আজ বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

Advertise

প্রতিশোধ নয়, মানবিকতাই হোক ভালোবাসার স্লোগান

দেবজ্যোতি দেবু  

প্রেমে ব্যর্থ হয়ে প্রেমিকাকে খুন, প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় এসিডে ঝলসে গেছে তরুণীর দেহ, প্রেমে বিচ্ছেদ ঘটায় খুন হয়েছে তরুণী কিংবা প্রেমিকের প্রতারণায় আত্মহত্যা করেছে তরুণী, এই কথাগুলোর সাথে আমরা খুব ভাল করেই পরিচিত। এগুলো নিত্যদিনের সংবাদ শিরোনাম। এসব কিছুর ভিড়ে মাঝে মধ্যে চোখে পড়ে প্রেমিকার সাথে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি বা ভিডিও ভাইরাল হয়ে গেছে ইন্টারনেটে। ভিতরের খবর জানতে গেলে দেখা যায়, প্রেমে বিচ্ছেদ হওয়ার কারণে কিংবা প্রেমিকা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে বলে তাকে শাস্তি দিতেই এমন কাজ করেছে প্রেমিক! সকল ক্ষেত্রেই ক্ষতির শিকার হয় মেয়েরাই।

এসব দেখি আর ভাবি, যার মনে প্রেম আছে সে প্রতিশোধ পরায়ণ হয় কিভাবে? যাকে ভালোবাসার কথা বলতে বলতে ক্লান্তি আসে না প্রেমিকের, তার প্রতি এতোটা প্রতিশোধ স্পৃহা জন্মায় কিভাবে ছেলেটার মনে? যাকে ভালোবাসা যায় তাকে ঘৃণা করার কথা মনে আসলেও ঘৃণা করাটা অসম্ভব মনে হয়। সেই জায়গায় তার ক্ষতি চাওয়া বা ক্ষতি করার কথা ভাবে কিভাবে মানুষ? যে মন ভালোবাসে সেই মন কি ধ্বংস চাইতে পারে?

দু'দিন ধরে ফেইসবুকে একটা ইস্যুর খুব বেশি চর্চা হচ্ছে। চুপ থাকতে চেয়েও এইবার আর চুপ থাকতে পারলাম না। আজ এক বন্ধু জিজ্ঞেস করলো "মেয়েটা নাকি আত্মহত্যা করেছে?" আমি রীতিমত অবাক! কে কোথায় কিভাবে আত্মহত্যা করলো? উত্তরে বন্ধুটি বললো অনলাইনে ভাইরাল হওয়া একটা ভিডিওর কথা। অবাক হলাম। খোঁজ নিয়ে জানলাম আত্মহত্যার খবরটা গুজব। কিছুটা স্বস্তি পেলাম। ঘটনাটা কি জানার জন্য কয়েকজনের সাথে কথা বলতে গেলে এক বন্ধু জানালেন ফেইসবুকে নাকি একটা গ্রুপ আছে যেখানে ভিডিওটি আপলোড করেছে কেউ একজন আর বাকিরা সবাই মজা নিয়ে দেখছে! শুধু দেখছে বললে ভুল হবে, মেয়েটিকে শত সহস্রবার বিবস্ত্র হতে হচ্ছে ওদের কথায় আর পোস্টে!

শুধু কি ঐ গ্রুপেই এসব হচ্ছে? না, এর বাইরেও হচ্ছে। নানান জন নানানভাবে বিকৃত কথাবার্তা বলে পোস্ট দিচ্ছে আর সেখানে আরো কিছু কুরুচি সম্পন্ন দোপেয়ে জানোয়াররা মন্তব্য করছে। কেউ বলছে "ছেলেটা ভিডিও এভাবে ভাইরাল করে খুব অন্যায় করেছে। আচ্ছা, ভিডিওটির কোন লিংক আছে?" ভাবতেই অবাক লাগে, লোকটা যে মুখে এটাকে অন্যায় বলছে সেই মুখেই সে আবার সেই ভিডিও দেখার আবদার করছে! কেউ কেউ বলছে, "মেয়েটা ভিডিও করতে দিল কেন? না দিলেতো এটা ভাইরাল হতো না।" অবাক লাগে, একটা পশুর কুকর্ম তার চোখে লাগছে না! ঘুরে ফিরে মেয়েটাকেই দোষী বানাতে এরা মোটেও দ্বিধা করছে না! কেউ বলছে, "অন্তরঙ্গ মুহূর্ত ভিডিও করার কি আছে? অতীত ঘটনাগুলো দেখে কি মেয়েটা কিছুই শিখতে পারলো না? সে ভিডিও না করলে তো ছেলেটা সেটা ভাইরাল করে আজ তার ক্ষতি করতে পারতো না।" কি আশ্চর্য, এখানে ছেলেটির অন্যায়কে জাস্টিফাই করতে আবারও মেয়েটিকেই দোষী বানানো হচ্ছে! সবকিছুতেই ঘুরে ফিরে মেয়েটির দোষ! কিন্তু কেন? মেয়েটি কি এমন অন্যায় করেছে যে তাকে এভাবে দোষী বানানোর জন্য সবাই উঠে পরে লেগেছে?

একটা মেয়ে কতোটুকু বিশ্বাস থাকলে তার প্রেমিকের সাথে কোনপ্রকার চুক্তি ছাড়াই দৈহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হতে পারে এটা কেউ ভাবতে যাবে না। কতোটুকু বিশ্বাস নিয়ে মেয়েটা তার প্রেমিকের হাত ধরে এতোটা পথ এসেছে সেটা কেউ ভাবতে যাবে না। যদি ভাবতো তাহলে "ভিডিও কেন করলো" সেই প্রশ্ন করার রুচি কেউ দেখাতো না।

সবাই অন্তরঙ্গ মুহূর্তগুলো ভিডিও বন্দী করে না। কেউ কেউ করে। কেউ আবার ফুলশয্যার রাতের সম্পূর্ণটাই ভিডিও করে রাখে স্মৃতি হিসেবে। তাতে আমি অন্তত দোষের কিছু দেখি না। সততা আর পারস্পরিক অটুট বিশ্বাস থাকলে এটা করতেই পারে। আবার যারা ভিডিও করে না তারাও যে একে অপরকে বিশ্বাস করছে না বলে ভিডিও করছে না, তাও কিন্তু না। তারা এর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে না বলেই ভিডিও করে না। অবাক লাগে যখন দেখি একটা পশুর অপকর্মকে জাস্টিফাই করতে গিয়ে লোকে সেই ভিডিও করাকেই মূল দোষ হিসেবে দেখে! নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করি, আমরা কি মানুষ?

আগেই বলেছি ঘটনাটা বাংলাদেশে নতুন কিছু না। অনেক বড় বড় সেলিব্রেটির বেলায়ও এমন হয়েছে, হয়েছে সাধারণ মানুষের জীবনেও। প্রতিটা ক্ষেত্রেই দেখা যায় ক্ষতিটা মেয়েদেরই হয়। সামাজিক ভাবে মেয়েটিকে হেয় করা হয়। লজ্জায় ঘৃণায় অনেকে আত্মহত্যা পর্যন্ত করে বসে। মেয়েটির পরিবার রীতিমত মৃতপ্রায় হয়ে যায়। অথচ ছেলেটাকে কেউ দোষ দেয় না এবং লোকলজ্জার ভয়ে মেয়েটি মামলা না করায় ছেলেটি আরেকটা শিকারের আশায় ছুটতে শুরু করে। কেউ যদি সাহস করে মামলা করেও বসে তখনও দেখা যায় ছেলের পরিবারের সদস্যরা ছেলেটিকে বাঁচানোর জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে! আইনের ফাঁক গলে ছেলেটি বের হয়ে আসে কিংবা যদি অপরাধ প্রমাণিত হয়েও যায় তাহলে শাস্তির মাত্রা তেমন কিছু না হওয়ায় কয়েক বছর পরে ছেলেটি জেল থেকে বেরিয়ে এসে আবার নতুন কোন ফাঁদ পাতার পরিকল্পনায় ব্যস্ত হয়ে যায়। কিন্তু এর মাঝেই মেয়েটি চলে যায় লোকচক্ষুর অন্তরালে। সম্ভাবনাময় মেয়েটিও নিজেকে গৃহবন্দী করে রাখে, নাহয় সমাজচ্যুত হতে বাধ্য হয়।

এই পশুগুলো এসব করার সুযোগ পায় মূলত দুইটি কারণে। এক, মেয়েরা লোক লজ্জার ভয়ে মুখ খুলতে চায় না এবং ছেলেটির হাতের পুতুলে পরিণত হয়। দুই, চলমান আইনে শাস্তির বিধান এতোই সামান্য যে এটা মানুষের মনে ভয় জাগাতে অক্ষম। সর্বনিম্ন ২ বছর থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং এর অতিরিক্ত এক থেকে প্রায় ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থ দণ্ড কখনোই একজন মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার উপযুক্ত শাস্তি হতে পারেনা। একটি জীবন এভাবে ধ্বংস করে দেয়ার শাস্তি এতো কম?

এই দুইটি কারণের বাইরেও যে কারণটা আছে সেটা হচ্ছে আমাদের মানসিকতা। মানসিক ভাবে আমরা এতোটাই পিছিয়ে আছি যে আমরা অপরাধীকে আড়াল করে অপরাধের শিকার মেয়েটিকে অপমান করা নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পরি। যেখানে অপরাধী ছেলেটিকে শাস্তি দেয়া, সমাজচ্যুত করার কথা, সেখানে আমরা মেয়েটিকে ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করি। আর সেই সুযোগেই পাশবিক মানসিকতার প্রসার ঘটে আমাদের সমাজে।

এসব কিছুর পরও বলবো ঐ নরপশুর বিচার চাই। ওর শাস্তি চাই। নিজেদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তটি ভাইরাল করে সে শুধু অন্যায় করেনি, করেছে গর্হিত অপরাধ। একজন মানুষকে এভাবে অপমান করার অধিকার তার নাই। কারো বিশ্বাস ভঙ্গ করে প্রতিশোধ নেয়ার নামে তার জীবন ধ্বংস করার কোন অধিকার তার নাই।

পাশাপাশি মেয়েটার প্রতি সহানুভূতি দেখানোর দুঃসাহস করবো না। বরং পাশে থাকার আশ্বাস দিব। আশা করবো মেয়েটা দুঃস্বপ্নের প্রহর ডিঙ্গিয়ে আবার স্বপ্ন দেখার সাহস করবে। ভালোবাসবে, ভালোবাসতে উৎসাহিত করবে। আর রুচিহীন অতি উৎসাহী মানুষগুলোকে বলবো, আপনাদের শুভবোধের উদয় হোক।

দেবজ্যোতি দেবু, সংস্কৃতি কর্মি, অনলাইন এক্টিভিস্ট

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ১৯ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৮৯ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ