প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
রণেশ মৈত্র | ০২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬
একগুচ্ছ তারকার নাম। ওরা পাঁচজন-ওরা অনেক। ওরা একসূত্রে গাঁথা। জীবন পরিক্রমায় হঠাৎই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল ওরা। পাঁচজনের সবাই ছিল প্রাণবন্ত যুবতী বা কিশোরী। সবাই ছিল সম্ভাবনায় ভরপুর। গোটা জীবন তাদের সামনে ছিল-কত কিছুই না স্বপ্ন ছিল। ছিল সুন্দর জীবনের স্বপ্ন-সুন্দর একটি বাংলাদেশের স্বপ্ন। সে স্বপ্ন হঠাৎ করেই হারিয়ে গেল - নিভে গেল জীবন প্রদীপ। আর আমরা ? এখনও নিরাপদে আছি বটে কিন্তু নিশ্চিত কি? ভুলে যাব কি ওদেরকে ওদের মত আরও লাখো লাখো ধর্ষিতা, লাঞ্ছিতা ও বর্বরতার শিকার আমাদেরই মা-বোন-প্রতিবেশীকে?
সমাজ চিত্রের এই অন্ধকার দিকটির বিরুদ্ধে একদিকে যেমন ধিক্কার-ধ্বনি অতীব জোরেশোরে উচ্চারিত হতে দেখি তেমনই যেন ঐ ধিক্কার ধ্বনিতে ততোধিক ধিক্কার বা অবমাননা উপেক্ষা করে চলেছে সমাজের শিক্ষিত, দায়িত্বশীল, চরিত্রবান ও বিপুল সম্ভাবনার ভরপুর তরুণী-যুবতীদেরকে নির্মম ভাবে হত্যা, অপহরণ ও ধর্ষণ এবং অত:পর খুনের নিরাপদ শিকার হতে। পরস্পর বিরোধী এই ঘটনাগুলিকে কিভাবে যৌক্তিকতা দেওয়া যাবে তা ভেবে পাওয়া সত্যই দুরূহ।
আরও সম্ভবত: এ কারণে এ জাতীয় ঘটনাগুলির ক্রমবৃদ্ধি বিস্ময়কর বলে মনে হয় যে পৃথিবীজোড়া আজ ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দেশে দেশে কতই না ঘাঁটি বা প্রচারকের কারখানা তৈরি হয়েছে পৃথিবী ব্যাপী সর্বত্র “ইসলামী হুকমত কায়েমের নামে যে বিশাল ধ্বংসযজ্ঞ পরিলক্ষিত হচ্ছে (আমরা তাকে পছন্দ করি বা না করি) তার মুখে নারী জীবনের এ অসহায়ত্ব কিভাবে বিদূরিত হবে বলে ভাবা যাবে?
যে তরুণীদের নাম উল্লেখ করেছি তাদের মধ্যে কল্পনা চাকমার ঘটনা সর্বাধিক পুরাতন। কক্সবাজার রাঙামাটি এলাকার আদিবাসী নারী আন্দোলনের সংগ্রামী সংগঠক কল্পনা চাকমাকে রাস্তা থেকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়। কারা অপহরণ করলো- কোথায় রাখলো কল্পনা আজও জীবিত কিনা তার কোন হদিস আজও মেলে নি। তবে অনেকেরই সন্দেহ, সরকার তার উপরে বৈরী থাকার সুযোগ নিয়ে তৎকালীন সামরিক কর্মকর্তাদের কেই তাকে তুলে নিয়ে যায় সেখানকার সীমান্তরক্ষা শান্তিরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত কোন সামরিক কর্মকর্তা, তার বা তাদের যৌথ লিপ্সা চরিতার্থ করে বেশ দীর্ঘদিন ধরে এবং অত:পর তাকে হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলা হয়। দেশের বাংলা ইংরেজি জাতীয় পত্র-পত্রিকায় কল্পনা চাকমাকে নিয়ে ব্যাপক হৈ চৈ সোরগোল
দীর্ঘদিন ধরে চললেও এ ঘটনার তদন্ত কোন দিনই শেষ হয় নি। সম্ভবত: ঐ মোকদ্দমা আর এখন তদন্তাধীনও নয় তাকেও হয়ত কল্পনার মতই হত্যা করা হয়েছে। ধীরে ধীরে কল্পনা চাকমাকে দেশ প্রায় ভুলতেই বসেছে। কিন্তু কল্পনার আপনজনেরা, তার সঙ্গী সাথীরা তার সংগঠনের নেতা-কর্মীরা? তাঁরা আজও ভুলেন নি-ভুলবেনও না।
মিতুর হত্যা কাহিনী অতি সাম্প্রতিক। চৌকস পুলিশ সুপার বাবুল আখতারের প্রিয়তমা স্ত্রী অল্প বয়সী মহিলা দুটি শিশু সন্তানের মা মিতু। জুনের ৫ তারিখে ভোরে তাঁর প্রথম শিশুকে তার স্কুল বাসে তুলে দিতে চট্টগ্রামের রাজপথে অপেক্ষমাণ থাকাকালে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। যারাই বাবুল আখতার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, এমন কি তাঁর সহকর্মী ও পুলিশ বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও ঠিকই জানেন যে, জঙ্গিদের গ্রেফতার ও তাদের আস্তানা খুঁজে বের করে জঙ্গিদেরকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিলেন বাবুল আখতার এবং সে কারণে জঙ্গিরাই তার স্ত্রী মাহমুদা আখতার মিতুকে সম্ভবত: টার্গেট করে তাঁকে হত্যা করে থাকবে। বিষয়টি তদন্তাধীন এবং কোন এক অজ্ঞাত করণে এই তদন্ত গতি পাচ্ছে না সহসাই মাঝপথে মুখ থুবড়ে পড়েছে যেন।
অপরপক্ষে মিতুর স্বামী পুলিশ সুপার বাবুল আখতারের সাথে পুলিশ কর্মকর্তাদের একাংশ বিস্ময়করভাবে শত্রুতুল্য আচরণ শুরু করেছে। স্বশুরবাড়ী থেকে আকস্মিকভাবে এক গভীর রাতে তাঁকে তুলে নিয়ে ডি.বি. অফিসে দীর্ঘ ১৫ ঘণ্টা ব্যাপী জিজ্ঞাসাবাদের নামে আটক রেখে জোর করে এক সাদা কাগজে তাঁর স্বাক্ষর নিয়ে নেয়। ইদানীং সেটাকেই পদত্যাগপত্র বানিয়ে মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়। সেখান থেকে পাঠানো হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তিনিই নেবেন। অপরাধীকে চাকুরী ও জীবনের নিরাপত্তার ব্যাপারে গভীরভাবে শঙ্কিত শোকাতুর বাবুল আখতার ও তাঁর আত্মীয় পরিজন ও সমগ্র দেশবাসী। তাঁর চাকুরী ফিরে পাওয়ার আকুতি শুনবেন কি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী?
তনু কুমিল্লার কলেজ ছাত্রী-অত্যন্ত প্রতিভার নাট্য শিল্পী। তাঁকে ক্যান্টনমেন্টের নিকট থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় অত:পর ধর্ষণ ও হত্যা। কতই না অসহায় হয়ে পড়েছে আমাদের দেশের আলোর সন্ধানী নারী জীবন।
সমগ্র দেশ ফুঁসে উঠলো মিতু হত্যার বিচার দাবীতে। দেশব্যাপী মানববন্ধন, সভা-সমাবেশ থেকে ঐ দাবী উচ্চারিত হতে থাকলো কিন্তু তনুর হত্যার তদন্ত কাজ আর এগোয় না। কোন এক শক্তিশালী অদৃশ্য হাত যেন পুলিশকে ধমকে থামিয়ে দিয়ে জনমতকে চরমভাবে উপেক্ষা করে।
হঠাৎ ঘটে গেল গুলশান ও শোলাকিয়ার হত্যালীলা। ব্যস! সমগ্র দেশবাসী ও সংবাদ-মাধ্যমের নজর স্বাভাবিক ভাবেই চলে গেল ঐ দুটি ভয়াবহ ঘটনার পেছনে । নিমেষেই চাপা পড়ে গেল তনু হত্যার তদন্তের প্রক্রিয়া ও সৃষ্ট গণরোষ। যারা ধামাচাপা দিতে সচেষ্ট ছিলো তনু হত্যার তদন্ত কাজকে তাদের উদ্দেশ্য বহুলাংশে সফল হলো ঐ ভয়াবহ ঘটনাবলী অকস্মাৎ ঘটে যাওয়ার সুবাদে। আর তদন্ত কর্তৃপক্ষও এখন বলছেন না তাঁদের কাজ করে শেষ হবে বা বর্তমানে কোন পর্যায়ে এসে ঠেকেছে।
নারায়ণগঞ্জের ত্বকী হত্যার কাহিনী আজ যেন অনেকটাই বিস্মৃত। আমারও মনে নেই ঘটনার তারিখটা। কিন্তু তখন যে সর্বত্র সোচ্চার জনমত গড়ে উঠেছিল ত্বকী হত্যার বিচারের দাবীতে বহু স্থানে সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হচ্ছিলো তা তো ভুলবার নয়। নারায়ণগঞ্জের সুধীসমাজও কণ্ঠ মিলিয়েছিলেন ত্বকীর হত্যার বিচারের দাবীতে। ত্বকীর পিতা ন্যায় বিচারের দাবীতে দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছেন কিন্তু যেহেতু এই ঘটনার দায়-দায়িত্ব সেখানকার দোর্দন্ত প্রতাপশালী এরশাদের জাতীয় পার্টির সংসদ এবং সরকারের উপরতলার বিশেষ আশীর্বাদপুষ্ট তাই আজও এ ঘটনার কোন কূলকিনারা হয় নি। পুলিশ যে অনেকক্ষেত্রেই আইনের বিধান মেনে অপরাধীকে শাস্তি দেয় না বা দিতে পারে না এটি তার অন্যতম ন্যক্কারজনক দৃষ্টান্ত। আইন তো স্পষ্টভাবেই বলে অপরাধ যে করে এবং যে অপরাধীকে অপরাধ করতে উৎসাহ বা নির্দেশ দেয় এবং যে অপরাধীকে আইন প্রয়োগের হাত থেকে আড়াল করতে (harboring the offender) সচেষ্ট হয়-তারা সকলেই সমান অপরাধী এবং একই ধরণের শাস্তি পাওয়ার যোগ্য। এ বিধান লঙ্ঘিত হচ্ছে আইন প্রয়োগকারীদের হাতেই বারংবার।
এবারে আমি সদ্য সংঘটিত হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে যেটি আজতক আলোচনার তুঙ্গে। আমি ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী আফসানা হত্যার কথা বলছি। আফসানা আত্মহত্যা করেছে এমন অবিশ্বাস্য কাঁথা বলেছেন একজন চিকিৎসক যিনি তার দেহ ময়নাতদন্ত করেছেন। যদিও ময়না তদন্ত পর্ব তখনও সমাপ্ত হয় নি বলে তিনি নিজেই উল্লেখ করেছেন।
কিন্তু ঘটনাক্রমে তো আদৌ এই আত্মহত্যা তত্ত্বকে সমর্থন করে না। তাকে কিভাবে ডেকে নেওয়া হলো কিভাবে তার লাশ হাসপাতালে এলো- লাশ আনয়নকারীরা ডাক্তার বা হাসপাতাল কর্মীদের কাছ তার কোন পরিচয় বা মৃত্যু সংক্রান্ত কোন তথ্য না দিয়ে গোপনে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে গেল । এ সংবাদ জানা গেল দেশের সংবাদ মাধ্যমগুলিতে প্রকাশিত সংক্রান্ত নানা প্রতিবেদনের মাধ্যমে।
জানা যায়, জনৈক ছাত্রলীগ নেতার সাথে আফসানা প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল গোপনে সেই ছাত্রলীগ নেতা রবিনকে সে নাকি বিয়েও করেছিল। আবার সে সম্পর্ক ভেঙ্গেও গিয়েছিল। ডাক্তার অল্পদিন পরে ঐ ছাত্রলীগ নেতার বন্ধু-বান্ধবেরা মিলে না কি একটি সমঝোতারও সৃষ্টি করেছিল কিন্তু সেই সমঝোতা বা মিটমাটের পর দুদিনও যেতে না যেতেই তা পুনরায় ভেঙ্গে যায় যার প্রতিশ্রুতিতে এই নির্মম হত্যাকাণ্ড।
আফসানা মেধাবী ছাত্রী-সামনে ছিল তার আলোকোজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। সেই ভবিষ্যতের অনাগত সম্ভাবনাময় দিনগুলিতে আফসানা একটি শোষণ মুক্ত ধর্ম নিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ রচনা করে সুখী সমৃদ্ধ মাতৃভূমি গড়তে চেয়েছিল। হতে চেয়েছিল তেমন একটি দেশ গড়ার অন্যতম কারিগর। সে কেন আত্মহত্যা করবে? তাতে আত্মহত্যা বলে মনে হতে পারে কিন্তু হত্যা করেও তো কতজনকে ঝুলিয়ে গলায় ফাঁস নিয়ে মরার কাহিনী রচনা করা হয়েছে ডাক্তারের তা অজানা থাকার কথা নয়।
হ্যাঁ, আফসানা যদি সত্যই ছাত্রলীগ নেতা রবিনকে বিয়ে করে থাকে-তার সাথে প্রেমের গোপন সম্পর্ক গড়ে থাকে তবে সে মারাত্মক ভুল করেছিলো। তার বয়সাটাও ছিল বিপজ্জনক। এবং সেই ভুলের বড্ড চড়া মাশুল তাকে দিতে হলো। কিন্তু ভুল করে অমন ছাত্রনেতার সাথে প্রেম, বিয়ে প্রকৃতিতে অস্বীকৃতি জানালেই কি আফসানা বাঁচতে পারতো? অবশ্য অস্বীকার করা প্রয়োজন ছিল কারণ ছেলেটি একটি দুর্বৃত্ত। সেই দুর্বৃত্তকে কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে না আজও? আজও ছাত্রলীগ নেতা সেই কারণে? আইনে কি লেখা আছে ছাত্রলীগের কেউ কাউকে খুন করলে তার কোন বিচার হবে না?
আফসানার বাবা, তার সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন ঐ ডাক্তারি রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করেছেন-আমিও করছি; কারণ তা অবস্থার প্রেক্ষিতে সত্যের প্রতিফলন ঘটায় নি। সুতরাং নতুন করে পোষ্টমর্টেম করা হোক- পৃথক একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করে। অপরাধীদেরকে চিহ্নিত করতে সিসিটিভির ফুটেজ ব্যবহার করতে আপত্তি কোথায়?
দুঃখজনক ঘটনা হলো দেশটা আজও আইনের শাসনের মুখ দেখলো না। ছাত্র লীগ, যুবলীগ বা আওয়ামী লীগারদের বহু মামলাকে “রাজনৈতিক” কারণ দেখিয়ে বিচারের আগেই অতীতে প্রত্যাহার করা হয়েছে আবার ফাঁসীর আসামীকে ক্ষমা প্রদর্শনের নজীরও রয়েছে। সুতরাং যার নামে এলাকা কাঁপে সেই ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে মামলা পুলিশের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে কেন? কেনই বা সংশ্লিষ্ট ছাত্রলীগ নেতাকে গ্রেফতার করা হবে? পুলিশ হুকুম তামিল করার যন্ত্র মাত্র।
তবে ঝড় উঠবে। আকাশে কালমেঘ জমছে। সত্বরেই আইন মোতাবেক কাজ শুরু করে এ মেঘ না কাটালে কোন না কোনদিন প্রচণ্ড এক তুফান এসে সব লণ্ডভণ্ড করে দিতে পারে। তেমন পরিস্থিতি না হোক এটাই কাম্য।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য