আরিফ জেবতিক

০৩ জুন, ২০১৭ ১৫:৩৭

‘হেফাজত দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলো মিথ্যার উপর’

সুলতানা কামালের বক্তব্যের বিষয়টি বুঝার জন্য ভিডিও ক্লিপ দেখছিলাম। দেখতে গিয়ে সাম্প্রতিক বেশ কিছু টকশো এর ক্লিপ দেখা হয়ে গেল। দেখতে দেখতে ভাবলাম, মিডিয়ায় হেফাজতের লোকজনকে ডেকে এনে হেনস্থা করার একটা সুক্ষ কৌশল কি আমাদের মিডিয়াগুলো নিচ্ছে? বেশ কয়েক জায়গায় দেখলাম, হেফাজতের একজন নেতার উল্টোদিকে বক্তব্য রাখার জন্য হেফাজতের বিপরীত বৃহত্তর অন্যান্য রাজনৈতিক মতবাদের একাধিক লোকজন রাখা হয় এবং অনেক সময় উপস্থাপকও পক্ষ নেয়ার চেষ্টা করে থাকেন।

প্রথম কথা হচ্ছে নৈতিকভাবে মিডিয়া এটি করতে পারে না। আমি বলছি না যে মিডিয়ার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে না, সেটা থাকতেই পারে; কিন্তু বিতর্ক চাইলে সুস্পষ্টভাবে বিতর্কের সমান সুযোগ রাখা দরকার। মিডিয়া আসলে হেফাজতকে হেনস্থা করার অপচেষ্টার মাধ্যমে হেফাজতকে ভিকটিম হিসেবে হাজির করছে এবং পাবলিকের সিম্প্যাথি যোগাচ্ছে। মিডিয়া তাঁর নৈতিক অবস্থান তো হারাচ্ছেই এবং যে কারণে হারাচ্ছে সেটাও তা কখনোই অর্জন করতে পারবে না।

দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, যারা হেফাজতের নেতাদের সঙ্গে বিতর্কে জড়াচ্ছেন তাঁদের যোগ্যতা নিয়ে আমার প্রশ্ন আছে। কিছু ভারি ভারি নামের লোকজনকে হেফাজতের সাথে বিতর্কে দেয়া হচ্ছে, যাদের কোনো হোমওয়ার্ক আছে বলে আমার মনে হয় না। এরা হয়তো স্টুডিওতে আসার আগে জানেই না কী বিষয়ে কথা বলতে হবে। হেফাজতের যে নেতারা টিভিতে আসেন, তাঁদের অধিকাংশই ( ব্যতিক্রম খুব কম ছাড়া) সুস্পষ্ট একটা রাজনৈতিক এজেন্ডা নিয়ে কাজ করছেন। তাই তাঁদের বক্তব্য খুব গোছানো। অন্যদিকে, অন্য আলোচকরা আজকে হেফাজত কালকে আলুপটল পরশু বাজেট নিয়ে আলোচনা করেন বলে তাঁরা সব ক্ষেত্রেই ভাসাভাসা। এতে করে হেফাজতের মূল রাজনৈতিক এজেন্ডা, যেটি তারা ইসলামের নামে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য করে থাকে, সেটি স্পষ্ট হয় না।

হেফাজত দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলো মিথ্যার উপরে। এরাই দাবি করেছিল যে ২০১৩ সালের ৫ মে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। পরবর্তীতে তারা বলেছিল যে এই মৃতদের তালিকা তারা করছে। আমি টকশোতে কাউকেই এই তালিকা সম্পর্কে প্রশ্ন করতে দেখি না। হেফাজত জানে যে তারা মিথ্যাচার করেছিল। সেক্ষেত্রে হয় তারা হাজার হাজার মানুষের তালিকা দেবে, অথবা সেই মিথ্যাচারের জ‌ন্য তারা অনুতপ্ত কী না সেটা মিডিয়াতে বলবে। এই বলার মাধ্যমেই মানুষকে বারবার স্মরণ করিয়ে দিতে হবে যে হেফাজত আদতে দুনিয়াদারির বখরা লাভের আশায় তৈরি গুটিকয় লোভী মানুষের সমাবেশ মাত্র, যারা নিজেদের লাভের জন্য এদেশের সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি এবং সাধারণ মাদ্রাসা শিক্ষক-ছাত্রের অসহায়ত্বকে পূঁজি করে রেলের জমির মতো ডিলগুলো বাগানোর ধান্দায় আছে।

তাদের সর্বশেষ মিথ্যাচারের নমুনা হচ্ছে, সুলতানা কামালের বক্তব্যকে টুইস্ট করা। আমি টকশোর ক্লিপ দেখেছি। সেখানে হেফাজত নেতা অন্যান্য যুক্তির পরে এক পর্যায়ে যা বলছিলেন, তার সারমর্ম এই যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যেহেতু ধর্ম নিরপেক্ষতা, সে কারণে হাইকোর্ট চত্বরে আসলে 'মূর্তি' স্থাপন করা সেই স্পিরিটের সাথে যায় না। এই কথার রেশ ধরে সুলতানা কামাল যা বলেন, তার সারমর্ম হচ্ছে হেফাজত নেতার ঐ ধর্মনিরপেক্ষতার যুক্তি মানলে তো হাইকোর্ট চত্বরে মসজিদও রাখা যাবে না।

এই কথাকে টুইস্ট করে হেফাজত প্রচার করছে যে ওখানে 'মূর্তি' না থাকলে মসজিদও থাকতে দেয়া হবে না বলে সুলতানা কামাল হুমকি দিয়েছেন! পুরাই মিথ্যাচার, ক্লাসিক হেফাজতি মিথ্যাচার। সেই শাপলা চত্বরে যে হাজার হাজার লোককে হত্যা করা হয়নি, সেটা জেনেও যেমন তারা মিথ্যাচার করেছিল, এবারও সেই একই কাজ করছে।

এই বিষয়গুলো আলোচনায় আনা দরকার বারবার। তা না করে হেফাজতকে মূর্তি আর ভাস্কর্যের তফাৎ বোঝাতে যাওয়ার মতো বালখিল্য দেখলে হাসি পায়। যারা এটা বোঝাতে যায়, তারা কি তবে প্রকারান্তরে এটা স্বীকার করে নেয় যে ভাস্কর্যের জায়গায় মূর্তি হলে তারাও হাইকোর্ট চত্বরে মূর্তি অপসারনে হেফাজতের মিছিলে শরিক হবে?

ভাস্কর্য আর মূর্তির তফাৎ আসলে মূল আলোচনা নয়। মূল আলোচনা হচ্ছে, একদল লোক ধর্মের কথা বলে ক্রমাগত মিথ্যাচার করে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে এবং সেই ভয়ে ভীত সরকার বারবার পেছাচ্ছে। এটি একটি মৌলিক বিতর্ক। সেই বিতর্কে প্রাণ দিতে হলে কিছু লেখাপড়া করা দরকার, গবেষণা করা প্রয়োজন আপনাদের। 'হেফাজতি মোল্লাদের ধমকাইয়া শেষ করে দিমু'- এই লড়কে লেঙ্গে আওয়াজ দিয়ে শুধু নিজেদের অসারত্ব প্রমান করা ছাড়া লাভ হবে না। সামনে যাদেরকে দেখছেন এরা হচ্ছে হেফাজতের মুখোশ। হেফাজতের প্রাণ ভোমরা যারা, তাদের লেখাপড়া, বিদ্যাবুদ্ধির দৌঁড়কে ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। যারা মনে করে হেফাজত কিছু 'আনপড় মাদ্রাসার লোক', তারা বোকার স্বর্গে বাস করেন। হেফাজতের ইন্টেনশন ক্লিয়ার। একমাত্র মূর্খরাই হেফাজতকে মূর্খ ভাবার মতো মূর্খতা করতে পারে, আর কেউ না।

 

আরিফ জেবতিক: লেখক, এক্টিভিস্ট।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত