প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
ড. কাবেরী গায়েন | ২৫ মে, ২০১৬
সত্যিটা স্বীকার করতে দোষ নেই। ‘বেগম’ পত্রিকা আমি পড়িনি। এমনকি দীর্ঘদিন যাবত আমি মনে করতাম, নারীদের জন্য আবার পৃথক পত্রিকা কেনো? কেনোই বা নারীদের জন্য পত্রিকায় আলাদা পাতা? ‘বেগম’ নামটাও খুব আকর্ষণ করতো না।
আস্তে আস্তে বুঝেছি, পত্রিকার জগতটি ছিলো একেবারেই পুরুষের। কতোটা পুরুষের জায়গা, সেটি আমি প্রথম বুঝতে শিখি মাস্টার্সের আবশ্যিক কোর্স হিসেবে যখন ইন্টার্নশিপ করতে যাই একটি ইংরেজি দৈনিকে। ওই পত্রিকায় তখন নিউজরুমে আমি একা মেয়ে। নিউজ এডিটর অতিশয় সজ্জন ব্যক্তি। আমাকে বিশেষ কোন কাজ দেন না; দুই একটা হেডলাইন করার পর, এক-আধটু অনুবাদ করার পর বলেন বাসায় চলে যেতে। হাউসের সবাই খাতির করে বাদাম, চকোলেট, পেয়ারা, মায় কোকাকোলা পর্যন্ত খাওয়ান। কিন্তু কাজ দেন না তেমন একটা। সেও তবু উপেক্ষা করা যেতো। কিন্তু দেখলাম মেয়েদের জন্য তখনো পর্যন্ত কোন টয়লেট নেই সেখানে। একদিন সাহস নিয়ে ঢুকলাম বটে, কিন্তু বের হয়ে আসতে হলো। আর কোনদিন সেমুখো হইনি।
এখন মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রি মেয়েদের চলাচলে মুখরিত। পরিবর্তন হয়েছে বাহ্যিক কাঠামোতে। পরিবর্তন হয়েছে মেয়েদের কাজের ধরনে। সেই নারী, শিশু আর সাংস্কৃতিক বিট ছাড়িয়ে সব ধরণের বিটে মেয়েরা কাজ করছেন দাপটের সাথে। মেয়েদের ‘চলার বেগে পায়ের তলায় রাস্তা জেগেছে’।
কিন্তু এই পথ খুব সহজ ছিলো না। এমন কি আমরা সাংবাদিকতা বিভাগে যেসব বই পড়ে বিষয়টা শিখেছি, সেখানে, পাশ্চাত্যের সেসব বইতেও, এখন পর্যন্ত সাংবাদিকের জন্য যে সর্বনাম সেটি ‘ he’, যিনি সম্পাদক তাঁর সর্বনাম ‘ he’, যিনি আলোকচিত্রী বা সহ-সম্পাদক, তাঁর সর্বনামও ‘he’। পত্রিকা অফিসে ফুটফরমাশ খাটে যে ব্যক্তি তার নাম ‘errand boy’ । উদাহরণ না বাড়াই। পুরো সাংবাদিকতার জগতই যেনো পুরুষের। এই পথ কতোটা বন্ধুর ছিলো এই উপমহাদেশে, তার খানিকটা আন্দাজ বোধহয় আমরা করতে পারি একটু ইতিহাসের দিকে তাকালে।উনিশ শতকের শেষ দিকে যখন পত্রিকা ঢুকে গেছে বাঙালি বাড়ির অন্দরমহলে, তখনো, আমরা দেখতে পাই মেয়েরা এমন কি চিঠি লিখতে পারছেন না পত্রিকায় স্বনামে। তাঁরা লিখছেন ‘চুঁচুড়া নিবাসী কতিপয় বিধবা’ নাম নিয়ে, বিধবা বিয়ের পক্ষে। কিংবা লিখছেন ‘জনৈকা অমুকী দাসী’। তাঁর নাম নেই। এই নামহীন পরিসরে হঠাৎ ঢুকে সাংবাদিক হওয়া বা লেখক হওয়া সম্ভব না। আর কলিকাতার সমাজেই যদি এই অবস্থা, তাহলে এই বাংলার মুসলিম সমাজে এই প্রতিবন্ধকতা কতো প্রবল ছিলো তার ধারণা আমরা পাই বেগম রোকেয়ার ‘অবরোধবাসিনী’তে।
সেই অনড়, অ-ক্ষর, নারীর জন্য ‘ঢোকা বারণ’ জগতে কিছু মানুষ এসেছিলেন নারীর জন্য পরিসর তৈরি করতে। বেগম রোকেয়া নিঃসন্দেহে পথিকৃৎ। পথিকৃৎ বেগম সুফিয়া কামাল। পথিকৃৎ নূরজাহান বেগম। তিনি ‘বেগম’ নামের পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন নারীদের জন্য। পত্রিকাটি প্রথমে সম্পাদনা করেছেন বেগম সুফিয়া কামাল, ১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই থেকে। তখন কলিকাতা থেকে বের হতো। ১৯৫০ সালের ৩ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে বের হয় চতুর্থ বর্ষ সংখ্যা। নূর জাহান বেগম তখন থেকেই সম্পাদনা করেছেন। কেবল নারীরাই সেখানে লিখেছেন। সাংবাদিকতা করেছেন। সম্পাদনা করেছেন। শুরুর দিকের ৫০০ কপি বেড়ে ২৫০০০ কপি পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। পোড়ার দেশে মেয়েরাও যে লিখতে পারে, এই কথাই তো কেউ স্বীকার করতেন না। এই বেগম পত্রিকায় লিখে লেখার জগতে, সাহিত্যের আঙ্গিনায় পা ফেলেছেন নারীরা। ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলনের পরে যখন এদেশের শিল্প-সংস্কৃতির জগতে পাকিস্তানী নির্যাতন নেমে এসেছে, তখনো ‘সাপ্তাহিক বেগম’ পত্রিকা বাংলা ভাষার চর্চা আর সাংস্কৃতিক আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে গেছে। বেগম পত্রিকার মধ্য দিয়ে নারীরা একদিকে যেমন সাংবাদিকতায় এসেছেন, তেমনি সাহিত্যের জগতে এসেছেন। আবার জাতীয় মুক্তির আন্দোলনেও যুক্ত হয়েছেন। ফলে, ‘সাপ্তাহিক বেগম’ পত্রিকার ভূমিকা শুধু ঐতিহাসিকই নয়, বরং নারীর জন্য বিপ্লবীও বটে।
নারীর অগ্রায়ণের এই কাজটি করার জন্য তিনি খুব হৈ চৈ করেননি। কোন নারীবাদী চর্চার ঢাক-ঢোল পেটাননি। বেগম রোকেয়া আর সুফিয়া কামালের উত্তরসূরি হিসেবে নিরলস চেষ্টা আর কাজের মধ্য দিয়ে তিনি এদেশের নারীদের জন্য একটি পরিসর চালু রাখলেন, যে পরিসরে নারীর ব্যক্তিক এবং সামষ্টিক বিকাশ হলো। আর সেই পথ ধরে নারীর ক্ষমতার স্বীকৃতি প্রথমে নারীরাই দিলেন নিজেদের, তারপর সে আলো ছড়িয়ে গেলো সবখানে। আপন স্বীকৃতির জন্য তাঁরা পুরুষের মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজেদের জগত নির্মাণ করেছেন নিজেরাই। ভারতবর্ষে শুধু মেয়েদের জন্য প্রকাশিত এটিই প্রথম সাপ্তাহিক।
আজ যে পাটাতনের উপর দাঁড়িয়ে আমি মনে করতে পারি যে মেয়েদের জন্য আলাদা পাতা কেনো? আলাদা পত্রিকা কেনো? সেই স্পর্ধায় পৌঁছে দিয়েছেন যে পূর্বনারীরা, নূর জাহান বেগম তাঁদের একজন। তাঁদের মেধা, শ্রম, চর্চা আর তৈরি করে দেয়া পরিসরের উপর দিয়ে হেঁটেছেন এই দেশের নারীরা। তাঁরা অভয় পেয়েছেন, নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে জেনেছেন, এবং আজ প্রশ্ন করতে পারছেন কেনো আলাদা পাতা? আলাদা পত্রিকা?
হ্যাঁ, সত্যি যে, আমি ‘সাপ্তাহিক বেগম’ পড়ে বড় হইনি। কিন্তু যাঁরা বেগম পত্রিকা পড়ে, বেগম পত্রিকায় লিখে বিকশিত হয়েছেন, তাঁদের লেখা আর মনীষার পথ ধরেই আমি হাঁটার শক্তি পেয়েছি। এ যেনো এক প্রবহমান যাত্রা। আজ এই মহান লেখক-সম্পাদক-সমাজ সংস্কারকের মৃত্যুদিনে মাথা নুইয়ে বলি, এদেশের নারী জাগরণে আপনার আর আপনার ‘সাপ্তাহিক বেগম’-এর ভূমিকা ঐতিহাসিক। এদেশের নারীদের অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বের পথে যাত্রায় আপনার ভূমিকা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
আমরা যাঁরা নিজেদের ভুঁইফোড় মনে করি না, স্বয়ংভু মনে করি না, বরং মনে করি আমাদের নারীসংগ্রাম ও জাগরণের এক ঐতিহাসিক পরম্পরা আছে- তাঁদের কাছে আপনি একজন পথ দেখানো বীর, যিনি ফুল ফুটিয়ে গেছেন শত শত। আপনাকে অশেষ শ্রদ্ধা। আপনাকে বাদ দিয়ে এদেশের নারীজাগরণের ইতিহাস লেখা হবে না। এদেশের নারীদের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরে নিজেকে মানুষ ভাবার স্পর্ধা তৈরি করে দেবার জন্য কৃতজ্ঞতা।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য