রাজেশ পাল

১৭ অক্টোবর, ২০১৭ ০২:১৮

খান আতাউর রহমান ও ‘রাজাকার’ বিতর্ক

অভিনেতা এবং চলচ্চিত্রকার মরহুম খান আতাউর রহমানকে ‘রাজাকার’ বলা নিয়ে চলচ্চিত্রকার নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর বক্তব্যকে সর্বাত্মক সমর্থন জানাচ্ছি।

খান আতাউর রহমান নিঃসন্দেহে একজন গুণী শিল্পী ও চলচ্চিত্র নির্মাতা ছিলেন। সিরাজউদ্দৌলা চলচ্চিত্রে তাঁর ‘মোহনলাল’ চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় এখনো চোখে ভাসে। কিন্তু ৭১-এ যে তিনি পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন এবং রেডিও টেলিভিশনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন প্রকাশ্যই, এটা ঐতিহাসিক সত্য।

লেখক, গবেষক মাহফুজুর রহমানের “বদি মিয়া রাজাকারের ডায়েরী” বইটির পৃষ্ঠা ২৪৫ এ পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বনকারী দালাল শিল্পীদের তালিকার ৫৩ নং এ খান আতাউর রহমান এর নাম উল্লেখ আছে সুস্পষ্টভাবেই। আরও উল্লেখ আছে পাকিস্তানের অখণ্ডতার পক্ষে তার বিভিন্ন অনুষ্ঠান পরিচালনা করার বিষয়টিও।

যে ৫৫ জন বুদ্ধিজীবী ও শিল্পী ১৯৭১ -এর ১৭ মে মুক্তিযুদ্ধকে ‘আওয়ামী লীগের চরমপন্থিদের কাজ’ বলে নিন্দাসূচক বিবৃতি দিয়েছিলেন, দুঃখজনকভাবে খান আতাউর রহমান তার ৯ নম্বর স্বাক্ষরদাতা ছিলেন। (১৭ মে ১৯৭১ দৈনিক পাকিস্তান)

এব্যাপারে রাইজিংবিডি নিউজপোর্টালকে মুক্তিযোদ্ধা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম বলেন, ‘খান আতা পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিলেন’।

তিনি বলেন, “২৫ মার্চের পর দশ হাজার মানুষকে হত্যা করেছিলো পাকিস্তানিরা। ২৬ মার্চ যখন ঢাকার রাস্তার মানুষের রক্ত শুকায়নি তখন টেলিভিশন বন্ধ ছিল। ২৫ মার্চ পর্যন্ত আমরা বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ টেলিভিশন চালাচ্ছিলাম। ২৭ মার্চ যখন প্রথম টেলিভিশন খুললাম তখন আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে দেখলাম, খান আতা একটা গান লিখে নিয়ে গেছেন। গানটি ছিলো ‘সাদায় সবুজ আমার পাকিস্তানি পতাকা’। বাচ্চাদের তিনি গানটি শিখিয়েছিলেন। পরে শুনলাম আর্মিদের জিপে করে বাচ্চাদের তুলে আনা হয়েছিলো। এরপর তিনি আমাদের শিল্পীদের ধরে ধরে টেলিভিশনে নিয়ে যান। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর খান আতা তার বোনের বাড়িতে চিলেকোঠায় লুকিয়ে ছিলেন।

খান আতার একজন সহকারী ছিলো আমীর আলী। ২২ তারিখ আমি যখন মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশে ফিরলাম তখন আমীর আলী একটা মোটরসাইকেল নিয়ে এসে আমাকে বলে, আতা ভাই আপনার খোঁজ করছেন, আপনি চলেন। আমি ওর সঙ্গে গিয়ে দেখি, ফুলবাড়িয়ার একটি চিলেকোঠায় দরজা লাগিয়ে বসে আছেন আতা ভাই। আমরা যাওয়ার পরে তিনি বললেন, তুমি আমার সম্পর্কে কিছু বলছো না কেন? তোমরা মুক্তিযোদ্ধা। এখন কত কাজ করার আছে। আমি তাকে বললাম, আপনি এখন বের হবেন না। বের হলে কেউ আপনাকে বাঁচাতে পারবে না। কারণ মানুষের অনেক ঘৃণা জন্মেছে আপনার ওপর। তারপর প্রায় চারমাস লুকিয়ে থেকে পরিস্থিতি যখন ঠাণ্ডা হয় তখন তিনি বের হন।”

হাসান ইমাম আরও বলেন, “১৫ আগস্ট যখন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয় তখন তিনি কাকরাইল মোড়ে শ্যাম্পেইন খুলে সেলিব্রেট করেন। সেদিন ১১:৩০টার দিকে রেডিওতে তিনি একটি গান নিয়ে যান- ‘আঁধারের সীমানা পেরিয়ে আজ এসেছি সীমানায়’। গানটি শিল্পীদের দিয়ে রেকর্ডিং করিয়ে রেডিওতে প্রচার করা হয়েছিলো। পাকিস্তানের সঙ্গে কোলাবরেট করেছেন কারা এই তালিকায় খান আতার নাম এক নাম্বারে।”

মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের পক্ষে প্রচার চালাতে যারা বাধা দিয়েছিল, যারা পাকিস্তানপন্থী প্রচারে সহযোগিতা করেছিল, তাদের শনাক্ত করতে বাংলাদেশ সরকার শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক নীলিমা ইব্রাহীমকে প্রধান করে ছয় সদস্যের কমিটি গঠন করেছিল। ১৯৭২ এর ১৩ মে নীলিমা ইব্রাহীম কমিটি যে তালিকা সরকারকে পেশ করেন, সে তালিকায় ৩৫ নম্বর নামটি খান আতাউর রহমানের।

খান আতাউর রহমানের পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি “আবার তোরা মানুষ হ”-তে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে দেখানো হয় নেতিবাচক চরিত্রে। যা আর কোন ছবিতে দেখানোর স্পর্ধা হয়নি কারো। ছবির নামটিও যথেষ্টই আপত্তিকর। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের বলছেন আবার মানুষ হতে! তার মানে অমানুষরাই কি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন? আর ‘মানুষ’ ছিলো রাজাকার আলবদররা?

আর খালেদ মোশাররফের ব্রেইন চাইল্ড লেজেণ্ডারি “ক্র্যাক প্লাটুন” এর গেরিলা, নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর সমালোচনা যারা করছেন, তাদের নিজেদের অবস্থান কী সেই আগুন ঝরা দিনগুলো সম্পর্কে, সেই প্রশ্ন করে অহেতুক আর লজ্জা দিতে চাইনা কাউকে।

  • রাজেশ পাল: অনলাইন এক্টিভিস্ট।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত