শাখাওয়াত লিটন

১৬ আগস্ট, ২০১৭ ১৩:০৬

প্রধান বিচারপতির উপর এত ক্ষোভ কেন?

প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর বাতিলে আপিলের রায়ের পর আলোচনা ও আক্রমণের কেন্দ্রে। ছবি: সংগৃহীত।

ক্ষুব্ধ একজন আওয়ামী লীগ নেতা অভিযোগ তুলেছেন, “রায়ের পর্যবেক্ষণে মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক হিসেবে স্বীকৃত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। এটা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক।”

আরেকজন নেতা পরোক্ষভাবে প্রধান বিচারপতির মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এমনকি একজন মন্ত্রী প্রধান বিচারপতিকে স্বাধীনতা বিরোধী হিসাবে আখ্যায়িত করতেও দ্বিধা করেননি। আপিল বিভাগের একজন সাবেক বিচারপতি, যিনি নানা কারণে সমালোচিত, তিনি ঘোষণা দিয়ে বললেন, “বঙ্গবন্ধুকে অবমাননা করে প্রধান বিচারপতি সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন।”

অন্য একজন মন্ত্রী, যিনি ইতিপূর্বে আদালত অবমাননার দায়ে সাজাপ্রাপ্ত, কোনো রাখ ঢাক না রেখে প্রধান বিচারপতিকে দায়িত্ব ছেড়ে চলে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন; না গেলে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করার হুমকি দেয়ার দুই দিন পর সরকারি দলপন্থি আইনজীবীরা তিন দিনের আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন।

অন্য আরেকজন মন্ত্রী প্রধান বিচারপতিকে এত বেশি তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে কথা বলেছেন যা মুদ্রণ অযোগ্য।

মাঠে ময়দানে যেকোনো অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেয়ার সুযোগ পেলেই মন্ত্রী এবং সরকারি দলের নেতারা প্রধান বিচারপতির দিকে কামান তাক করছেন। সবার টার্গেট প্রধান বিচারপতি।

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া রায়ে প্রধান বিচারপতির একটা মন্তব্য নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে এভাবেই ঝড় তুলেছেন সরকারের মন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতরা।

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে প্রধান বিচারপতি কি আসলেই বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কটূক্তি করেছেন; বঙ্গবন্ধুকে হেয় করেছেন?

প্রধান বিচারপতি লিখেছেন, “কোনো জাতি; কোনো দেশ; কোনো একক ব্যক্তির দ্বারা গঠিত হয় না।”

তিনি আরও বলেছেন, “আমরা যদি সত্যিকার ভাবে জাতির পিতার সোনার বাংলা গড়তে চাই তবে আমাদের অবশ্যই মাত্র একজন ব্যক্তি সব কিছু করেছেন বলে প্রচার করা ‘আমিত্বের’ আত্মঘাতী নেশা থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করতে হবে।”

এই বক্তব্যে কোথায় দেশের স্বাধীনতা অর্জনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বকে খাটো করা হয়েছে?

আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, “আমরা, বাংলাদেশের জনগণ, ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করেছি।”

প্রধান বিচারপতির মন্তব্যর প্রথম অংশ “কোনো জাতি; কোনো দেশ; কোনো একক ব্যক্তির দ্বারা গঠিত হয় না” কি সংবিধানের প্রস্তাবনার প্রতিধ্বনি নয়?

এই মন্তব্যে করার আগে প্রধান বিচারপতি দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস, স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার বীর জনগণের অসীম সাহসের পরিচয়; সংবিধানে প্রস্তাবনায় জনগণের সেই বীরত্বের স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয় আলোচনা করেছেন।

তিনি স্বাধীনতা-সংগ্রামের অর্জনে জনগণের সম্মিলিত শক্তিরও প্রশংসা করেছেন। সম্মিলিত শক্তিই পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে রুখে দিয়েছে। সংবিধানের প্রস্তাবনায় “আমরা, বাংলাদেশের জনগণ” কথাটির মাধ্যমে জনগণের বীরত্বের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

সংবিধানের ৭ নং অনুচ্ছেদে জনগণকে রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার মালিক ঘোষণা এবং সংবিধানকে তাদের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি হিসেবে ঘোষণা করে এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় জনগণের অবদানকেই সবার উপরে স্থান দেয়া হয়েছে। আর বঙ্গবন্ধু সেই জনগণের অবিসংবাদিত নেতা।

বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা গড়তে আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন। প্রধান বিচারপতির মন্তব্যে এ প্রসঙ্গও উল্লেখ হয়েছে। তবে তিনি বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা গড়তে একটা বড় ঝুঁকির কথা বলেছেন। “আমরা যদি সত্যিকার ভাবে জাতির পিতার সোনার বাংলা গড়তে চাই তবে আমাদের অবশ্যই ‘আমিত্বের’ আত্মঘাতী নেশা থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করতে হবে”-এই মন্তব্যর মাধ্যমে তিনি আমাদের বর্তমান অসুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির দিকে ইঙ্গিত করেছেন।

ব্যক্তি বন্দনায় পঞ্চমুখ সবাই। বড় রাজনৈতিক দলগুলো এখন ব্যক্তি কেন্দ্রিক। তাদেরকে ঘিরে অসুস্থ একটা বলয় কি গড়ে উঠেনি? মন্ত্রিসভা থেকে শুরু করে নানা প্রতিষ্ঠান ব্যক্তি কেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। যখন যে দল ক্ষমতায় আসে তারাই দাবি করছে যে তারাই সবকিছু করছে, অতিতে অন্যরা কিছু করেনি। আর সব কিছু হয়েছে তার বা তাদের দলের সুপ্রিম নেতার কারণে। এটা কী একটা আত্মঘাতী নেশা নয়? স্বাধীনতার ৪৬ বছরে কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে না উঠার জন্য এই সংস্কৃতি কি কম দায়ী?

মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ দাবি করেছিলেন যে, তিনি তার স্টেনোগ্রাফারকে নিয়ে স্বাধীন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেছেন। এমন উদ্ধত মনোভাব পাকিস্তানের জন্য সুফল বয়ে আনেনি। গণতন্ত্রের লেশমাত্র ছিল না সেই পাকিস্তানে। শোষণ নিপীড়নের যাঁতাকল থেকে বীর বাঙালিরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে নিজেদেরকে মুক্ত করে। বঙ্গবন্ধু সব সময় জনগণের বীরত্বের প্রশংসা করেছেন, তার বীর জনগণকে নিয়ে তিনি গর্ব করেছেন। স্বাধীন দেশের নতুন সংবিধানে তিনি তার জনগণের বীরত্বের স্বীকৃতি দিয়েছেন। অথচ সুপ্রিম কোর্টের রায়ে যখন তার সেই জনগণের বীরত্ব গাঁথা তুলে ধরা হল তাতে নাকি বঙ্গবন্ধু খাটো করা হয়েছে।

প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বকে খাটো করার অভিযোগ যারা করছেন তারা কি মনোযোগ দিয়ে রায় পড়েছেন? নাকি জেনে শুনে বুঝে নতুন বিতর্কের জন্ম দিতেই বঙ্গবন্ধুকে টেনে আনছেন?

রায়ে অন্য যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে তা থেকে জনগণের নজর ভিন্ন খাতে নিতেই কি বঙ্গবন্ধুকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে? দেশের অকার্যকর সংসদ, দুর্বল শাসন ব্যবস্থা, অসুস্থ রাজনীতি, নাজুক মানবাধিকার পরিস্থিতি, ব্যাপক দুর্নীতিসহ নানা বিষয়ে রায়ে কড়া সমালোচনা করা হয়েছে। সে সবের দায় খানিকটা আওয়ামী লীগ এবং বর্তমান সরকারের উপর বর্তায়। সরকারের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি রায়ের পর্যবেক্ষণকে পূঁজি করে সরকারবিরোধী অবস্থান জোরদার করতে চাইছে।

রায়ে যেসব বিষয়ে কড়া সমালোচনা করা হয়েছে সেসব নিয়ে যত বেশি আলোচনা হবে, তত ক্ষতি বর্তমান ক্ষমতাসীন দল এবং সরকারের। তাই আলোচনা অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিতে পারলে অনেক কিছুই ধামাচাপা পরে যাবে। বাস্তবে তেমনটা ঘটেছেও।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সরকারি দলের বর্তমান কৌশল হল রায়কে বিতর্কিত করা। সেই কৌশলের অংশ হিসেবেই কি সরকারি দলপন্থি আইনজীবীদের রায়ের বিপক্ষে মাঠে নামানো হয়েছে?

রায়ে প্রধান বিচারপতি যে অসুস্থ রাজনীতির কড়া সমালোচনা করেছেন তিনি নিজেই এখন সেই অসুস্থ রাজনীতির শিকার। রায়ের পক্ষে-বিপক্ষে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া রায়ের পর্যবেক্ষণের যৌক্তিকতাকেই প্রমাণ করে।

তবে দুঃখজনক বিষয় হল, বঙ্গবন্ধুকে টেনে আনা হয়েছে এই অসুস্থ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায়। দলীয় স্বার্থের রাজনীতিতে জড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতি কি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা হচ্ছে?

আমাদের স্মরণে রাখা উচিত যে, বঙ্গবন্ধু কোনো দলের সম্পত্তি নয়। তিনি জাতির পিতা, তিনি সবার। যারা তাকে অস্বীকার করে, খাটো করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে চায় সেটা তাদের সমস্যা; তাদের সংকীর্ণতা। আবার যারা তাকে পুঁজি করে রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করতে চায়, সেটাও তাদের রাজনৈতিক দৈন্য।

জনগণ ছিল বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির মূল শক্তি। জনগণের উপর ছিল তার অগাধ আস্থা, বিশ্বাস এবং ভালোবাসা। সে জন্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তার প্রত্যাশাও ছিল অনেক। দীর্ঘ রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়ে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছেন, দেশ পরিচালনার জন্য মাত্র এক বছরের মধ্য নতুন সংবিধান দিয়েছেন। সেই সংবিধানের কার্যকারিতা এবং সফলতার ভার তিনি জনগণের উপর ছেড়ে দিয়েছেন।

১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর, যেদিন গণপরিষদে আমাদের সংবিধান পাশ হয়, সেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে দিক নির্দেশনামূলক বক্তব্য দেন। সেখান থেকে একটা লাইন তুলে ধরা যেতে পারে। তিনি বলেছিলেন, “ভবিষ্যৎ বংশধররা যদি সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, তাহলে আমার জীবন সার্থক হবে, শহীদের রক্তদান সার্থক হবে।”

আজকের বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতার যে চেহারা তা বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাশার সঙ্গে কতখানি সঙ্গতিপূর্ণ?

  • শাখাওয়াত লিটন: সাংবাদিক।
  • [লেখা ফেসবুক থেকে নেওয়া]

আপনার মন্তব্য

আলোচিত