আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

মরে গিয়ে যেন ধর্ষণ প্রমাণ করতে না হয়!

জুয়েল রাজ  

এক সপ্তাহ হয়নি শিশুকন্যা আয়েশাকে (৮) নিয়ে গাজীপুরের শ্রীপুর স্টেশনের চলন্ত ট্রেনের নিচে ঝাপ দিয়েছিলেন দরিদ্র হযরত আলী (৪৫)। সেখানেই মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটেছিল পিতা ও মেয়ের। মৃত্যু দুইটি অন্যান্য ঘটনার মতো ছিল না, ৮ বছরের ধর্ষিত মেয়ের বিচার না পেয়ে হযরত আলী মেয়েকে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। শেষ খবর পর্যন্ত গাজীপুরের এক আওয়ামী লীগের নেতা হযরত আলীর পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়েছেন। ধর্ষকের গ্রেপ্তার কিংবা বিচারের কি হবে আমরা জানি না।

রোববারের সংবাদ মাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচিত বিষয় ছিল রাজধানীর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া দুই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের অভিযোগে প্রভাবশালীদের সন্তানদের বিরুদ্ধে করা মামলা। এর মধ্যে এক এমপির ছেলেও আছে বলে বলছে সংবাদ মাধ্যমগুলো, যদিও সেই এমপির নাম প্রকাশ করেনি কোন সংবাদপত্র। ইতোমধ্যে আপন জুয়েলার্সের মালিক তাঁর ধর্ষক ছেলের পক্ষ নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে বিবৃতি দেয়া শুরু করেছেন। নানারকম যুক্তি-তর্ক মিডিয়াকে ছুঁড়ে দিচ্ছেন। এ যেন বাংলা সিনেমার কাহিনীর মতো। ভিলেনরা যেভাবে তাদের ধর্ষক ভাই বা ছেলেকে, প্রমাণের অভাবে আদালত থেকে বেকসুর খালাস করে নিয়ে আসেন। রাষ্ট্রের কাছে সাধারণ মানুষের চাওয়া কী আসলে? রাজনীতিবিদ ,আমলা, ব্যবসায়ী আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাচ্ছেন। ব্যাংক লুট করছেন, দেশের টাকা বিদেশে পাচার করছেন, অন্যদিকে দেশের রিজার্ভ একের পর এক রেকর্ড ভেঙে চলছে, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মিত হচ্ছে, উন্নয়নের মাইলফলক গড়ছে বাংলাদেশ। কিন্তু সাধারণ মানুষের চাওয়া পাওয়া এসব নয়।
সাধারণ মানুষ চায় ন্যায় বিচার। রাষ্ট্রের কাছে ন্যায় বিচার প্রাপ্তিটাই মূল চাওয়া।

সাফাত আহমেদ, নাইম আশরাফ, সাদমান সফিককে ধন্যবাদ! অন্তত মেয়ে দুটিকে খুন করে নি। তারা চাইলে ড্রাইভার বডিগার্ড সহ মিলে খুন করে লাশ গুম করে ফেলতে পারত। এই কাজটুকু না করার জন্য ছোট একটা ধন্যবাদ পেতেই পারে!

সোহাগী জাহান তনু হত্যার এক বছর পেরিয়ে গেছে, এখনো কোন আসামী ধরা পড়েনি। আদৌ ধরা পড়বে সেই সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয়না।

এইবার প্রথম সংবাদ মাধ্যমগুলো দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছে। চলতি সপ্তাহেই কোন এক পত্রিকায় এক ধর্ষিতার নাম বাসার ঠিকানা সহ প্রকাশ করেছিল। যদিও বাংলাদেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই বিষয়ে আইন করা আছে। বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে সুরক্ষা: ২০০০ সালে প্রণীত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১৪ ধারায় নির্যাতিত নারী ও শিশুর পরিচয় প্রকাশের ব্যাপারে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। ১৪(১) ধারায় 'নির্যাতিত নারীর পরিচয় প্রকাশে বাধাদান' শিরোনামে বলা হয়েছে, যে নারী এই আইনের অধীন কোনো অপরাধের শিকার হয় সেই অপরাধ বা অপরাধের আইনগত কার্যধারার সংবাদসহ নাম-ঠিকানা বা অন্য কোনো তথ্য কোনো সংবাদ-মাধ্যমে এমনভাবে প্রকাশ করা যাবে না, যাতে ওই নারীর পরিচয় প্রকাশ পায় এবং ১৪(২) ধারায় এ নিষিদ্ধ কাজটি করলে তার শাস্তির বিধানের কথাও বলা হয়েছে। ১৪(১) ধারায় বলা হয়েছে যে নারী নির্যাতনসংক্রান্ত সংবাদ এমনভাবে ছাপাতে হবে, যাতে ওই নারীর পরিচয় প্রকাশ না পায়। ১৪ ধারার ২ উপধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো সংবাদপত্রে নির্যাতিত নারীর পরিচয় ছাপানো হয়, তবে তার জন্য দায়ী ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের প্রত্যেকে সর্বোচ্চ দুই বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা জরিমানা অথবা তিনি বা তারা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। কিন্তু আমাদের সংবাদ মাধ্যমগুলো টিআরপি বাড়াতে অনলাইনে পাঠক আর ক্লিক বাড়াতে সেসব খুব কমই তোয়াক্কা করে থাকে।

২০১০ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত ধর্ষণের চেষ্টা, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, ধর্ষণের পর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ৪ হাজার ৪২৭টি। এর মধ্যে মামলা দায়ের করা হয়েছে ২ হাজার ৭৩৪টি। গত ছয় বছরে ধর্ষণের পর ৫০৮ নারীকে হত্যা করা হয়েছে। তবে হত্যা করার পরও সব পরিবার মামলা বা আইনের আশ্রয় নেয়নি। এর মধ্যে মামলা হয়েছে মাত্র ২৮০টি ঘটনায়। আর ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ১৬৮ নারী এবং মামলা হয়েছে মাত্র ১১৩টি।বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৮ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত আট বছরে ধর্ষণের শিকার ৪ হাজার ৩০৪ জনের মধ্যে ৭৪০ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে।

ধর্ষিতা মেয়ে দুটি এখনো বেঁচে আছে। এই বিষয়টা ঠিক হয়নি! আমরা জীবিতদের ভালবাসিনা, মৃতদের পূজা দিতে পছন্দ করি। হুমায়ুন আজাদ বলে গেছেন ‘‘বাঙালি মুসলমান জীবিত প্রতিভাকে লাশে পরিণত করে, আর মৃত প্রতিভার কবরে আগরবাতি জ্বালে। দিল্লীর চলন্ত বাসে দামিনী নামে এক মেয়েকে ধর্ষণ করে বাস থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে খুন করেছিল ধর্ষকরা, শুধু ভারত নয় সেদিন সারা বিশ্বেই প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। দামিনীর ধর্ষকদের বিচারও হয়েছে। সারা পৃথিবী আলোড়িত ছিল দামিনীর নামে কিন্তু তার প্রকৃত নাম সরকার বা সংবাদমাধ্যম কেউ প্রকাশ করেনি। দামিনীর পিতা বহু পরে মেয়ের প্রকৃত নাম প্রকাশ করেছিলেন জ্যোতি সিংহা।

বাংলাদেশের ধর্ষিত দুইজনের পক্ষে এখনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছাড়া কোথাও কেউ পক্ষে দাঁড়িয়েছেন বলে চোখে পড়েনি। আপন জুয়েলার্সের মালিকের মতো অনেকেই হয়তো ভাবছেন মেয়ে দুটি খারাপ, রাতে কেন হোটেলে গেল? কেন বন্ধুর জন্মদিনের পার্টিতে গেল? মেয়ে তোমার বন্ধু থাকতে নেই। তুমি অবরোধবাসিনী। বাইরে তোমাকে মানায় না।

ধর্ষকদের পক্ষেও অনেকই সাফাই গাইতে শুরু করে দিয়েছেন। যেভাবে হলি আর্টিজান হত্যাকাণ্ডের সময় একদল জ্ঞানপাপী জঙ্গিদের পক্ষ নিয়েছিল। এবার পক্ষ নিচ্ছে ধর্ষকের। অপরাধী যতো শক্তিশালী হউক ধর্ষক যতো প্রভাবশালী হউক, মেয়ে দুটির পাশে দাঁড়ান। যেদেশে হাজার হাজার ধর্ষণের ঘটনা পরিবার পাশের পরিবারটিকে পর্যন্ত জানাতে চায় না। সমাজের ভয়ে। সেইদেশে একমাস পরে হলেও এরা সামনে এসেছে, মামলা দায়ের করেছে। এদের বাঁচিয়ে রাখুন। সংবাদ মাধ্যমগুলো যেন রসালো গল্প ছাপাতে প্রতিযোগিতায় না নামেন। না হয় দামিনীর মতো ছদ্মনাম দিয়েই এদের পক্ষে দাঁড়ান। কাদম্বিনীর মতো মরিয়া গিয়া যেন প্রমাণ করিতে না হয়, তাহারা ধর্ষিত হইয়াছিল।

রোববার আর ও দুইটি সংবাদ বিভিন্ন সংবাদের আড়ালে হয়তো চাপা পড়ে গিয়েছে। ঠাকুরগাঁয়ে মসজিদের ভিতর ৮ বছরের এক বালিকাকে ধর্ষণ। রাজধানীতে মাদ্রাসায় এক শিশুকে হাত পা মুখ বেঁধে বলাৎকার। কোথাও আর নিরাপদ না। খেটে খাওয়া মানুষ এসব ঘটনার বিচার চায়, নিরাপত্তা চায়। এরা উন্নয়ন বুঝে না, জিডিপি বুঝেনা, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ বুঝে না। সেই নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনতে ধর্ষকের সাজা মৃত্যুদণ্ড অথবা অঙ্গহানির বিধান থাকা আবশ্যকীয় হয়ে গেছে!

জুয়েল রাজ, সম্পাদক, ব্রিকলেন; যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি, দৈনিক কালেরকন্ঠ

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ