ইমতিয়াজ মাহমুদ

২১ আগস্ট, ২০১৭ ১৩:৪৩

আনিস মাহমুদের জন্যে শোক

অতঃপর তথাগত বুদ্ধ দ্বিপ্রহরের জন্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন, চীবর পরিধান করে হাতে ভিক্ষাপাত্র নিয়ে নির্গত হবেন তিনি বৈশালী নগরীতে ভিক্ষার জন্যে। ভিক্ষা আহরণ ও আহার গ্রহণের পর তিনি পূজনীয় আনন্দকে বললেন, 'আনন্দ, চল আমরা চপলা মঠের পাশে দিনের বাকি অংশ কাটাই।'

অনুগত আনন্দ বললেন, 'তবে তাই হোক প্রভু।' একটি মাদুর হাতে আনন্দ চললেন তথাগতের সাথে পায়ে পা মিলিয়ে।

চপলা মঠের পাশে আসন গ্রহণ করে তথাগত বললেন, 'আনন্দ, দেখ, কি চমৎকার এই বৈশালী নগর, এর মঠগুলি' এবং তথাগত বললেন, 'আনন্দ, যে ব্যক্তি আত্মার শক্তির চারটি অনুষঙ্গ আয়ত্ত করেছে, অধ্যয়ন করেছে, আত্মস্থ করেছে এবং তাঁর পরিপূর্ণতায় পৌঁছেছে, তিনি চাইলে পৃথিবীর শেষ দিনটি পর্যন্ত বর্তমান থাকতে পারেন। তথাগত, হে আনন্দ, এই সকল কিছুরই পরিপূর্ণতায় পৌঁছেছেন, সুতরাং তথাগত চাইলে জগতের শেষ দিনটি পর্যন্ত বর্তমান থাকতে পারেন।'

আনন্দ, আহা পূজ্য আনন্দ সেই ইঙ্গিত বুঝতে পারলেন না। তিনি একবার বললেন বটে, 'তবে তথাগত থাকুন, পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত থাকুন জগতের সকলের সুখের জন্যে আনন্দের জন্যে।' কিন্তু তথাগত যখন দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার একই ইঙ্গিত করলেন, পূজ্য আনন্দ চুপ করে শুনলেন, এবং তৃতীয়বার তিনি আর তাঁর প্রার্থনা ব্যক্ত করলেন না।

পূজ্য আনন্দ সেদিন বুঝতে পারেননি, তথাগত বুদ্ধ তাঁর মহা-পরিনির্বাণের ইঙ্গিত করলেন আনন্দের কাছে, জীবন ধারণের আকাঙ্ক্ষার তিনি সেখানেই সেদিন অবসান ঘটিয়েছেন।


প্রাপ্তি বসে আছে আনিসের সম্মুখে। হাসপাতাল। আনিস ক্ষীণকায় হতে হতে শরীর যেন প্রায় ত্যাগই করেছেন। সর্বক্ষণ সর্বদা যন্ত্রণাকাতর শরীর। নিষ্ঠুর ব্যাধি তাঁর ছাপ ফেলেছে আনিসের সারা অঙ্গে- কেবল চোখ জোড়া উজ্জ্বল- আনন্দময়। আনিস প্রাপ্তির কুশল জিজ্ঞাসা করে, কেমন আছেন প্রাপ্তির পিতা প্রাপ্তির মাতা এবং অন্য সকলে। আনিস আনন্দিত, প্রাপ্তি এসেছে সেই সুদূর পাহাড় থেকে, যেখানে বাতাসে আনিসের ভালোবাসা মিশে থাকে।

ক্ষীণকণ্ঠে তিনি প্রাপ্তিকে জিজ্ঞাসা করেন, 'প্রাপ্তি, তোর কি আনন্দের সাথে কথা হয়েছে?' না, প্রাপ্তি জানেনা আনন্দের খবর। কেমন আছে আনন্দ? 'আহা আনন্দের কতোই না যন্ত্রণা ঝামেলা বিড়ম্বনা, প্রাপ্তি কি জানে আনন্দের খবর?' প্রাপ্তি টেলিফোনে ধরে আনন্দকে, আনন্দ কি জানেন আনিস হাসপাতালে? আনন্দ জানে। আনন্দ আনিসের খবর জানতে চান। প্রাপ্তির দ্বিধা- আনিসের সামনে প্রাপ্তি বলেনা ব্যাধির কথা আনন্দকে।

সন্ধ্যায় আবার কথা হয় প্রাপ্তির আনন্দের সাথে। 'আনন্দ, আনিস আপনাকে দেখতে চেয়েছে, বারবার জানতে চেয়েছে আপনার কথা, আনন্দ, আনিস আপনাকে দেখতে চেয়েছে, আমাকে বলেছে আনন্দকে নিয়ে আয়, আমি আনন্দকে দেখতে চাই।' আনন্দ কি প্রাপ্তির কাতরতা টের পায়? কে জানে? আনন্দ কি উপেক্ষা করে আনিসের আহ্বান?

বৈশালীতে সেদিন বিকেলে পূজ্য আনন্দ বুঝতে পারেননি তথাগতের ইঙ্গিত।


আজ সন্ধ্যায় আনিস মাহমুদের মৃত্যু হয়েছে।


আজ সন্ধ্যায় প্রাপ্তি আমাকে ফোন করেছে। প্রাপ্তি চলে গেছে রাঙা। পাহাড়ে যেখানে বাতাসে আনিস মাহমুদের ভালোবাসা মিশে আছে। 'আপনি তো যাওয়ার কথা আনিস ভাইকে দেখতে, আপনি কি গিয়েছিলেন? কেন গেলেন না? কেন গেলেন না? কেন গেলেন না?' আমার কোন জবাব ছিল না।

বৈশালীতে সেদিন বিকেলে পূজ্য আনন্দ বুঝতে পারেননি তথাগতের ইঙ্গিত।


কবিতায় যেদিন জেনেছি 'আমিই আনন্দ', চিৎকার করে পৃথিবীকে বলেছি, আমিই আনন্দ আমিই আনন্দ আমিই আনন্দ। সেদিন আনিস ভাইও বলেছেন বুক ভরা নিঃশ্বাস নিয়ে, 'আমিও আনন্দ'। আমি সেদিনও জানতাম, এই আন্দন্দটি নিবে যাবে অতি দ্রুত। সেদিন কান্না পাচ্ছিল খুব, কেঁদেছি।

আজকে কাঁদতে ইচ্ছে করছে না আনিস ভাই। বৈশালীতে সেই দিন সেই রঙিন বিকেলে পূজ্য আনন্দ বুঝতে পারেননি তথাগত জীবনের ইচ্ছা ত্যাগ করেছেন। ওরা বলে আনন্দ কেন তৃতীয়বার বললেন না, 'তথাগত আপনি থাকুন জগতের শেষ দিনটি পর্যন্ত।' বৈশালীতে সেদিন বিকেলে পূজ্য আনন্দ বুঝতে পারেননি তথাগত চলে যাবেন।

ও সিদ্ধার্থ, হে তথাগত বন্ধু আমার, আপন আলোয় আলোকিত বুদ্ধ, তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করি। জগতে সকল স্বত্বা সুখী হোক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত