আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

আমি একজন মা হিসাবে দাবি করছি

লীনা পারভীন  

উত্তরায় খুন হওয়া আদনান সোনার ছবিটি আমি চোখের সামনে দেখতে পারছিনা। খুন হওয়া আদনানের মুখটি যেনো আমার সন্তানের মুখ। সেও কাছাকাছি বয়সের। ঠিক একই ধরনের তারও একটি ছবি আছে। টিভিতে দেখেছিলাম নিউজটি। পরদিন পত্রিকার পাতায় জানলাম এলাকার দুই গ্রুপের কোন্দলের শিকার হয়েছে আদনান।

চোখের সামনে ভেসে উঠলো আমার ছেলেরাও প্রতিদিন ব্যাডমিন্টন হাতে বিকালে বাইরে খেলতে যায়। জানিনা তারাও কোন গ্রুপের সাথে মিশে যাচ্ছে কিনা? আমি একজন কর্মজীবী মা। সে হিসাবে আমি সারাদিন বাইরে থাকি। তাদের বাবাও ব্যস্ত থাকেন তার কাজে। সারাদিন আমার দুটি বাচ্চা একা থাকে বাসায়। যোগাযোগ বলতে একমাত্র ফোনেই কথা বলা। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে যতটুকু খোঁজ নেয়া যায়।

বাচ্চাদের পরীক্ষা শেষ। এখনো স্কুল ঠিকমতো শুরু হয়নি। এই অবসর সময় বাচ্চারা কীভাবে কাটাবে? সন্তান এখন বড় হচ্ছে। ক্লাস এইট শেষ করেছে। তাদের একটা নিজস্ব মতামত গড়ে উঠছে। এখন আর তারা আমার কথামত ১০০ ভাগ চলতে চায়না। ঘরে বসে খেলা এখন আর তাদের পোষায় না। বাইরে খেলতে যাওয়া তাই তাদের দাবি।

ভেবে দেখি আমরাও কী ঘরে বসে থাকতাম? পরীক্ষা শেষ হলেই আমরা চলে যেতাম গ্রামের বাড়ীতে। সেখানে সারাদিন মাঠেঘাটে বন্ধুদের সাথে ঘুরাঘুরি, পুকুরে গোসল করে দুপুরে ভাত খেয়ে আবার বিকালে মাঠে খেলতে যাওয়া। আমার সন্তানকে তো আমি সেই পরিবেশ দিতে পারছিনা।

একা একা তাদেরকে তাদের দাদুর বাড়ীতেও পাঠাতে সাহস পাচ্ছিনা। আবার নিজেও সময় দিতে পারছিনা। তাহলে তাদের বিনোদন কোথায়? সারাদিন গ্যাজেট নিয়ে বসে থাকলেও আমরা বাধা দিচ্ছি।

এতসব অপরাধবোধ থেকে ছেলেদেরকে বাইরে খেলতে যাওয়ার অনুমতি দেই। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে যখন পত্রিকার পাতা খুলে আদনানের খুনের খবরের বিস্তারিত পড়া শুরু করলাম, বুকটা কেঁপে উঠলো। হায়!! আমার দুই যমজ ছেলেও তো এখন বাইরে বন্ধুদের সাথে সেই একই ব্যাডমিন্টন খেলতে গেলো। দৌড়ে গিয়ে তাদের ডেকে আনলাম। খবরটি পড়তে দিলাম। দেখলাম তারা আমার আগেই বিস্তারিত জেনেছে। জানতে চাইলাম কীভাবে জানো? উত্তর পেলাম, তাদের বন্ধুদের মাঝে আলোচনা হয়েছে এটি নিয়ে। তাদের সোর্স অব ইনফরমেশন এবং গবেষণা বলছে ওখানে খেলার মাঠেই ছিলো দুটি গ্রুপ। এক গ্রুপ আরেক গ্রুপকে দেখে নিবে বলে হুমকি দিয়েছিলো, আদনানের জীবনের বিনিময়ে সেই দেখে নেয়ার শোধ নিলো। আমি জানিনা আদনান সত্যি কোন গ্রুপে মিশেছিলো কিনা। কেবল অবাক হয়ে ভাবলাম, এই বয়সের আবার কীসের গ্রুপ?

এই বয়সী ছেলেরা তো সবাই একে অপরের বন্ধু হবার কথা। শত্রু হবে কেন? আমাদের বয়সেও তো খেলার মাঝে মতের অমিল হতো। আমরা কাট্টি নিতাম। কয়েকদিন কথা বন্ধ থাকতো আবার বুড়ো আঙ্গুল মিলিয়ে ভাব করে নিতাম। তাহলে এ কোন যুগ এসে পড়লো যেখানে ক্লাস এইটে পড়া বাচ্চারা একে অপরের গ্রুপের মধ্যে আটকে যাচ্ছে?

জানার চেষ্টা করলাম, আমার ছেলেদের মধ্যে সেরকম কোন গ্রুপিং আছে কী না? জানালো না, আমাদের মধ্যে কোন গ্রুপিং নাই। তবে ওদের খেলার মাঠেই একদল সিনিয়র আছে আরেকদল জুনিয়র আছে। কিছুদিন আগেই আমার কাছে কমপ্লেইন করছিলো, মা আমরা কষ্ট করে ব্যাডমিন্টন মাঠ বানালাম আর সিনিয়র ভাইয়েরা এসে সেটা দখল করে নিলো। এরপর তারা বাধ্য হয়ে অন্য আরেকটি মাঠে চলে গেলো। আমি ওদের সাবধান করেছিলাম যেন এ নিয়ে আর বাড়াবাড়ি না করে। কে জানে হয়তো আদনানের ক্ষেত্রেও এরকমই কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিবাদ বেঁধেছিলো বা অন্য কোন কারণ।

আরেকটি সূত্রে শুনলাম, সেখানে ডিস্কো গ্রুপ নামের একটি গ্রুপ আছে যারা মাদকের সাথে জড়িত। কেউ কেউ বলছে, এটাও একটা কারণ হতে পারে। সেই একই গ্রুপ এর আগেও একইরকমভাবে অন্য আরেকটি ছেলেকে মারধর করেছে। ফেইসবুকে জানলাম, আদনানকে মারার সময় সেখানে উপস্থিত ছিলো অনেকেই, কাছেই ছিলো কল্যাণ সমিতি।

কেউই এগিয়ে এসে থামায়নি সেই বর্বরতাকে, কেউ পুলিশে খবর দেয়নি। আদনানকে মারধরের ঘটনা ঘটে সন্ধ্যা ৬ টায় আর তার পরিবার খবর পায় ৭ টায়। কী ভয়ঙ্কর বিষয়। আমি তো অফিস থেকে বাসায় ফিরি আরও পরে। বাচ্চার বাবা ফিরে আরও রাতে। তার মানে কখনো যদি আমার আদরের সন্তানরা কোন বিপদে পড়ে তাহলে তাদেরকে রক্ষা করারও কেউ থাকবেনা। আমাকেই বা কে খবর দিবে? কী অনিরাপদ একটি দেশে বাস করছি আমরা? আগে কোন পরিবারের কেউ যদি কোন বিপদের পড়তো তাহলে প্রতিবেশীরা এগিয়ে আসতো সেই বিপদে সাহায্য করার জন্য। এখনো সেই ভরসাও নাই। আমার সব প্রতিবেশী তো আমাকেও চিনেনা, আমার সন্তানদেরকেও চিনেনা।

আর ভাবা যাচ্ছেনা। এই বিপদের সমাধান হিসাবে আমি সন্তানদের আদেশ দিলাম কাল থেকে তোমাদের মাঠে খেলতে যাওয়া বন্ধ। ঘরে বসেই যা খেলার খেলবে। ছেলেরা সাথে সাথে প্রতিবাদ করলেও আমার আদেশ মেনে নিলো। বড্ড অপরাধবোধ কাজ করলো আমার ভিতর। কী করলাম আমি? কেন তাদের এই আদেশ দিলাম? নিজের কাছে নিজের কোন উত্তর জানা নেই। আমিতো আদেশ দিয়েই দিলাম কিন্তু মনিটর করবে কে? ওরা যে আমাকে লুকিয়ে বাইরে যাবেনা তারই বা গ্যারান্টি কী? তাহলে কী করবো আমি? আমি কী চাকরী ছেঁড়ে দিয়ে ঘরে বসে ওদের পাহারা দিব? এটা কী কোন সঠিক সমাধান এই সমস্যার?

আজকে দেশের যেদিকেই তাকাই কেবল অরাজকতা চলছে। জানিনা আদনান হত্যার বিচার হবে কী না? জানিনা আদনানের মায়ের কান্না আমাদের আদালতে পৌঁছাবে কী না? সন্তানদের যে কোন ইস্যু আসলেই আমরা আঙ্গুল তুলি পরিবারের দিকে। দায়ী করি পরিবারের সদস্যদের। কিন্তু একজন মাকে যেমন কাজ করতে হবে তেমনি একজন বাবাও কাজ করবে, বাইরে যাবে এটাই স্বাভাবিক। আমরা বর্তমানে বাস করি একটি নিউক্লিয়াস পরিবারের কনসেপ্টে যেখানে বাবা আর মা ছাড়া পরিবারের সদস্য আর কেউ না। এই একক পরিবারের সন্তানকে তবে দেখা শুনা করার মত আপনজন কোথায় পাবো আমরা?

শেষ ভরসার জায়গা হচ্ছে এই দেশ এই সমাজ। আমরা কেবল আশা করতে পারি এই সন্তানের রক্ষকের ভূমিকায় এগিয়ে আসবে এই রাষ্ট্র। একটি রাষ্ট্রই পারে তার নাগরিকের মধ্যে নৈতিক শিক্ষার বুনিয়াদ গড়ে দিতে। এই রাষ্ট্রই পারে দেশে একটি শক্ত আইনশৃঙ্খলার কাঠামো গড়ে তুলতে যেখানে নাগরিক হিসাবে আমি আমার সন্তানকে বাইরে যেতে দিতে নিরাপদ বোধ করবো। এই রাষ্ট্রই পারে সমাজ থেকে অন্যায়কে বিদায় জানাতে একটি পরিবেশ গড়ে দিতে। এই রাষ্ট্রই পারে মানুষের মাঝে মনুষ্যত্ব এবং মায়া মমতাকে ফিরিয়ে আনার মত শিক্ষার নিশ্চয়তা দিতে।

তাই একজন মা হিসাবে চাই আমার আদনানরা যেন নিশ্চিন্তে খেলাধুলা কোরতে পারে সেই নিরাপত্তা দিক আমার রাষ্ট্র, একজন সচেতন নাগরিক হিসাবে চাই এই আদনানের মত যত হত্যাকাণ্ড হচ্ছে তার বিচার নিশ্চিত করুক এই রাষ্ট্র। একজন নারী হিসাবে চাই আমার মত কোন কর্মজীবী মাকে যেন তার সন্তানের নিরাপত্তার কথা ভেবে কর্মজীবন থেকে অবসরে যাওয়ার কথা না ভাবতে হয় সে নিশ্চয়তা দিক এই রাষ্ট্র।

লীনা পারভীন, কলাম লেখক ও সাবেক ছাত্রনেতা

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ