সিলেটটুডে ডেস্ক

২১ জুলাই, ২০১৮ ১৬:২৮

শোক আর স্মৃতিতে রাজীব মীর

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক সহযোগী অধ্যাপক রাজীব মীর মারা গেছেন। শুক্রবার রাতে ভারতের চেন্নাইয়ের গ্লোবাল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।

লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত রাজীব মীর ১৯৭৬ সালে ভোলা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের স্নাতকোত্তর রাজীব নিয়মিত লেখালেখি করতেন। তার প্রকাশিত বইগুলোর মধ্যে কাব্যগ্রন্থ ‘প্রেমে পড়েছে পাথর’, ‘মুক্তিযুদ্ধের কিশোর ইতিহাস: ভোলা জেলা’, জেন্ডার সাংবাদিকতা, মুক্তির ভাষা, সংবাদপত্রে শাহবাগ, তোমার জন্য লিখি অন্যতম।

রাজীব মীরের মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ তার বন্ধু-অনুরাগী সহ অনেকেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এনিয়ে শোকাবহ স্মৃতি লিখছেন অনেকেই। ফেসবুকে রাজীব মীরের স্মৃতি রোমন্থনের কিছু লেখা সিলেটটুডের পাঠকদের উদ্দেশে...

কাবেরী গায়েন
অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
রাজীব মীরকে আমি ছাত্র হিসেবে পাইনি। প্রথম পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন রোবায়েত সদা হাসিমুখের এই ছেলেটির সাথে। এরপর অনেকবার দেখা হয়েছে। প্রতিবারই তার হাসিমুখ অল্পপরিচয়ের দূরত্বকে হটিয়ে দিয়েছে।

আমাদের তরুণ সহকর্মী সাইফুল ইসলাম ফারুকির বিয়েতে যখন চট্টগ্রাম যাই, তখন একটা কাজ সাথে নিয়ে যেতে হয়েছিলো, পরদিনই ছিলো জমা দেবার শেষদিন। কোথায় নিরিবিলি কাজ করবো? রাজীব তখনো বিয়ে করেননি। কিন্তু তাঁর সাজানো বেশ বড় বাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন। আমাকে তাঁর কম্পিউটার খুলে দিয়ে বাইরেও চলে গেলেন। সাথে সাথে ছিলেন আমাদের, কিন্তু কী একটা কারণে বিয়েতে যোগ দিতে চাননি। শেষ পর্যন্ত দিয়েছিলেন কি না, আজ আর মনে নেই।

রাজীবের সাথে দেখা হয়েছে শহীদ মিনারে নানা আন্দোলনে। আগাগোড়া অসাম্প্রদায়িক রাজীব মীরের সাথে দেখা হয়েছে শাহবাগ আন্দোলনে। দেখা হয়েছে, পিজি হাসপাতালে। আমি হেফাজতের তাড়ায়-আক্রমণে আহত নাদিয়া শারমিনকে দেখে নীচে নামার সময় দেখা হল। ওর একজন শিক্ষার্থীও ছিলেন সাথে। খুব উচ্ছ্বসিতভাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। আমি ওকে তাড়া দিলাম ভিজিটিং আওয়ার শেষ হয়ে যাবে, গেলে যেনো দ্রুতই যান। শেষ দেখা হয়েছিলো, সেও তাড়ার মধ্যে। গিয়েছিলাম বেগম রোকেয়া দিবস উপলক্ষে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রইউনিয়নের অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের কোন বর্ষের পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের মডারেশন করছিলেন, তবুও অল্প সময়ের জন্য দেখা করে গিয়েছিলেন নীচে নেমে।

সেই অল্প অল্প সময়ে দেখা হওয়া রাজীব মীর আর কোনদিন দেখা না হবার জগতে চলে গেছেন অসময়ে, তাড়াহুড়োয়। হাসিটা রেখে গেছেন শুধু ।

রাজীব, আমি আপনার সেই হাসিটাই দেখতে পাচ্ছি শুধু।

জাহিদ নেওয়াজ খান
সম্পাদক, চ্যানেল আই অনলাইন
রাজীব মীরের সঙ্গে পরিচয় অনেক বছরের। তবে, ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারির আগে তাকে ওইভাবে চেনাজানা হয়নি। ওই বছরের বইমেলায় আমার প্রথম বই প্রকাশিত হয়। শ্রাবণ থেকে রাজীবেরও একটি বই। তখন অনেকদিন আমরা শ্রাবণের স্টলে একসঙ্গে অনেক সময় কাটিয়েছি। আমি মিষ্টি খেতে পারি না, তারপরও তার একটি কাব্যগ্রন্থের প্রকাশনা উপলক্ষে একটা মিষ্টিও খেতে হয়েছিল। সবসময় সে নিজে আনন্দের মধ্যে থাকতো, অন্যদেরও রাখতো আনন্দের মধ্যে।

বইমেলা যেদিন শেষ, রাজীব জানতে চেয়েছিল কীভাবে ফিরবো? অফিসের দেওয়া গাড়ি আছে জেনে লিফট চেয়েছিল সে। সে মানে সে একা না, তার সাঙ্গোপাঙ্গ কয়েকজন ছাত্রসহ।

পান্থপথে নামিয়ে দেওয়ার সময় চায়ের নিমন্ত্রণ করলো রাজীব। তার বাসা যেখানে ওই এলাকায় আমি ১৫ বছর বাস করেছি। তাই পুরনো গন্ধ নতুন করে পাওয়ার লোভে নেমে গেলাম। রাস্তার পাশে একটি চায়ের দোকানে বসেছিলাম আমরা।
এরপর দীর্ঘ আড্ডা। ঘণ্টাখানেক সময়ের মধ্যে চার/পাঁচ কাপ চা খেয়েছিল সে। এ নিয়ে একটু সতর্কও করেছিলাম। যথারীতি তার ভুবন ভোলানো হাসি।

সেদিনের আড্ডায় সাংবাদিকতা, সাংবাদিকতার শিক্ষা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগের উন্নয়ন আর উন্নতির অনেক পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিল রাজীব মীর।

সেসব আর হয়নি। রাজীব মীরের বন্ধুরা জানাচ্ছেন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের দলাদলির শিকার হয়েছিল সে। পরে সেটা উচ্চ পর্যায়ে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার হয়েছিল।

রাজীব মীর এখন সব ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবে, মনের প্রভাব যে শরীরে পড়ে সেটা তার বন্ধুরা বলছেন।

২০১৬ বইমেলার পর ২০১৭ বইমেলাতেও রাজীবের সঙ্গে অনেক কথা হয়েছে। এবছর তেমন একটা যেতে পারিনি মেলায়। এর মধ্যেও একদিন তার নতুন কাব্যগ্রন্থ নিয়ে এসেছিলাম। এর মাসখানেক পরই জানা গেলো, রাজীব মীর অসুস্থ। ভারতেও নিয়ে যাওয়া হলো তাকে। তার বন্ধুরা সব চেষ্টাই করছিল। কিন্তু, অনেকদিন বেঁচে থাকার যে বর রাজীব চেয়েছিল, সেটা আর হলো না।

সব প্রার্থনা আর চেষ্টা করে রাজীব মীর চলেই গেলো

ইমতিয়াজ মাহমুদ
এডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
কতো লোকই তো মারা যায় প্রতিদিন। বনানী কবরস্থানে আমি মাঝে মাঝে যাই ফটো তুলতে। বিশাল কবরস্থান গিজগিজ করছে মৃত মানুষের নাম আর সামাজিক অর্জনের আর পরিচয়ের খতিয়ানে। নিয়তই যুক্ত হয় নয়া নয়া নাম। সকল মৃত্যু আপনাকে প্রকৃতই ব্যথিত করে না, সকল মৃত্যু আপনাকে ক্রুদ্ধ করে না, সকল মৃত্যু আপনাকে বিচলিতও করবে না। কিন্তু এই তরুণ অধ্যাপকটির মৃত্যুতে কেন জানিনা একটু বিষাদগ্রস্ত হয়েছি।

প্রথম আলোর ব্রেকিং নিউজে পুরো নামটা পড়ার আগে পর্যন্ত আমি জানতাম না ওর নাম মীর মোরাশফ হোসেন। আমি তো সবসময়ই জানতাম যে ওর নাম রাজীব মীর। এই নামেই লেখালেখি করতো, এই নামেই সভা সমাবেশে বক্তৃতা করতো ফেসবুকেও ওর নাম ছিল ওটাই। রাজীব মীর।

আমার সাথে সামনাসামনি কোনদিন দেখা হয়নি। টেলিফোনে বা অনলাইনেও কোন কথাবার্তা হয়নাই। দেখা না হওয়া বা কথা না হওয়ার কারণ আমি নিজেই। আমি কোন সভা সমাবেশে যাইনা, লেখক সাংবাদিক এক্টিভিস্টদের সাথে আড্ডা ফাড্ডা দেই না। টেলিভিশনে যাইনা, সামাজিকতা বা পার্টি ফার্টি ঐসব এখন আর করিনা। দেখা হবে কি করে?

আমাদের নিজেদের মধ্যে সংযোগ ছিল শুধু ঐটুকুই, আমাদের বেশ কিছু ছেলেমেয়ে ছিল যারা রাজীবের সাথেও ঘনিষ্ঠ ছিল আর আমাকেও চিনতো। আর ছিল ফেসবুকে বন্ধুত্ব। রাজীব মীর আমার ফেসবুকের বন্ধু ছিল। আর রাজনৈতিক মতামতের ক্ষেত্রেও আমাদের কিছু মিল ছিল।

ফেসবুকে রাজীব যখন আমাকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠায় সে তখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। খ্যাতিমান লোক ছিল, ওর নাম জানতাম আগেই। এইরকম ক্ষেত্রে তো ফটাফট ওর ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট একসেপ্ট করে ফেলার কথা ছিল। কিন্তু ঠিক সেই সময়ই ওর নামে ঐসব কথা চলছিল, আমি ওর ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট একসেপ্ট করেছি অনেক পর।

আমার চেয়ে বয়সে ছোট ছিল, কিন্তু মেধায় ও প্রজ্ঞায় আমার চেয়ে বড় ছিল। এইটা কেবল মরে গেছে বলে ভদ্রতা করে বলছি না, খবরের কাগজে ওর লেখা ছাপা হতো, সেগুলি কিছু পড়েই বলছি। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের একটা অংশ তো আছেই যারা মাস্টারি করাটাকে কেবল একটা ভাল চাকরী হিসাবে গ্রহণ করে জীবন কাটিয়ে দেয়, রাজীব সম্ভবত সেরকম ছিল না।

প্রথম আলো থেকে ব্রেকিং নিউজ পাঠিয়েছে রাজীব মীর মারা গেছে। দৃশ্যতই ছিল না। ওর নামে যেসকল অভিযোগ শুনতে পেতাম সেগুলি সত্যি কি মিথ্যা জানিনা- এখন তো আর রাজীবের জন্যে সেসবের কোনপ্রাসঙ্গিকতাই নাই।

প্রথম আলো থেকে ব্রেকিং নিউজ পাঠিয়েছে রাজীব মীর মারা গেছে। কতো লোকই তো মারা যায় প্রতিদিন। এই তো গত কয়েক মাসে তিনজন মারা গেছে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের একই ব্যাচের ছাত্র ছিল। এই তিনজনের মৃত্যুর খবর কেবল আমাকে আরেকবার আমার অতিক্রান্ত জীবনের দৈর্ঘ্য স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। আর যতটুকু দৈর্ঘ্য আপনি অতিক্রম করবেন ততোই যে আপনি সমাপ্তি রেখার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন সেটা বলা তো বাহুল্যই।

কিন্তু রাজীবের মৃত্যুটা আমাকে বিষাদগ্রস্ত করেছে। কখনো দেখা হয়নি যে তরুণ অধ্যাপকটি, যাকে নিয়ে সকলে মিষ্টি কথা বলেন না, তার মৃত্যুতে বিষাদগ্রস্ত কেন হচ্ছি?

লীনা পারভীন
কলাম লেখক
ভেবে রেখেছিলাম রাজীবের জন্য সাহায্য তোলার কর্মসূচি নিয়ে যারা তাদের কুৎসিত মানসিকতাকে সামনে এনেছিলো সেইসব মানবতাহীন মানবদের নিয়ে একটা সমুচিত কিছু লিখবো। জমিয়ে রেখেছিলাম সেই ক্ষোভের জায়গাটি।

রাজীব আমার বন্ধু ছিলো। অনেক বছরের বন্ধু। রাজপথের একজন নিয়মিত যোদ্ধা ছিলো। অনেকের অনেক কাহিনী জানি আমরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক কর্মী হবার কারণে দেখেছি অনেক মানুষকে, জেনেছি অনেকের কাহিনী। কোনদিন ব্যক্তি আক্রমণের কথা মাথাতেও আনিনি। অনেকের অনেক কিছু জানা আছে আমাদের বন্ধুদের সবার। বলিনি, বলতে চাইনি। কী দরকার। যে যার সামাজিক মর্যাদা নিয়ে থাকুক।

ভেবেছিলাম রাজীব ফিরে আসুক। সমুচিত জবাবটা রাজীব নিজেই দিক। পাশে ছিলাম, আছি এখনও। কিন্তু রাজীব আমার সে ইচ্ছাটাকেও বাঁচতে না দিয়ে চলে গেলো সবকিছুর ঊর্ধ্বে। ফেইসবুকের বুকে রাজীবের ভুবন ভোলানো সেই হাসি আর তার কন্যা বিভোরের নিষ্পাপ মুখটি আমাকে কাঁদাচ্ছে।

একটা কবিতা বা পোস্ট দিলেই ইনবক্সে এসে বলে যেত, বন্ধু পোস্টটা দেখো একটু। কেমন হয়েছে জানাবা। রাজীব তার ঘটনা নিয়ে অনেকের কাছেই গিয়েছিলো। আমাকেও ব্যাখ্যা দিয়েছিলো। ব্যক্তিগতভাবে খোঁজ নিয়েছি আমি। জেনেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতির শিকার রাজীবের কাহিনী। রাজীবকে বলেছিলাম তুমি যদি সত্যি এমন করে থাকো তবে বিশ্বাস করো, তোমার বিরুদ্ধে লিখতে আমার হাত কাঁপবে না। চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলো রাজীব। সেই বিশ্বাসেই ছিলাম বন্ধু।

অন্তিম শয্যাতেও তুমি তোমাকে নির্দোষ দাবি করে ফেইসবুকের এই গালিগালাজ থেকে রেহাই পেতে চেয়েছিলে। শেষ পর্যন্ত চলেই গেলে তুমি। বইমেলা মানেই আমাদের আড্ডা আর ছবি তোলা ছিলো। এবার যেকোনো কারণে তোমার সাথে দেখা হয়নি। আর কখনও রাজীব মীরের সাথে কবিতা নিয়ে ইয়ার্কি হবে না। বইমেলায় হাসাহাসি করে ছবি তোলা হবে না। বুঝলাম, আমাদেরও বুঝি চলে যাবার দিন এগিয়ে এলো।

সোলায়মান সুমন
শিক্ষক ও গল্পকার
একটা ফুলের বাগান ঝড়ো হাওয়ায় তছনছ হয়ে গেল। একজন মেধাবী প্রাণ হারিয়ে গেল।

বিদায় বন্ধু রাজীর মীর। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন। ২০১৬ সালে সুমনা খানকে বিয়ে করেন রাজীব মীর। বিভোর নামের তাদের ১৫ মাস বয়সী কন্যা সন্তান রয়েছে।

তিনি লিভার সিরোসিস রোগে ভুগছিলেন। ২০ জুলাই, শুক্রবার দিবাগত রাত ১টা ৩৭ মিনিটে ভারতের চেন্নাইয়ের গ্লিনিগলস গ্লোবাল হেলথ সিটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়েছে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত