মাসকাওয়াথ আহসান

২৭ মার্চ, ২০১৮ ১৫:১১

বিউটি

সায়েদ আলী তার মেয়েটির ধর্ষণের বিচার চেয়ে মামলা করার পর থেকেই; বাড়িতে প্রভাবশালীদের আনাগোনা বেড়ে যায়।

--যা হইছে হইছে; জিনিসটারে আর বাড়াইও না সায়েদ আলী। গ্রামে উন্নয়নের নহর বইতাছে; নেতারা উন্নয়ন কাজে ব্যস্ত। এই সময় এইসব খবর ব্রাহ্মণডোরার বাইরে গেলে; উন্নয়নের নহরে ভাটা পড়বো। মামলাডা তুইলা নেও। উন্নয়ন বাজেট থিকা তোমারে কম্পেনসেশান দেয়া হইবো; একটা আপোষ-রফা করন দরকার।

সায়েদ আলীর মাথায় হাত বুলিয়ে মাতবর সাহেব একনাগাড়ে কথাগুলো বলে। সঙ্গে উপবিষ্ট মোল্লাটি দোয়া পড়ে সায়েদ আলীর মাথায় ফুঁ দিয়ে বলে, শরিয়তের বিধান মাইনা চলতে বলো তোমার মাইয়ারে। বোঝো না কেন; মাইয়া মানুষ হইলো তেঁতুলের লাহান; তার ওপর পুরুষের চোখ পড়লে পুরুষ-মানুষের তো মাথা ঠিক থাকে না। তারে ভালো মতন ঢাইকা-ঢুইকা রাখো।

সায়েদ আলী কয়েকদিন হলো মুখে কিছুই দেয়নি। তার অনাহারী চেহারায় সব হারানোর হা-হুতাশ।

মোল্লা পকেট থেকে শুকনো খেজুর বের করে বলে, কেউ এক গ্লাস পানি আনো দেহি। তুমি হইলা মিয়া খড়ের কুটা; মামলা করছো বাচ্চা হাতি আর তার মায়ের বিরুদ্ধে। কার লগে লাগতে গেছো মিয়া জানো। এইডা খাও। এইসব মামলা-টামলা ছাড়ো। আমার তৃতীয় পক্ষের বিবি চক্ষে কিছু দেহে না। ঘরের কাজে সমিস্যা হয়। তুমি রাজি থাকলে আমার ঘরে তোমার মাইয়া সুখেই থাকবো।

মাতবর সাহেব একটা কার্ড এগিয়ে দিয়ে বলে, তোমারে কাজ-কাম করতে হইবো না; কাজের বিনিময়ে খাদ্যের ছেলেরা বাসায় এসে চাউলের বস্তা দিয়া যাইবো।

পাশের ঘরে মেয়েটি ছোট্ট সাদাকালো টিভিতে দেখে নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে টকশো হচ্ছে।

এক আপা ভ্রু নাচিয়ে বলছে, এডুকেশান সেক্টরে স্কলারশিপ দিয়ে নারী শিক্ষাকে ইনসপায়ার করা হয়েছে।

আরেক আপা তার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলছে, কিন্তু আমার মেয়ে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে যতটা সেইফ ফিল করে; ঢাকা ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসটা অত নিরাপদ নয়।

উপস্থাপিকা আপা আরেক আপার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে, আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে পড়েছি; কই কোন সমস্যা হয়নি। উপস্থাপিকা আপা চলে যায় তার গর্বিত আত্মজীবনীতে।

প্রথম আপা আত্মজীবনী থামিয়ে বলে, কিন্তু ধরুন আমার ছোট বোন টরেন্টোতে থাকে; ওর হাজব্যান্ড যেভাবে ডোমেস্টিক কাজে হেলপ করে; আমার হাবি তো তা করে না।

দ্বিতীয় আপা ক্ষিপ্ত হয়ে বলে, আমি তো আমার হাজব্যান্ডরে বলসি, নিজের পাস্তা নিজে বানাইয়া খাইবা; আমি বড় জোর সালাদ কেটে দেবো। ঘরের পুরুষতান্ত্রিক জেন্ডার প্রাইড ঘরেই ঠেকাতে হবে; চ্যারিটি বিগিনস এট হোম।

মা এসে মেয়েটাকে ডাকে, অমা এইদিকে আয়; সাচ্চু মিয়া দেখা করতে আসছে।

সাচ্চু মিয়ার ঘাড়ের চর্বিতে তিনটি ভাঁজের মধ্যে একটি সোনার চেইন চিক চিক করছে; কখনো সেটাকে উন্নয়নের ঘাম বলে ভ্রম হয়।

সাচ্চু মিয়া মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, তুমি চিন্তা করিও না বইন। তোমার এই ভাই থাকতে আর কোন ভয় নাই।

মেয়েটা ভয় পায়; সাচ্চু ভাইয়ের স্পর্শের মধ্যে ঘিনঘিনে একটা ব্যাপার। সে ভয় পেয়ে পাশের ঘরে চলে যায়।

টিভিতে তখন আরেক টকশো চলছে, উন্নয়নবিদ বলছে, জিডিপি গ্রোথ; পার ক্যাপিটা ইনকাম, আর স্টেবল ব্যাংক রিজার্ভ; এই তিনটা জিনিসই বলে, আমরা এখন উন্নয়নের দুরন্ত সহিস।

উপস্থাপক বলে, চলুন দর্শক আপনাদের এক ঝলক দেখিয়ে দিই উন্নয়নের পরিসংখ্যান।

খুব ভোরে সায়েদ আলী মেয়েটিকে তার নানা বাড়ি রেখে আসে। যেভাবে প্রতিদিন বাড়িতে শুভাকাঙ্ক্ষীর ভিড় বাড়ছে; মরা গরুর ওপর শকুন পড়ে যেমন। তার চেয়ে মেয়েটা কয়েকটাদিন দূরে গিয়ে একটু শান্তিতে থাকুক।

ফেরার পথে থানায় গিয়ে পুলিশের বড় কর্তার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করে। কর্তা টিভি দেখছে। টিভিতে উন্নয়ন বিষয়ক কথকতা চলছে। ফলে সায়েদ আলীর সঙ্গে কথা বলার সময় কর্তা করতে পারে না।

সায়েদ আলী হতাশ হয়ে বাড়ির পথে হাঁটতে থাকে। মাফলারে বাঁধা পদ্মমুখ তরুণ পথ রোধ করে দাঁড়ায়।

--মাইয়ারে নানার বাড়ি পাঠাইছস। এইদিকে মামলা করছোস। ঝাড়ে-বংশে উধাও কইরা দিমু। আমারে চিনস!

এরপর একদিন হাওরের পাশে সবুজ ঘাসের মধ্যে লাল সালোয়ার কামিজ পরা একটি মলিন পতাকা হয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায় মেয়েটিকে।

পাশের পথ দিয়ে ঢাক-ঢোলক-কাসর বাজিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে উন্নয়নশীলতা উদযাপনের মিছিল।

  • মাসকাওয়াথ আহসান: সাহিত্যিক, সাংবাদিক।
  • প্রকাশিত লেখায় মতামত, মন্তব্য, দায় লেখকের নিজস্ব।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত