ইমতিয়াজ মাহমুদ

০৬ জুলাই, ২০১৭ ০২:৪৯

আপনাদের কাছে বিচার দিয়ে যাই!

তরুণ বন্ধুরা, আপনারা গত কয়েকদিনের খবরের কাগজের শিরোনামগুলি কি লক্ষ্য করেছেন? একটা খবর তো হচ্ছে ফরহাদ মজহারের হারিয়ে যাওয়া আর ফেরত আসা নিয়ে। ফরহাদ মজহার একজন লেখক, একজন এনজিও নেতা এর এরকম নিখোঁজ হয়ে যাওয়া নিয়ে বড় খবর হবে সে তো স্বাভাবিকই। একটা আশঙ্কা তো শুরু থেকেই ছিল যে সরকার ফরহাদ মজহারের কণ্ঠ রোধ করতে চাইছে কিনা। ফরহাদ মজহারের প্রতি আমার বিশেষ শ্রদ্ধাভক্তি নেই- ভদ্রলোককে আমার পছন্দ না। কিন্তু তাই বলে সরকার তাঁর কণ্ঠরোধ করবে সে তো আর সমর্থন করা যায়না। সেজন্যে এই খবরটা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ভদ্রলোক ফেরত এসেছেন- ভাল হয়েছে।

কিন্তু আপনি কি লক্ষ্য করেছেন যে আরেকটা বড় খবর- বয়লার বিস্ফোরণে যে ১৩জন শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছে, অর্ধ শতাধিক শ্রমিক আহত হয়েছে- এই খবরটা নিয়ে আমাদের তরুণদের মধ্যে সেরকম আলোড়ন হয়নি। এইটা একটা দুশ্চিন্তার বিষয়। কেননা শুদ্ধ ব্যবস্থাপনার ত্রুটির জন্যে একটি দুর্ঘটনায় এতজন মানুষ প্রাণ হারাবে আর সেটা নিয়ে আমাদের তরুণদের মধ্যে আলোড়ন হবে না এটা ভাল লক্ষণ না। একটি দেশের ছাত্র তরুণরা যদি অন্যায়ের বিরুদ্ধে যথাযথ প্রতিবাদ না করে, তাইলে ধরে নিতে হবে তারুণ্য ঠিক পথে নেই। ছাত্র তরুণরাই সবসময় নিঃস্বার্থভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারে।

বয়লার বিস্ফোরণে অন্যায়ের দিকটা কি? এটাকে কেন আপনি নিছক একটা দুর্ঘটনা হিসাবে দেখবেন না? কেন এই মৃত্যুর জন্যে আপনি মালিক পক্ষকে দায়ী করবেন? এই বিষয়গুলি একটু ভেবে দেখেন।


দেখেন, বয়লার জিনিসটা একটা বিপদজনক কিন্তু প্রয়োজনীয় জিনিস। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিই শুধু না, অনেক শিল্প কারখানা এমনকি বড় হোটেলগুলিতেও বয়লার থাকে, বয়লারের প্রয়োজন হয়। বয়লারটা কি? বয়লার হচ্ছে একটা বদ্ধ বাক্স বা সিন্ধুক যেটাতে গ্যাস পুড়িয়ে বা তেল পুড়িয়ে পানি গরম করা হয় আর সেখান থেকে গরম পানি স্টিম আকারে বা পানি আকারেই সার্কুলেট করা হয়। বুঝতেই পারছেন, বয়লারের ভিতর যখন পানি ফুটতে থাকে তাতে প্রচণ্ড চাপ তৈরি হয় আর বয়লারটি যদি ঠিকঠাক মতো না থাকে তাইলে সেই প্রচণ্ড চাপে সেটি ফেটে যেতেই পারে।

এইজন্যে বয়লার নিয়ন্ত্রণের জন্যে আলাদা আইন আছে। আপনি চাইলেই আপনার বাড়ীতে বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে একটি বয়লার বসাতে পারবেন না। বয়লার বসানোর আগে আপনাকে সেটির জন্যে লাইসেন্স নিতে হবে। লাইসেন্স নেবেন কার কাছ থেকে? চীফ ইন্সপেক্টর অফ এক্সপ্লোসিভ নামে একজন কর্মকর্তা আছেন, যার দায়িত্ব হচ্ছে বয়লারের লাইসেন্স দেওয়া। আপনি যদি একটি বয়লার স্থাপন করতে চান, তাইলে এই ভদ্রলোকের কাছে আবেদন করবেন- আবেদন করে তাঁকে জানাবেন আপনি কোথায় কেন কি ধরনের বয়লার স্থাপন করতে চান।

ঐ যে প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক আছেন, তিনি তখন আপনার বয়লারটি দেখবেন। বয়লারটি কোথায় স্থাপন করতে চান সেটি দেখবেন। কি জ্বালানি ব্যাবহার করতে চান সেটি দেখবেন। বয়লারটি ঠিক জায়গায় বসানো হচ্ছে কিনা, ঠিকমতো বসানো হচ্ছে কিনা সেগুলি দেখবেন। এরপর যদি ওঁর মনে হয় যে না, বয়লার স্থাপন করা নিরাপদ আছে, কেবল এরপরেই তিনি আপনাকে লাইসেন্স দেবেন।

এই লাইসেন্সটি আবার প্রতি বছর নবায়ন করতে হয়। কেন? কারণ এক বছরের মধ্যে বয়লারটির কি অবস্থা দাঁড়িয়েছে, আপনি নিরাপত্তা ব্যবস্থা মানছেন কিনা এইসব প্রতি বছর পরীক্ষা করে দেখতে হয়।


এই যে ফ্যাক্টরিটিতে বয়লার বিস্ফোরণ ঘটেছে, সেই ফ্যাক্টরির বয়লার লাইসেন্সের মেয়াদ পার হয়ে গেছে কিন্তু তার পরেও বয়লারটি চলছিল। তাইলে আপনি বলেন এতোগুলি মানুষের মৃত্যুর জন্যে আপনি কাকে দায়ী করবেন?

আগেই বলেছি, বয়লারের জন্যে প্রতিবছর লাইসেন্স নবায়ন করতে হয়। এই লাইসেন্স রিনিউয়ালের ব্যাপারটি শুধু একটি আনুষ্ঠানিকতার ব্যাপার না। এটা আপনার ট্রেড লাইসেন্স নবায়নের মতো ব্যাপার না বা বন্ডেড ওয়ারহাইজ লাইসেন্স নবায়নের মতো ব্যাপার না। বয়লার লাইসেন্স একটি নিরাপত্তা ইস্যু। বয়লার ফাটলে মানুষ মারা যাবে এটা সকলেই জানেন। লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ মানে বয়লারটি পরীক্ষা ও পরিদর্শনের সময় হয়ে গেছে। এটা না করলে মানুষ মারা যেতে পারে। এটা জেনে শুনেই কারখানার মালিক পক্ষ ব্যাপারটাতে গুরুত্ব দেয়নি।

তাইলে এই যে ১৩ জন মানুষ মারা গেলো, এতোগুলি মানুষ আহত হলো এর দায় দায়িত্ব কার? এটা কি নানারকম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে বুঝাতে হবে?

কিন্তু আপনি লক্ষ্য করবেন যে আমাদের এখানে এই বয়লার বিস্ফোরণের পর মালিকপক্ষের কাউকে গ্রেফতার করা হবে না। ওদের বিরুদ্ধে শ্রমিকের প্রাণহানির জন্যে কোন ফৌজদারি মামলা হবে না। অথচ স্বাভাবিক নিয়মে বয়লার বিস্ফোরণের পর একদম প্রথমেই ফ্যাক্টরির মালিক পক্ষকে গ্রেফতার করা দরকার ছিল। না, মালিক পক্ষ নিশ্চয়ই ইচ্ছা করে শ্রমিকদেরকে হত্যা করেনি। কিন্তু ওরা জানতো যে বয়লার নিয়ে অবহেলা করলে মানুষের প্রাণ যেতে পারে। এটা জেনেও ওরা গাফিলতি করেছে। তাইলে তার দায় দায়িত্ব ওরা কেন নেবেনা?


তরুণ বন্ধুরা, আপনাদেরকে এইসব বলার কারণ কি? একজন ইমতিয়াজ মাহমুদ ফেসবুকে এইসব লিখে দিলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? না। হবে না। কিন্তু আপনারা যখন সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দায়িত্ব নেবেন, তখন যদি এই কথাটি মনে থাকে তাইলে আপনারা দায়িত্বশীলভাবে কাজ করবেন। আপনারা আপনাদের আশেপাশের সকলকে- বিশেষ করে যারা শিল্প কারখানার সাথে কোন না কোনোভাবে জড়িত ওদেরকে, বলতে পারবেন, প্রশ্ন করতে পারবেন।

গার্মেন্টস মালিকরা বাংলাদেশে অনেক ক্ষমতাবান। আমাদের সরকার থেকে শুরু করে সকল প্রতিষ্ঠান ওদের কথায় ওঠে আর বসে। ওদের গাফিলতির জন্যে আমাদের দেশে কতো শ্রমিক প্রাণ দিয়েছে তার গোনাগাঁথা নাই। পায়ের তোলে পিষ্ট হয়ে, আগুনে পুড়ে, ভবনের নিচে চাপা পড়ে কিত পতঙ্গের মতো শ্রমিকরা মরে। কোনদিন কোন মালিকের জেল হয়না, বিচার হয়না। সরকার থেকে শুরু করে সবাই ব্যস্ত হয়ে যায়, মালিকদের লোকসান কিভাবে পুষিয়ে দিবে তার জন্যে। শ্রমিকের প্রাণের দাম ওদের কাছে কিছুনা।

তরুণরা এখনো নিজেদের বিবেক বিক্রি করেনি। তরুণদের মনে এখনো মানুষের প্রাণের জন্যে খানিকটা হলেও মায়া মহব্বত আছে। তরুণরা বুঝতে পারেন মানুষের কষ্ট। সেজন্যে আপনাদের কাছেই এই নিবেদনটি করি। আপনারা বিচার করবেন। ফ্যাক্টরি মালিকদের গাফিলতির জন্যে যদি প্রাণহানি হয়, তাইলে মালিক পক্ষের বিচার হবে না কেন? ওদের শাস্তি হবে না কেন?

তরুণ বন্ধুরা, আপনাদের কাছে বিচার দিয়ে যাই। একটা কিছু করুন। সে যৌবন তো ভাই অর্থহীন, যে যৌবন মানুষের কষ্টে ব্যথিত হয়না।

  • ইমতিয়াজ মাহমুদ: এডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। ইমেইল: [email protected]
  • [ফেসবুক থেকে]

আপনার মন্তব্য

আলোচিত