আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

যৌনতাকে যতদিন পর্যন্ত ট্যাবু করে রাখা হবে, ততদিন চলবে ধর্ষণ

ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা  

বাংলাদেশ পশ্চিমা রাষ্ট্র না। এর সংস্কৃতি, মানুষের ধরণ, ধর্ম সবকিছু আলাদা। সবই বুঝলাম- কিন্তু এসব ইসলামী রাষ্ট্র বা রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম বলে আদৌ কি কোন লাভ হচ্ছে? ইসলামী রাষ্ট্র বা রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম বলে আদৌ কি কোন লাভ হচ্ছে? প্রতিদিন বাংলাদেশে অগণিত ধর্ষণ হচ্ছে। লোক-লজ্জার ভয়ে কত নারী-পুরুষ তা লুকিয়ে রাখছেন, তার ইয়ত্তা নেই। পত্রিকায় আসছে শুধু খুন হয়ে যাবার পর! কতজন পরিমলের বিরুদ্ধে মানুষ দাঁড়াচ্ছে বলুন? আমাদের মগজ ধোলাই করে রাখা হচ্ছে ধর্মের নামে। বলা হচ্ছে- বিয়ের আগে কোন মেয়ে যৌন-সম্পর্কে জড়ালে সে আর সতী থাকবে না।

আমাদের দেশের বেশিরভাগ পুরুষেরা নিজে একশ ঘাটের পানি খেলেও বিয়ের সময় এমন নারীর সন্ধানে থাকবে; যার যোনীপর্দার রক্তে বাসররাতে বিছানার চাদর লাল হবে। তারা গর্ব করে বলেও আমার সতীবউ। সেই বউ কি একই গর্ব করতে পারে? বউ কি জানে, বিয়ের আগে তার স্বামী যৌন সম্পর্কে জড়িয়েছে কিনা? কিংবা কতবার -কতজনের সঙ্গে তার পতিদেব যৌনতার স্বাদ নিয়েছে? আর নেয়াটা তো স্বাভাবিক। কিন্তু একজন নারীর বেলায় তা হয়ে যায় পাপ। কেন? কারণ, আমরা সমাজব্যবস্থাকে এমনভাবে বেঁধে রেখেছি যা কিনা আমাদের নারীদের যৌনচাহিদা অবদমন করতে শেখায়।

আমাদের সমাজে মেয়েরা কেন পারে অবদমন করতে আর পুরুষেরা পারে না? মেয়েদেরকে যেভাবে ছেলেবেলা থেকে চোখে চোখে রাখার ব্যবস্থা করা হয়, ছেলেদের বেলায় তা হয় না। বলা হয়ে থাকে, একজন পুরুষের গায়ে দাগ লাগে না, কিন্তু একজন নারীর গায়ে সহজেই দাগ লাগে। দাগ লাগাটা কি? - যৌনপর্দা ফেটে যাওয়া। সে তো একটা মেয়ে খেলাধুলা করলেও হতে পারে। তাই আমাদের দেশে মেয়েদের খুব সহজে ভারী কোন খেলায় অংশগ্রহণ করতে দিতে রাজী হন না আমাদের অভিভাবকরা। অথচ পশ্চিমা রাষ্ট্রে যখন ক্লাস ফোর থেকে যৌনশিক্ষা দেয়া হয়, তখন এসব নারী যৌনপর্দার ধারও ধারে না শিক্ষকরা/ অভিভাবকরা। দাপটে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যেকোনো খেলায় অংশগ্রহণ করে। কেউ বলে দেয় না- ফুটবল ছেলেদের খেলা আর হাড়ি-পাতিল কিংবা পুতুল দিয়ে খেলা হচ্ছে মেয়েদের খেলা। একজন ডাক্তার এসে শিক্ষকদের সঙ্গে বসে ছাত্র-ছাত্রীদের ধারণা দেন- কিভাবে তারা এ পৃথিবীতে এলো। ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে একই শ্রেণীতে বসে সেই শিক্ষাগ্রহণ করে। এতে কি ধর্ষণ বেড়ে গেছে? না, বাড়েনি। বরং কারো মাঝে যদি যৌন-সম্পর্কের সৃষ্টি হয়, তা হয় স্বেচ্ছায়, জোরপূর্বক নয়।

ইউরোপে কি ধর্ষণ হয় না?
অবশ্যই হয়, কিন্তু পরিমাণটা দেখতে হবে। কেন অঢেলভাবে ধর্ষণ হয় না বলতে পারেন?
- হয় না কারণ, প্রথমত: এখানে যৌনতাকে ট্যাবু করে রাখা হয় না। ১৬ বছর হয়ে গেলে এখানকার বাবা-মায়েরা মনে করেন- তাদের ছেলে-মেয়েদের বয়স হয়েছে যৌনসম্পর্ক করার। তারা তাদের সন্তানকে সুযোগ করে যৌন সম্পর্ক তৈরি করতে। কোন ছেলে-মেয়ে যদি তাতে অদক্ষতা দেখায়, তখন বাবা- মায়েরা প্রশ্ন করে জেনে নেন, তার সন্তানটি শারীরিক ও মানসিকভাবে কোন সমস্যায় ভুগছে কিনা? কিংবা সে সমকামী কিনা? তারা ছেলে-মেয়েদের কনডম বা সন্তান নিরোধীকরণ সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিয়ে থাকে।

দ্বিতীয়ত: এখানে সরকার অনুমোদিত অসংখ্য যৌনপল্লী আছে, যেখানে ছেলে এবং মেয়েদের - উভয়পক্ষেরই যাওয়ার অনুমতি আছে। যৌনকর্মীদের প্রতি ৩ মাসে এইচআইভি পরীক্ষা নিরীক্ষা করা বাধ্যতামূলক। এ দেশের সরকার চায় না তাদের নাগরিকদের এইডস হোক- তা সে যৌনকর্মী হলেও। একজন যৌনকর্মী ও একটি যৌনপল্লী সরকারকে বিশাল পরিমাণে ট্যাক্স দেন, ঠিক সিগারেটের ফ্যাক্টরিগুলোর মতো। তাই অর্থের বিনিময়ে যৌন-পেশাটি এ দেশে অবৈধ নয়। আর এটাই কারণ, পশ্চিমাদেশগুলো তুলনামূলক কম ধর্ষণ হওয়ার। তাদেরকে যৌন আগ্রহ ও চাহিদা মেটাতে কোন নারী বা শিশুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে হয় না। কিংবা পরে জানাজানির ভয়ে ভিক্টিমকে খুন করতে হয় না।

এখানে প্রসঙ্গত বলতেই হয় এখনো বাংলাদেশে সমকামিতা নিয়ে রয়েছে বিশাল দ্বন্দ্ব। যা ষাটের দশকে এক সময় ইউরোপেও ছিল। যখন সবাই জানতো অমুক অমুক স্থানে রাতের অন্ধকারে সমকামীরা মিলিত হয়, যা বৈধ ছিল না। ষাটের দশকে জার্মানির মতো দেশেও নারীকে চাকরী করতে যেতে হলে স্বামী দস্তখত নিয়ে যেতে হতো - যেখানে লেখা থাকতো আমার স্ত্রী চাকুরী করলে তাতে আমার কোন আপত্তি নাই। সে অবস্থা থেকে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো বের হয়ে এসেছে। সমকামিতা এখন আর কোন অপরাধ নয়। অথচ বাংলাদেশে এখনো বি-সমকামীদেরই বিবাহপূর্ব যৌন সম্পর্ককে অবৈধ ও অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।


কিন্তু তাতে কি বাংলাদেশের ছেলে-মেয়েরা বিয়ের আগে যৌনসম্পর্কে লিপ্ত হচ্ছে না?
অবশ্যই হচ্ছে । অনেক নারী-পুরুষই লিভ-টুগেদার বন্ধনে জড়িত হয়েছে বা হচ্ছেন, কিন্তু তা মহা গোপনে। যাতে করে আত্মীয়-স্বজন যেন টের না পায়। অনেকেই বিবাহিত বলে আলাদা বাড়ি ভাড়া করেও থাকেন। ''বিবাহিত'' শব্দের তকমা জড়ানো থাকলেই হয় কেউ আর আড়চোখে তাকান না সেদিকে। শুধু কি তাই? আমাদের দেশে দুই ধর্মের দুজন মানুষের বিবাহ সিদ্ধান্ত আইনগতভাবে কিছু বৈধ হলেও সামাজিকভাবে অবৈধ। দুই ধর্মের দুজন বিয়ে করেছে শুনলে বাড়িভাড়া দিতে রাজী হোন না বাড়ীওয়ালারা। অথচ, তারা কিন্তু ঠিকই সামাজিকভাবে বিবাহবন্ধনের দলিলে দস্তখত দিয়েছে।

ছেলে-মেয়েরা রাস্তায়-রেস্তোরায় ডেটিং এর জন্য ঘুরছে। কখনো বন্ধুর বাসায়, কখনো বাবা-মা বেড়াতে গেলে ছেলেবন্ধু বা মেয়েবন্ধুকে গোপনে ডেকে নিজ ঘরে অভিসারে লিপ্ত হওয়া। কিংবা ভাবী বা বোনের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল হলে, তাদের বাসায় গিয়ে ডেটিং করা। কিংবা সম্পর্কে ভাবী পাতিয়ে ঘণ্টার জন্য ঘর ভাড়া করে যৌনচাহিদা মেটায় প্রেমিক-প্রেমিকেরা। হ্যাঁ, গোপনে শারীরিক সম্পর্ক করছে বাংলাদেশের ছেলে-মেয়েরাই। আর গোপনে করা মানেই অপরাধবোধের সৃষ্টি হওয়া।আর সেই অপরাধবোধের সুযোগ নেয় বিশেষ মহলের মানুষেরা। বাংলাদেশে রাতের বেলায় পার্কে হাঁটা যায় না। দাঁড়িয়ে আছে ভাসমান পতিতা ও তাদের খদ্দেররা। হোটেলে হোটেলে বোরখা পরা নারীদের আনাগোনা। পুলিশ হয়রানি করছে তাদের। বিরাট অংকের একটা ভাতা ও চাঁদা আদায় করছে তারা।

কিছুদিন ধরে প্রগতিশীলদের মধ্যে রব উঠেছে,- ছেলে-মেয়েদের যৌনশিক্ষা সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। আর ঠিক সেইসব প্রগতিশীলরা প্রকাশ্যে চুমু খাওয়ার দাবীর কথা শুনলে বলছেন, এটা বাংলাদেশ; পশ্চিমা বিশ্ব নয়, যে এখানে প্রকাশ্যে চুমু খাবার দাবীকে বৈধতা দেয়া হবে। সত্যি যদি কোন বাংলাদেশে ছেলে-মেয়েদের যৌনশিক্ষার শিক্ষায় শিক্ষিত করতে যাওয়া হয়; তখন এসব প্রগতিশীলদেরকেই বলতে শোনা যাবে, ছিঃ!! ছিঃ!! লজ্জা!! লজ্জা!! আমার মেয়ে কিনা আমায় যৌনতা নিয়ে প্রশ্ন করছে? আমার মেয়ের সারল্য/সরলতা কেড়ে নেয়া হয়েছে, আমি তার প্রতিবাদ জানাই। ''ফিরিয়ে দাও সারল্য'' নামের ইভেন্টও খোলা হতে পারে।

এভাবেই দিনের পর দিন আমাদের সবকিছু গোপনে, আড়ালে-আবডালে করার শিক্ষা সামাজিকভাবে দিয়ে আসা হচ্ছে। কখনো সংস্কারের নামে, আবার কখনোবা ধর্মের নামে। যতদিন পর্যন্ত আমরা এসব গোপনীয়তা ও ট্যাবু থেকে বেরিয়ে আসতে পারবো না, ততদিন পর্যন্ত আমাদের দেশে প্রতিদিনই সংবাদপত্রে ধর্ষণ ও খুনের সংবাদ দেখে যেতে হবে। আর তনু -ইয়াসমিন-কল্পনাদের মতো প্রভাবশালীদের দ্বারা ধর্ষণ ও খুন হলে তার বিচারও হবে না।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ