আল আমিন হোসেন মৃধা

০২ এপ্রিল, ২০১৭ ২১:০৩

শিক্ষা মৌলিক অধিকার, না বাজারি পণ্য!

শিক্ষা হলো সভ্যতার রূপায়ন। শিক্ষা মানুষের অধিকার। ছয়টি মৌলিক অধিকার অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও কাজ; রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য থাকে এগুলো পূরণ করা। এই মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলে তাকে মানবিক রাষ্ট্র বলা যায় না।

শিক্ষা আমাদের ন্যায্য অধিকার, এটা কোন পণ্য নয়। তাই এই শিক্ষা নিয়ে যেকোনো অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ যোগ্য হতে পারে না।

গত ৩০ মার্চ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ঢাকার শেরেবাংলা নগরে এনএসি সম্মেলন কেন্দ্রে এনজিও প্রতিনিধিদের সাথে প্রাক-বাজেটে উচ্চ শিক্ষায় টিউশন ফি পাঁচ গুণ বৃদ্ধির কথা বলেছেন। অর্থমন্ত্রী বলন, "উচ্চ শিক্ষায় অর্থাৎ সরকারি কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজসহ স্নাতক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি পাঁচ গুণ বৃদ্ধি করা হবে, দেখি কি হয়।"

স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর অর্থমন্ত্রীর এমন বক্তব্য শিক্ষায় ভ্যাট আরোপের চেষ্টা, শিক্ষায় সাম্প্রদায়িকতা পাকিস্তান শাসনামলে আইয়ুব সরকারে শিক্ষা কমিশনকেও হার মানায়। ১৯৫৯ সালে আইয়ুব খান যে শরীফ শিক্ষা কমিশন গঠন করেছিল, সেই কমিশনের রিপোর্ট ছিলো পুরো মাত্রায় ধনিক শ্রেণির স্বার্থ-রক্ষাকারী ও গণ-বিরোধী, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের নির্লজ্জ প্রচেষ্টা। এতে উল্লেখ ছিলো, ‘অবৈতনিক শিক্ষার ধারণা বস্তুত অসম্ভব কল্পনা মাত্র’। আরও বলা হয়েছে, ‘শিক্ষা সস্তায় পাওয়া সম্ভব নয়’।

বিশ্বব্যাংকের মদদে UGC (বিশ্বব্যাংক এর সরাসরি প্রেসক্রিপশনে) বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটা ২০ বছর মেয়াদী কৌশলপত্র তৈরি করেছে যা ২০২৬ সাল পর্যন্ত ধীরে ধীরে বেতন ফি বাড়িয়ে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পূর্ণ খরচ এর শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেয়া হবে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আরও কিছু বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে (বাণিজ্যিকভাবে সান্ধ্য কোর্স এবং অন্যান্য এ ধরণের পদক্ষেপগুলোও সেজন্যেই নেয়া)। ফলস্বরূপ পাবলিক আর পাবলিক না থেকে হয়ে যাবে বিত্তবানের বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবিধানের ১৭ নাম্বার অনুচ্ছেদের 'ক' ধারায় একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ থাকলেও ২০১০ সালে 'জাতীয় শিক্ষানীতি' সংসদে পাস হওয়া শিক্ষানীতিতে কোথাও একমুখী ও বৈষম্যহীন শিক্ষা ব্যবস্থা রাখা হয়নি। বরং আরও বেশি করে শ্রেণীবিভাজন ও বাজারি পণ্যে পরিণত করা হয়েছে।

অর্থমন্ত্রীর বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি বৃদ্ধির বক্তব্যও বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসনের পরিপন্থী।

সাধারণ অর্থে স্বায়ত্তশাসন বলতে স্বাধীনভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করার ক্ষমতাকে বোঝায়। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন বলতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ থেকে শুরু করে ছাত্র ভর্তি, কোর্স কারিকুলাম নির্ধারণ, গবেষণা পরিচালনা, আর্থিক ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি সমস্ত বিষয়ে নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার থাকবে। আবুল মাল আবদুল মুহিত সাহেব বিশ্ববিদ্যালয়ের কে? কোন এখতিয়ারে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফি বৃদ্ধির কথা বলেন। এতে কি প্রমাণ হয় না বিশ্ববিদ্যালয় আর বিশ্ববিদ্যালয় নাই!

মুহিত সাহেব স্নাতক পর্যায়ে টিউশন ফি বৃদ্ধির কথা শেষে জোর গলায় একটা কথা বলেছেন, "দেখ কি হয়"।

মন্ত্রীসাহেব আপনারা ক্ষমতায় আপনাদের দেখে নেবার শক্তি কার আছে। কেননা প্রকৃত গণতন্ত্রে জনগণ প্রতিবাদ করে, সরকার শোনে। আমাদের ‘গণতন্ত্রে’ আপনারা শাসন করবেন, জনগণ চুপ করে থাকবে। প্রকৃত গণতন্ত্রে সরকারকে জনগণের আস্থা অর্জন করতে হয়, আমাদের ‘গণতন্ত্রে’ জনগণকেই আপনাদের আস্থায় থাকতে হয়।

এদেশের ছাত্ররা এখনো মাথা বিকিয়ে দেয় নাই। এদেশের সব ছাত্র সংগঠনগুলো এখনো ক্ষমতাসীনদের ছাত্র সংগঠনের মতো পেটোয়া বাহিনীতে পরিণত হয়ে যায় নাই।

শিক্ষাকে বাজারি পণ্যে পরিণত করা, শিক্ষায় সাম্প্রদায়িকীকরণ ও শিক্ষাকে সার্টিফিকেটে রূপান্তরিত করে আপনাদের নতজানু উচ্চ কেরানি বানানোর প্রক্রিয়া এ দেশের ছাত্র সমাজ মেনে নেবে না। অবিলম্বে এগুলো বন্ধ করুন। না হলে ছাত্ররা শক্ত হাতে প্রতিহত করব। তখন আর স্থির থাকতে পারবেন না।

  • আল আমিন হোসেন মৃধা: সভাপতি, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, ঢাকা কলেজ।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত