্যতের ভূমি বাস্তবতার একুশে বইমেলা এবং কাগজের গ্রন্থ এরইমাঝে বড় চ্যালেঞ্জের মাঝে পড়ে আছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বা ওয়েব পোর্টালগুলোতে বেশীর ভাগ প্রকাশনা সংস্থার ভার্চুয়াল শো রুমে সারাবছর আলো জ্বলে। এ যেন আকাশে মেঘের ভাঁজে ভাঁজে স্বপ্নের একুশে বইমেলা।

আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সূত্র ধরে ঢাকায় কবি-সাহিত্যিকদের বাসায় আজকাল নিয়মিত সাহিত্য আড্ডা বসে। ফলে আড্ডার তৃষ্ণা অপূর্ণ থাকছেনা একেবারেই। এরকম পরিস্থিতিতে বাংলা একাডেমির বরং চেষ্টা করা উচিত উষ্ণতা নিয়ে লেখক-সাহিত্যিকদের সবার সঙ্গে সম্পর্ক ধরে রাখা। কারণ পরিবেশ বন্ধুভাবাপন্ন না থাকলে একবিংশের মানুষ আপোষ করে আর কোন আড্ডায় যায়না। পৃথিবীতে সময়ের গ্রহণে কেউই ইনডিসপেনসিবল বা অ-প্রতিস্থাপনযোগ্য নয়।

আমরা আশা করবো বাংলা একাডেমি এর সোনালী ঐতিহ্য ধরে রাখতে এসব নিষিদ্ধ-ফিষিদ্ধ করার মতো কাজগুলো আর করবে না। যে কোন বিষয়ে অযৌক্তিক জিদ ধরে রাখা শেষ পর্যন্ত ছেলেমানুষি। নিজেকে নিজেই হাস্যষ্পদ করে তোলা মানে গুরুত্ব হারানো ও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাওয়া।

বাংলা একাডেমির যে বয়স; তাতে তার তরুণ-যুবাদের সঙ্গে জেদাজেদি করাটা মানায় না। যাপিত জীবনে গতানুগতিক মানুষদের কাছে কেউ প্রজ্ঞা বা চিন্তার আভিজাত্য তেমন প্রত্যাশা করেনা। কিন্তু বাংলা একাডেমি যে চিন্তা ও প্রজ্ঞা চর্চার অভিজাত উঠোন। একে এতোটা ক্লিশে নিম্নরুচির প্রতিষ্ঠান করে ফেললে তা সত্যিই হবে অনুতাপের।

  • মাসকাওয়াথ আহসান : সাহিত্যিক, সাংবাদিক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত