আরিফ জেবতিক

১৮ জুন, ২০১৮ ১৬:৩৩

সুমন জাহিদের কাটা মস্তক

মা আর সুমনের ছোট সংসার ছিল। ৭ বছরের সুমনকে ভাত খাইয়ে শেষ করতে না করতেই আল-বদরের দল কড়া নেড়েছিল দরজায়। ছোট্ট সুমনকে রেখে মাকে টেনে হিচড়ে নিয়ে তুলেছিল গাড়িতে। সেই মায়ের লাশ সুমন সনাক্ত করেছিলেন বধ্যভূমিতে,স্বাধীনতার পর।

এই যে ভয়ংকর ট্রমার ভেতর দিয়ে যার শৈশব কেটে গেল, মাদ্রাসার হোস্টেল আর আশ্রিতের মতো এখানে ওখানে শয্যা পেতে যে ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠল, বড় হওয়ার পথে মায়ের খুনিদের বিচারের দাবিতে সংগ্রাম করল, মায়ের নামে করা রাস্তার দোকানের সাইনবোর্ডগুলোতে মায়ের নাম বসাতে যে তুলি হাতে হাতে ঘুরল..এমন জীবনভর লড়াকু একটা মানুষ কী অনায়াসেই না মাথা পেতে দিল রেললাইনে।

যে লুটপাটতন্ত্র আমাদের আষ্টেপৃৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে, সেই লুটপাটের পেষনে এক বিশাল জনগোষ্ঠি তিলেতিলে মরে যাচ্ছে। শেয়ার বাজারে লুটপাট হলো, আমরা ঠোঁট উল্টে বললাম, 'লোভী বাঙালি ধরা খেয়েছে।' কিন্তু এই যে পরিকল্পিতভাবে গ্রামে গঞ্জে শেয়ার মার্টেকের দোকান খুলে কৌশলে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নিল কিছু লোক-এর কোনো বিচার হলো না।

এই যে সরকারি ব্যাংকগুলোতে নিজেদের লুটেরাদের বসিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হলো, তার কোনো বিচার হলো না। বেসিক ব্যাংক লুটেপুটে খেয়ে বাচ্চুরা গোফে তা দিয়ে বেড়ায়, অর্থমন্ত্রী বলেন বাচ্চুকে কিছুই করা যাবে না। এই বাচ্চুদের তাহলে ক্ষমতার উৎস কোথায়? ফার্মারস ‌ব্যাংক সহ অনেকগুলো নতুন ব্যাংক অনুমোদন দেয়ার সময় অর্থনীতিবিদরা হইচই করেছিলেন, বলেছিলেন, এই অর্থনীতি নতুন ব্যাংকের চাপ নিতে পারবে না। অথচ ব্যাংক দেয়া হলো। ভাবখানা এমন ছিল, 'আমরা লুটের শিন্নী খাই হাড়ি থেকে, হাড়িতে জায়গা নেই, তবে তোরাও যদি পাত্র নিয়ে আসিস তবে সেই পাত্রে কিছু ঢেলে দিতে পারি।'

ফার্মারস ব্যাংকের মতো হাড়ি নিয়ে তাই সাবেক আমলা-বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক-ছাত্রনেতা সবাই এলো লুটের ভাগ নিতে। ইসলামী ব্যাংকের মতো একটা বিশাল বড় ব‌্যাংক জামাতিদের খপ্পর থেকে উদ্ধার করে যথেচ্ছা ঋণ বিতরণ করে এত দ্রুত কীভাবে দুর্বল বানিয়ে ফেলা যায়, এটি এই শতাব্দীর অন্যতম বড় বিষ্ময়!

সুমন জাহিদ-একাত্তর যাকে খুন করতে পারেনি, আঠারো তাঁকে খুন করল।

আত্মহত‌্যা নাকি কাপুরুষের কাজ, কিন্তু আমি সুমন জাহিদকে বলি বীরপুরুষ। আমি তাঁকে সাহসী বলি কারন সে এই অনাচারের বিরুদ্ধে নিজের মতো করে প্রতিবাদ করে মরে গেছে। আমরা, বাকিরা মরতেও পারিনি, বাঁচতেও পারি না। শেয়ার বাজারে নিঃস্ব হওয়া লাখ লাখ মানুষ বেঁচে থাকা লাশ হয়ে হেটে বেড়াচ্ছে আমাদের আশেপাশে।

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে শুরু করে ফার্মারস ব্যাংক-সব ছিবড়া হওয়ার মূল্য চুকাচ্ছে শত সহস্ত্র সুমন জাহিদ। সুকৌশলে তৈরি করা অর্থনীতির এতো বড় একটা দুর্যোগ আগামীতে আমাদেরকে আরো জীবিত লাশ বানিয়ে রাখবে।
আর আমরা আত্মপ্রবঞ্চনা দিচ্ছি বিশ্বকাপের ট্রলে।

সাহসী সুমন জাহিদের কাটা মস্তক আমাদেরকে তাড়া করে বেড়ায় না।
সুমন জাহিদরাই জীবিত, আমরাই বরং মরে আছি-শুধু বুঝতে পারছি না।

(ফেসবুক থেকে সংগ্রহিত)
আরিফ জেবতিক: লেখক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত