প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
জান্নাতুল মাওয়া | ০৮ মার্চ, ২০১৭
ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় এক ক্লাসমেটের ওপর ভয়ানক রেগে গিয়েছিলাম যখন সে বলেছিলো, তার বয়েসী একটা ছেলে যত স্ট্রাগল করে সেই তুলনায় একটা মেয়ে নাকি কিছুই করে না। সে মূলত তার অবস্থার সাথে তার সেইসব মেয়ে ক্লাসমেটদের অবস্থা মেলাচ্ছিলো, যাদের ঢাকায় বাসা আছে। দেশের স্বনামধন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের কী অদূরদর্শী আর অপরিপক্ব চিন্তা! সে যদি আরো সংবেদনশীল আর চিন্তাশীল হতো তবে বুঝতে পারতো সে যে গ্রাম থেকে কিংবা যে পরিবার থেকে এসেছে সেই গ্রামের তার অন্য বোনেরা কিংবা তার সমবয়সী মেয়েরা কিন্তু এই অবস্থানে আসার সুযোগই পায় নাই। সে একটা ছেলে হবার কারণে তার পারিবারিক বা সামাজিক অবস্থান কে ডিঙ্গিয়ে নিজের জন্যে একটা পরিচয় তৈরি করে নেবার সুযোগ পেয়েছে। অথচ ঠিক তার মত পারিবারিক অবস্থায় থাকা একটি মেয়ে কিন্তু নিজের অবস্থা পরিবর্তন করার সুযোগটা পর্যন্ত বেশিরভাগ সময় পায়না। সে ঢাকায় চলে এসেছে বলে এবং তার অন্তরের চোখ নাই বলে সে তার সেইসব বোনেদের স্ট্রাগলটা চোখে দেখতে পায়না, উপলব্ধিও করতে পারেনা, আফসোস!
তার সাথে একই স্কুলে যে মেয়েটি পড়তো, কিংবা ঠিক তারই কাছাকাছি বয়সের তার বোন সে ঢাকায় পড়তে আসতে পারে নি। কী করছে সে? চলুন দেখে আসি।
ছেলেটি যখন খুব স্ট্রাগল করে হলের বারান্দায় ঘুমাচ্ছে, সেই সময় তার বোনটি শ্বশুরবাড়িতে খুব ভোরে উঠে রান্নাবান্নার কাজে লেগে গেছে! তার ‘স্বামী’ হয়তো মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশে থাকে, শ্বশুর বাড়ির স্বজন-বান্ধব হীন পরিবেশে তাকে যে সংগ্রাম করতে হয় প্রতিনিয়ত তার আসলে কোন মূল্যই নাই সমাজে, এমন কি তার নিজের কাছেও নাই।
কারণ সে এই স্ট্রাগলের বিনিময়ে দশ বছর পর কোন প্রমোশন পাবেনা, দশ বছর পরেও তাকে ঠিক চুলাই ঠেলে যেতে হবে, হয়তো চুলাটা পাকা হতে পারে, স্বামীর পাঠানো টাকায় তার শ্বশুরবাড়িটাও পাকা হতে পারে, সেই সাথে তার চুলও পেকে যেতে পারে, দিনের পর দিন নানান কষ্ট অন্তরে আর শরীরে লালন করতে করতে খুব দ্রুত সে বুড়িয়ে যেতে পারে। তার নিজের অবস্থার মৌলিক কোন উন্নতি কিন্তু এতে হবেনা।
আর অপরদিকে তার ভাইটি শহরে গিয়ে 'স্ট্রাগল' করে পড়াশুনা করছে । দশ বছর পর এই ছেলেটা চাকরিতে প্রমোশন পাবে, আরো স্মার্ট হবে, নিজের অবস্থার পরিবর্তন ঘটাবে, সবাই তাকে নিয়ে গর্ব করবে, সেও তৃপ্তির ঢেকুর তুলে সবার কাছে নিজের স্ট্রাগলের গল্প করবে।
অর্থাৎ একই পারিবারিক-সামাজিক অবস্থানে থেকে, জীবনের সাথে যুদ্ধ করে একই পরিবারের দুই ভাই বোনের একজন হয়তো তার অবস্থার থেকেও নিচু অবস্থায় চলে যাবে, সবই নির্ভর করবে তার শ্বশুর বাড়ির আর ‘স্বামীটির’ অবস্থার ওপর। আর ভাইটি নিজের অবস্থার পরিবর্তন করবে, আর সবাইকে স্ট্রাগলের গল্প শুনিয়ে বাহবা নিবে।
বলতে পারেন কীভাবে আমি এত নিশ্চিত হলাম এই পরিণতির ব্যাপারে? নিশ্চিত হলাম এইজন্যে যে ঠিক একই গল্প যুগের পর যুগ চলে আসছে, হয়তো পাত্র পাত্রীদের পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু গল্পটা একই! একদম একই!
আমি ঠিক এমনই একটি গল্প খুব কাছ থেকে দেখেছি। মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী বাংলাদেশের একটি পরিবার বেশ কয়েক বছর অনেক কষ্টকর সময় কাটিয়েছিলো। কষ্টটা পরিবারের ভাই বোন সবাই মিলেই ভাগাভাগি করেই করেছিলো। পরিবারের একটি মেয়ের পড়াশুনা মাঝপথে বন্ধ করে দেয়া হলো, কারণ সেই মুহূর্তে তাদের বাবা এতবড় পরিবারের এতজনের খরচ বহন করতে পারছিলেন না, ওই মেয়েটিই ছিলো তখন বড় এবং সহনশীল। সে ঘরের সব কাজে ভীষণ পারদর্শী। তাই তাকে ঘরের কাজে লাগিয়ে দেয়া হল, শুরু হল তার চুলা ঠেলার জীবন। তার রান্না করা খাবার খেয়েই তার ভাই হয়তো ক্লাসে যেতো, কাজে যেতো। কিন্তু, তার ভাই ভাবতো সংসারের জন্যে সে খুব কষ্ট করছে, বোনও এমন টাই ভাবতো! সে ও যে সংসারের জন্যে কত বড় স্যাক্রিফাইস করেছে এটা সে জানতোই না!
তারপর মেয়েটাকে বিয়ে দেয়া হলো, ভাগ্যক্রমে এবং মেয়েটির বাবার সামাজিক অবস্থানের কারণে খুবই মেধাবী এক ছাত্রের সাথে এবং বেশ ভালো পরিবারেই তার বিয়ে হলো। ব্যাপারটা খুবই রিস্কি ছিলো, এই ছেলেটি মেধাবী, কিন্তু কেউ জানেনা যে ছেলেটি আসলে এই মেধা নিয়ে কতদূর যাবে। তখনো সে ছাত্র। তার নিজস্ব কোন আয় নেই। ছেলেটির বাবা সেই অঞ্চলের বিশিষ্ট ব্যক্তি, যথেষ্ট সম্পদশালী। সুতরাং খাওয়া পরার অভাব হবেনা এটা নিশ্চিত। একটা মেয়ের খাওয়া পরা ছাড়া আর বেশি কী লাগে? মেয়েটা গান শুনতে ভালোবাসতো, বিয়ের আগে তার বাবা তার জন্যে রেডিওর ব্যাটারি নিয়ে আসতো নিয়মিত। হয়তো মনে মনে মেয়ের লেখাপড়া বন্ধ করে দেয়ার জন্যে লজ্জিত ছিলেন তিনি। বিয়ের পরে বাড়ির বউয়ের গান শোনাও বন্ধ হলো। দূরে কোথাও থেকে ক্ষীণ কোন সুর শুনতে পেলেও সে তৃষ্ণায় কান পেতে থাকতো । যারা গান শুনতে ভালোবাসেন তারাই বুঝবেন এই কষ্টটা ঠিক ক্যামন। (আসলে এই মেয়েটার বাকি কষ্টের কাছে গান শোনার কষ্টটা সাধারণ দৃষ্টিতে কিছুইনা, আমি এর উল্লেখ করলাম এই জন্যে যে আমি নিজে প্রচণ্ড গান পাগল এবং আমি মেয়েটার সেই কষ্টটা অনুভব করতে পারি)।
সারাজীবন ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে, আধুনিক একটা পরিবারে বেড়ে ওঠা একটা মেয়েকে হঠাত গ্রামে চলে যেতে হলো। ব্যাপারটা যত সহজ ভাবছেন তত সহজ না! এটা এখনকার আধুনিক গ্রাম না, ৩৬ বছর আগের বাংলাদেশের একটা গ্রাম ঠিক কেমন হয় চিন্তা করে দেখেন তাহলে বুঝতে পারবেন, মেয়েটা প্রতিদিন কতটা স্ট্রাগল করতো! টয়লেট চেপে রাখতে রাখতে তার কোষ্ঠকাঠিন্য হয়ে গিয়েছিলো। বাথরুমে গোসল করে যার অভ্যেস তাকে যেতে হত পুকুরে, তাও শাশুড়ির কড়া নির্দেশ ছিলো, মাথায় কাপড় রেখে পাঁচ মিনিটের মধ্যে গোসল করতে হবে। যে মেয়েটির নিজের জন্ম হয়েছিলো হাসপাতালে, সে তার সন্তানকে জন্ম দিয়েছে গ্রামের দাই এর হাতে। তার হাজব্যান্ড যখন বিদেশে পড়তে গিয়েছিলো সে একাকিনী সেই গ্রামে দিনের পর দিন কীভাবে কাটিয়েছে কেউ তাকে জিজ্ঞেসও করে নি।
বোনটি যখন গ্রামে চুলা ঠেলছে ঠিক সেই সময় হয়তো তার ভাই অন্য কোন দেশে তুষারপাত দেখতে দেখতে, গরম কফি হাতে নিয়ে তার বউকে গল্প করছিলো কী ‘স্ট্রাগল’ করে আজকে সে সরকারী কর্মকর্তা হয়ে বিদেশে আসতে পেরেছে!
আমি এই ভাইটির স্ট্রাগল কে ছোট করছিনা, আমি শুধু দুঃখ করছি এই বোনটির জন্যে যে জানেওনা সে ঠিক কেন এত সংগ্রাম করছে, তার এই দিনের পর দিন খেটে মরার রেজাল্ট কী হবে। সে আসলে জানেইনা সে আদৌ স্ট্রাগল করছে কি না! কারণ তার এইভাবে জীবনের ঘানি টানার বিনিময়ে সে তার অবস্থার কোন পরিবর্তনই করতে পারছে না। তার অবস্থার তখনই পরিবর্তন হবে যদি তার হাজব্যান্ডটি ‘স্ট্রাগল’ করে কিছু একটা করতে পারে।
তারপর সৌভাগ্যক্রমে একদিন এই বোনটির হাজব্যান্ড বেশ ভালো অবস্থানে যায়, এবং বোনটিও হাজব্যান্ডের পিছু পিছু ভালো অবস্থায় যায়। আবার নিয়তির লিখনে খুব তাড়াতাড়িই তার হাজব্যান্ড মারা যায়। আবার শুরু হয় মেয়েটার ‘স্ট্রাগল’ । তাকে হাজব্যান্ডের কর্মস্থলে চাকরি দেয়ার কথা আসে। কিন্তু, ওই যে সে তো পরিবারের জন্যে পড়াশুনা শেষ করতে পারেনি, তাই আবার তাকে তার ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে স্ট্রাগলে নেমে পড়তে হয়। এই স্ট্রাগলের যেন কোন শেষ নেই। কোন ফলাফলও নেই। কী ক্লান্তিময় একঘেয়ে একটা জীবনকে যে এই মেয়েটা বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে শুধু সে ই জানে। আর তার ভাইয়ের তখন পরিবার জোড়া সুনাম, ছেলে মেয়েদের কাছে তিনি গর্ব করে তার তরুণ বয়সের সংগ্রামের গল্প করেন, আর পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছুটে বেড়ান।
একজন নারীর সংগ্রাম আক্ষরিক অর্থেই চুলোয় যায়, তার নিয়তি তাকে যেদিকে নিয়ে যায় সে সেদিকে যেতেই বাধ্য হয়। তাই তার স্ট্রাগল নিয়ে কেউ গর্ব করেনা , সেও তার সন্তানদেরকে বলার মত কোন গল্প খুঁজে পায়না।
আজকে যারা নারীর চাকরি বাকরি কী দরকার বলে লম্বা লম্বা বক্তৃতা ছাড়ে সেই তারাই নিজেদের বোনেদের জীবন ভর করে চলা সংগ্রামের কোন মূল্যায়ন করেনা। এসব অসংবেদনশীল, অদূরদর্শী মানুষদের জন্যে করুণা হয়! সৃষ্টিকর্তা এদের অন্তর দিয়েছেন কিন্তু সেই অন্তরে কোন দৃষ্টি দেননি!
যখন এই লেখা লিখছি আমার অন্তর থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। আমি নারীবাদী, কারণ এই অজস্র বোনদের আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি, অন্তর দিয়ে অনুভব করেছি তাদের কষ্ট। নারীবাদ শিখতে আমাকে পশ্চিমের ভার্জিনিয়া ওলফ পড়তে হবেনা। আর কোন রকম তত্ত্ব জ্ঞান দিয়ে কিংবা ভয় ভীতি দেখিয়ে আমাকে আমার পথ থেকে সরানোও যাবেনা। যেদিন দেখবো এইসব বোনেদের স্ট্রাগলের সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে সেদিন ভাইদের স্ট্রাগলকেও সম্মান করবো।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য