আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

প্রবৃদ্ধির দেশে উলম্বরৈখিক যৌনসন্ত্রাস

মুনীর উদ্দীন শামীম  

ছবি শুধু ছবি নয়
এক ছবি হাজার কথার শামিল। কবে পড়েছিলাম, কোথায় পড়েছিলাম, আজ আর মনে নেই। শুধু মনে আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখারও অনেক আগে, কথাগুলি কোথায় যেন পড়েছিলাম। শুধু পড়িনি, পড়াটা সেদিনের কিশোর মনে খুব দাগও কেটেছিল। আর দাগ কেটেছিল বলেই কোনোকোনো ছবির আবেদনে অভিভূত হলে অথবা ছবির অর্থের তাৎপর্য দেখে আজও মনে পড়ে যায়, মনের অজান্তেই উচ্চারণ করি- এক ছবি হাজার কথার শামিল। সব ছবি হয়তো সে রকম নয়; কিন্তু কোনোকোনো ছবি সত্যি- হাজার কথার শামিল হয়ে ওঠে।

গাজিপুরের হালিমার ছবিটিও সে রকম। ছাপা হয়েছিল একটি নয়; একাধিক দৈনিকে। তাও আবার প্রথম পাতায়। হালিমা তাকিয়ে আছেন কোন এক সীমাহীন দিগন্তে। সে দিগন্ত সম্ভাবনাহীন। অন্ধকার। না- পাওয়ার। দু:স্বপ্নের। চরম হতাশার। অবহেলার। প্রতিকার চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার। কিছু বুঝে না ওঠার আগেই হঠাৎ করেই সবকিছু হারাবার। এবং অবশ্যই অসীম বেদনার। যার শুরু আছে, শেষ নেই। হালিমার ছবিটির দিকে তাকানো যায় না। আবার চোখ ফিরিয়ে নেবেন, সেটিও সম্ভব নয়। বরং ছবিটিই পুরো সংবাদটি পড়তে বাধ্য করে আমাদের। তিনি হতবিহবল। চেহারায় নেই কোন উজ্জ্বলতা। নেই জৌলুস। এটি বলবার দরকার নেই- হালিমা দরিদ্র। মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি)’র প্রবৃদ্ধি রেখা ক্রমাগত উর্ধ্বমুখিতে বগলবাজানো রাষ্ট্র ও রাজনীতির,উন্নয়ন আর প্রবৃদ্ধির দেশের দরিদ্রজন। প্রান্তজনদের একজন। হালিমা একজন প্রান্তিক নারী। প্রায় সকল অর্থেই প্রান্তিক।এটি ব্যক্তি হালিমার ছবি। তবে শুধুই কি ব্যক্তি হালিমার? নাকি এটি সমষ্টিরও। যদি সমষ্টির নাও হয় তবে কি সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের? যদি বাংলাদেশের হয় তাহলে এটি কোন বাংলাদেশ? হালিমার হতবিহবল স্বপ্নহীন ছবিটি যে হাজার কথা বলছে, সেকথাগুলো যে বাংলাদেশের ছবি তুলে ধরছে, সেটি কোন বাংলাদেশ?আমরা কি সে বাংলাদেশ চেয়েছিলাম? যে প্রশ্নটি রেখে গিয়েছিলেন হুমায়ুন আজাদ। অনেক বছর আগে। তাঁর-আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম- বইতে।

হালিমার গল্পটি সংবাদপত্র, টিভিসংবাদ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয় হয়ে ছড়িয়ে পড়তে পড়তে ইতোমধ্যে সেই একই দিগন্তরেখায় মিলিয়ে যাবার সময়ও প্রায় এসে গেছে, যে সীমাহীন দিগন্তের অন্ধকারে হালিমা তাকিয়েছিলেন, তাঁর ছবিটি তারই অজান্তে ক্যামেরাবন্দি করার সময়। কেননা, ইতোমধ্যে আঁতকে ওঠার মতো, হতবিহবল হয়ে পড়ার মতো, দু:স্বপ্নে চমকে ওঠার মতো আরও কয়েকটি ঘটনা ঘটে গেছে প্রবৃদ্ধির দেশ- বাংলাদেশে। ইতোমধ্যে রাষ্ট্র হয়ে গেছে বনানীর ধর্ষণ ঘটনা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই নারী শিক্ষার্থীকে জন্মদিনের উৎসব পালনের কথা বলে, বন্ধুত্বের বিশ্বস্ততায় ডেকে নিয়ে অস্ত্রের মুখে সারারাত হোটেল কক্ষে আটকে রেখে ধর্ষণ করেছে উচ্চবিত্ত পরিবারের যৌন সন্ত্রাসীরা। এ আলাপ চলতে চলতে আমাদের কানে খবর এসে গেছে- সিলেটে মা ও মেয়েকে ধর্ষণ করে, সে দৃশ্য ভিডিও করে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দেয়ার খবর, ছড়িয়ে দেয়ার খবর।

ধর্ষণ আর যৌনসন্ত্রাসের সংবাদে আমাদের কান, আমাদের মন প্রতিদিন ভারী হয়ে উঠছে। হুমায়ুন আজাদের-আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম- বইটির কথা শুরুতে বলেছিলাম। সে বইয়ের একটি উদ্ধৃতি মনে পড়ে গেলো। তিনি লিখেছেন- ধর্ষণ এখন বাংলাদেশের প্রধান সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে পরিণত হয়েছে, বাংলাদেশ এখন ধর্ষণের প্রেক্ষাগার, ৫৬,০০০ বর্গমাইলব্যাপী বলাৎকারের রঙ্গমঞ্চ; পথে পথে ঘরে বাইরে ধর্ষিত হচ্ছে নারীরা, ২০০১-এর নির্বাচনের পর হিন্দু তরুণীদের ওপর বয়ে গেছে ধর্ষণের ঝড়, কিন্তু যে সবচেয়ে ধর্ষিত পীড়িত লাঞ্ছিত বলাৎকৃত সম্ভ্রম লুণ্ঠিত, তার নাম বাংলাদেশ, আমার জন্মভূমি- বেদনাপীড়িত সোনার বাঙলা (রাজনৈতিক প্রবন্ধ সমগ্র, পৃষ্ঠা-৫৬৯)। এখনতো ২০০১ সাল নয়; ২০১৭ সাল। প্রায় ষোল বছর অতিক্রান্ত। এ সময়ে অনেক কিছু পাল্টেছে। ক্ষমতার বদল হয়েছে। ক্ষমতাবানদের কাছে আমাদের প্রত্যাশাও অনেক। তাঁরাও অনেক স্বপ্নের কথা, সম্ভাবনার কথা শোনাচ্ছেন আমাদের। কিন্তু আমাদের দিন কি সত্যি সত্যি বদলেছে, যেমনটি বদল হবার কথা, অন্তত যৌনসন্ত্রাস, নারীর প্রতি নিপীড়ন বন্ধের প্রশ্নে? আমরা কি বলতে পারবো নারীর বিরুদ্ধে যৌনসন্ত্রাস, নিপীড়ন-নির্যাতন প্রশ্নে পরিস্থিতি পাল্টেছে?ইতিবাচকভাবে?বাংলাদেশের নারীদের নিরাপত্তাবোধ, মুক্তমানুষ হয়ে চলাফেরার স্বাধীনতা কি বিস্তৃত হয়েছে নাকি আরও সংকুচিত হয়েছে?

খুব বেশি পরিসংখ্যান দিতে চাই না। কেননা প্রিয় বাংলাদেশে যৌনসন্ত্রাসের উলম্বমুখিতার জন্য সম্ভবত আর পরিসংখ্যানের দরকার নেই। ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার বলছে, ২০১৭ সালের প্রথম তিন মাসে ১৪৫জন শিশুকে ধর্ষণ করেছে যৌন সন্ত্রাসীরা। এ ১৪৫জন শিশুর মধ্যে আবার ৫০জনকে খুন করা হয়েছে (ডেইলি স্টার, ৮ মে ২০১৭)। শিশু অধিকার ফোরামের বরাত দিয়ে বিবিসি বাংলা’র একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালের প্রথম সাত মাসে ২৮০জন শিশুকে ধর্ষণ করেছে যৌনসন্ত্রসীরা। ২০১২ সালে এ সংখ্যা ছিল ৮৬, ২০১৩ সালে- ১৭০ এবং ২০১৫ সালে ১৯৯টি।

সুতরাং এটি স্পষ্ট যে, আমাদের শুধু জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়ছে না। ধর্ষণের ঘটনারও প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি উন্নয়ন হচ্ছে যৌনসন্ত্রাসের। এ উন্নয়ন শুধু সংখ্যাভিত্তিক নয়; ধরন এবং মাত্রাগতও। আর সামগ্রিক যৌনসন্ত্রাসকে বিবেচনায় নিলে এ প্রবৃদ্ধি সম্ভবত সংখ্যাতাত্ত্বিক ব্যাকরণে ফেলাও কষ্টকর হবে।

তবে ঘটনাবহুল বাংলাদেশে ভুলে যাওয়াই রীতি। একটি ঘটনা অপর ঘটনাকে ছাপিয়ে যায়। আমরা কিছু দিন হৈচৈ করি, তারপর ভুলে যাই। এ ভুলে যাওয়ার সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত জীবনে তবু আবার একটু মনে করবার চেষ্টা করি। হালিমা-হযরত আলী ছিলেন নি:সন্তান দম্পতি। দাম্পত্য জীবনের সে অভাব পূরণে অভাবের সংসারে সন্তান হিসেবে দত্তক নিয়েছিলেন আয়েশা আক্তারকে। তখন আয়েশার বয়স ছিল মাত্র একদিন। ইতোমধ্যে আটবছর কেটে গেছে। ছোট্ট আয়েশাও বড় হচ্ছে। বিদ্যালয়ে যেতে শুরু করেছে। স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী আয়েশা, ছোট্ট কোমলমতি আয়েশা, যার এখনও নিজকে চেনার বয়স হয়নি, শরীর, যৌনতা, যৌনহয়রানি- এসব যার চিন্তাকাঠামোয়, বিকাশমান শব্দভাণ্ডারে প্রবেশাধিকারই পাবার কথা নয়; সে শিশু আয়েশার উপর চোখ পড়েছিল এক স্থানীয় যৌনসন্ত্রাসীর। শিশু আয়েশার বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়ার পথে যৌনতার হিংস্র নখ নিয়ে সক্রিয় ছিল সে। যে বয়সে শিশু আয়েশার ঘরে-বাইরে, বিদ্যালয়মাঠে, বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসার পথে রঙিন প্রজাপতি হয়ে ওড়বার কথা, খেলবার কথা, সে বয়সে প্রজাপতির মতো ডানামেলাতো দূরে থাক, এক অচেনা ভয়ে সংকুচিত হতে বাধ্য হয়েছিল সে। হালিমা-হযরত দম্পতি চেষ্টা করেছিলেন, আয়েশাকে রক্ষা করতে। সে জন্য তাঁরা সম্ভাব্য সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানেই গিয়েছিলেন। অভিযুক্ত যৌনসন্ত্রাসীর পরিবার, সমাজপতি, জনপ্রতিনিধি, ইউপি, থানা-পুলিশ মানে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র- সবার সাহায্য চেয়েছেন, প্রতিকার চেয়েছেন, সবার কাছে আকুতি জানিয়েছেন। কিন্তু কেউ পাত্তা দেয়নি। গুরুত্ব দেয়নি। হালিমা-হযরতদের কোন গুরুত্বপূর্ণ আবেদনকে গুরুত্ব দেয়াটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন নি। না সেই যৌনসন্ত্রাসীর পরিবার, না সমাজপতি, না জনপ্রতিনিধি, না রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। নিজ সন্তানের নিরাপত্তা দিতে না পারাটাকে হযরত হয়তো শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিগত ব্যর্থতা হিসেবেই চিহ্নিত করেছিলেন। আমাদের রাজনীতি-প্রশাসন-সমাজ পরিচালনা প্রক্রিয়ায় ব্যর্থ মানুষদের নিজ দায়িত্বে সরে যাবার নজির খুব একটা নেই। কিন্তু হযরত কি ভেবে ছিলেন- ব্যর্থ মানুষদের থাকতে নেই, সরে যাওয়া উচিত? এ প্রশ্নের উত্তর আমরা আর কোনদিনই জানবো না। কারণ ইতোমধ্যে সেসব উত্তর দেয়া-না-দেয়ার দায়দায়িত্ব থেকে হযরত নিজকে মুক্ত করে নিয়েছেন। চলে গেছেন না- ফেরার দেশে। কিন্তু আমরা আঁচ করতে পারি- একজন বাবা, একজন অভিভাবক কতখানি বিপন্নবোধ করলে, কতখানি অসহায় হয়ে পড়লে, হতাশার কোন গভীরতায় নিমজ্জিত হতে বাধ্য হলে, রাষ্ট্র ও সমাজের কাছ থেকে কতখানি উপেক্ষিত হলে- চলন্ত ট্রেনের নিচে নিজের সন্তানসহ আত্মাহুতি দিতে পারেন। এ বিপন্নবোধ, অসহায়ত্ব, হতাশা কি শুধু হালিমা-হযরত দম্পতির? নাকি আমাদের সবার? দৃশ্যমান-অদৃশ্যমান অসহায়ত্ব আর বিপন্নবোধে বাংলাদেশের প্রতিটি পরিবারই কি কমবেশি আক্রান্ত নয়? নিজের কন্যাসন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত নন, সম্ভাব্য যৌনসন্ত্রাস নিয়ে আতংকিত নন-এমন অভিভাবক, এমন নারীর পরিসংখ্যানটা জানার জন্য আমাদের কি কোন বিশেষ গবেষণার দরকার পড়বে?

বেটাগিরির মতাদর্শ এবং আমাদের ভুলে যাওয়া-না-যাওয়া কিছু গল্প
আমরা সম্ভবত সিলেটের কলেজ ছাত্রী খাদিজার কথা ভুলিনি অথবা ভুলে গেছি। যে কোনভাবে প্রাণে বেঁচে গেছে। দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরে গেছে। খাদিজা নি:সন্দেহে ক্রমাগত নারী নিপীড়নে শঙ্কিত বাংলাদেশের এক ভয়াবহ প্রতিরূপ। তবে কোনভাবেই যে শেষ প্রতিরূপ নয় তার প্রমাণ পরবর্তী ঘটনাগুলি। বনানীর যৌনসন্ত্রাসের ঘটনা তার সাম্প্রতিক সংযোজন। কিন্তু বলা যাবে না, বলতে পারছি না- এটাই শেষ। খুব ভালো হতো, যদি আমরা ভাবতে পারতাম, আশ্বস্ত হতে পারতাম, বলতে পারতাম-এখানেই যবনিকা। কিন্তু একটু চোখ ফেরালেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে মাদারীপুর কালকিনি উপজেলার নবগ্রামের কিশোরী নিতুর ছবি। আমাদের মনে পড়ে কুমিল্লার কলেজ ছাত্রী তনুর মুখ। মনে পড়ে ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী মিরপুরের আফসানার কথা। খুব কষ্ট হলেও আমাদের এ বলে অনুসিদ্ধান্ত টানতে হয় যে, খাদিজা, তনু, মিতু কিংবা আফসানা, আয়েশা কেউ প্রথম নন; সম্ভবত শেষও নন।ইয়াসমিন, সীমা, মাহিমা, ফাহিমা-এদের কথাও আমাদের একটু আধটু মনে পড়ে।আমরা যে নামগুলি বলতে পারছি তার কারণ তাঁরা বেচে নেই। তাদের উপর যৌনসন্ত্রাস চলেছে, তারপর খুন করা হয়েছে অথবা কেউকেউ আত্মহত্যা করেছেন, যৌনসন্ত্রাসের শিকার হওয়ার পর, যেটা এক প্রকার খুনেরই নামান্তর। যৌনসন্ত্রাসের শিকার হয়ে অসংখ্য বেঁচে আছেন। সেসব ঘটনার কোনটা প্রকাশিত হচ্ছে, কোনটা একেবারেই নয়। কোনটা থানা-আদালত পর্যন্ত গড়াচ্ছে, কোনটা নিরবে-নিভৃতেই থেকে যাচ্ছে। কিন্তু যৌনসন্ত্রাসের ভয় ও শঙ্কায় আমরা, আমাদের সন্তানেরা, আমরা নাগরিককুল ক্রমাগত ঘুটিয়ে পড়ছি, নিজেরা নিজের ভেতর।এ যেন এক অদৃশ্য আরোপিত বন্দি জীবন।

আমরা নিশ্চয় ভুলে যাই নি, যাবার কথাও নয়- ২০১৫ সালের পহেলা বৈশাখের দলগত যৌনসন্ত্রাসের কথা। উৎসবে আসা নারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল একদল যৌনসন্ত্রাসী। সারা দেশে প্রতিবাদ উঠেছিল। কিন্তু কোনো প্রতিকার হলো না। কারণ রাষ্ট্র, প্রশাসন সংশ্লিষ্টরা প্রথমে অস্বীকার করেছেন। তারপর বলেছেন, ওটা ছিল কিছু দুষ্টু ছেলের কাজ। সবচেয়ে বড় কথা হলো, ঘটনাটি ঘটেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঐতিহ্য অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুসে ওঠার কথা। ওঠেনি। প্রতিবাদ করার কথা। করেনি। কারণ ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি। যে ক্ষমতার রাজনীতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ক্রমশ করে তুলছে মেরুদণ্ডহীন, অধপতিত বিদ্যাপীঠে, অন্তত রাজনৈতিক-সামাজিক অঙ্গীকার ও দায়িত্বপালনের দিক থেকে। দায় অস্বীকৃতির প্রাতিষ্ঠানিক প্রবণতার সুযোগে পহেলা বৈশাখের যৌন সন্ত্রাসীরা শেষ পর্যন্ত অধরাই থেকে গেলো। তাদের আইনের মুখোমুখি হতে হলো না। কিন্তু পরের বছর নিরাপত্তার নামে প্রশাসনিক বিধিনিষেধ আরোপিত হলো উৎসব উদযাপনের ওপর। অনেকটা সূর্যাস্ত আইনে আটকা পড়লো আমাদের বৈশাখ উদযাপন। যেটি এখনও চালু আছে। হয়তো থাকবে, যদি না আমরা ঠেকাতে পারি। যদি না প্রতিরোধ করতে পারি।

আমাদের সম্ভবত মনে নেই, এতদিন মনে থাকবার কথা নয়-মাদারীপুরের নিতু ৫ম শ্রেণিতে জিপিএ ফাইভ পেয়েছিল। বহুমুখি প্রতিভার অধিকারী মেয়েটি ডাক্তার হতে চেয়েছিল। পরিবারের অভাব দূর করার স্বপ্ন দেখেছিল। দরিদ্র কাঠমিস্ত্রি বাবার মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছিল। কিন্তু সে স্বপ্ন ছোঁয়ার আগেই চৌদ্দ বছরের কিশোরী মেয়েটিকে প্রকাশ্যে হত্যা করলো তারই এক সময়কার গৃহশিক্ষক মিলন। কুমিল্লার কলেজ ছাত্রী তনু পড়ালেখার পাশাপাশি নাট্য আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। নাট্যকর্মী হিসেবে নিশ্চয় সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু সমাজ বদলের আগে তাঁর বেঁচে থাকার সম্ভাবনাই বদলে গেল। মৃত তনুর লাশ পড়ে থাকলো ক্যান্টনমেন্টের সীমানায়, যে জায়গাটি সবচেয়ে নিরাপদ থাকবার কথা। আফসানা ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। সমাজের মৌল কাঠামোটাকে বদলে দেয়ার, সমাজ রূপান্তরের স্বপ্নটা নিশ্চয় আফসানারও ছিল। কিন্তু প্রেমে প্রত্যাখ্যাত সহপাঠীর হাতে খুন হলেন আফসানা। তরুণ বয়সে কাউকে ভালো লাগবে, ভালোবাসার ইচ্ছা জাগবে, প্রেমে পড়বে, কবিতা লিখবে- এসবই স্বাভাবিক। ভালো লাগলে, প্রেমে পড়লে সে কথাও ভালো লাগার মানুষটিকে জানাবে- এতেও কোনো দোষের কিছু নেই। কিন্তু যাকে ভালো লেগেছে তারও যে ভালো লাগতে হবে, আবশ্যিকভাবে- এমন তো কোনো কথা নেই। প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে দখলে নেয়ার চেষ্টা তো একপ্রকার যৌনসন্ত্রাসই। আর এ যৌনসন্ত্রাসের মনোজগৎ ও সহায়ক পরিবেশ তৈরি করে যে মতাদর্শ- তার নাম পুরুষতন্ত্র।

পুরুষতন্ত্রের নানা রূপ, রং ও গন্ধ আছে। এ রূপ, রঙ ও গন্ধ তৈরি হয় স্থান, কাল ও সংস্কৃতির আলোকে। তাতে পুরুষতন্ত্রের প্রকাশিত আচরণে কিছুটা পার্থক্য হয়তো দেখা দেয় বা দেখা দিতে পারে। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে পুরুষতন্ত্র বলপ্রয়োগে বিশ্বাস করে। পুরুষতন্ত্র একটি সন্ত্রাসী মতাদর্শ। এটি দখলের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে। দখলদারিত্ব চায়। এতে অনিশ্চয়তা দেখা দিলে পুরুষতন্ত্র তখন আগ্রাসী হয়ে উঠে। সন্ত্রাস চালায়। অন্যের উপর আক্রমণ করে। ধর্ষণ করে। হত্যা করে।

এমনটা নয় যে, নিতুকে যে মিলন হত্যা করেছে, কুপিয়ে, দিনের আলোয়, প্রকাশ্যে, সে মিলন এর আগে কখনও প্রত্যাখ্যাত হয়নি। তার জীবনের সব ইচ্ছা-ই এর আগে পূরণ হয়েছে। ইচ্ছা পূরণ না হওয়ার এটিই একমাত্র ঘটনা। বরং প্রকৃত সত্য তার উল্টো। খবর নিলে দেখা যাবে, মিলনের জীবনে অনেক চাওয়া-পাওয়ারই হয়তো পূরণ হয়নি। তাহলে সেসব ক্ষেত্রে মিলন সংশ্লিষ্টদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েনি কেন? শ্রেণির বিচারে, ক্ষমতার বিচারে সে নিশ্চয় অতখানি সক্ষম নয়; যতখানি সক্ষম হলে সে তার সব ইচ্ছাই জোর করে আদায় করতে পারবে। কিন্তু শ্রেণি ও ক্ষমতার বিচারে যত তলানিতে থাকুক না কেন, নারীর উপর বলপ্রয়োগে আপেক্ষিক সুবিধাভোগ করে থাকে পুরুষ। তার সাথে শ্রেণি ও ক্ষমতার সূত্র যদি যোগ হয় তাহলে তো কথাই নেই। মিলনদের এ ধরনের বলপ্রয়োগের সূত্র খুঁজতে হবে সমাজে বজায় থাকা পুরুষালি সামাজিকায়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে। এবং অবশ্যই নারীনির্যাতনকেন্দ্রিক বিচারহীনতার সংস্কৃতির মধ্যে। সমাজে চলমান পুরুষতান্ত্রিক সামাজিকায়নে বেটাগিরি ফলানোর মতাদর্শ তৈরি করা হয়। এ বেটাগিরি-মতাদর্শের নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণ অব্যাহত থাকে নানা প্রক্রিয়ায়, নানা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। বেটাগিরির মতাদর্শ সবখানে হারলেও নারীর কাছে হারতে চায় না। নারীর উপর জিততে চায়। এ জেতাকে সে তার অনিবার্য অধিকার মনে করে।

ইচ্ছার বিরুদ্ধে অন্যকে জিতে নেয়ার, দখলে নেয়ার পুরুষালি মনস্তত্ত্ব ভেতরে ভেতরে সামাজিকায়ন প্রক্রিয়ায় তৈরি থাকলেও তার প্রকাশের জন্য দরকার পড়ে সহায়ক আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থা। শুনতে খারাপ শোনালেও নারীর বিরুদ্ধে সংঘটিত নিপীড়নের ঘটনাসমূহের দৃষ্টান্তমূলক বিচার না হওয়ার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে সে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থাটি তৈরি হয়ে আছে। অভিযুক্ত নিপীড়ক যদি হয় কোন ক্ষমতাবান প্রতিষ্ঠানের সদস্য, রাজনৈতিক দলের কর্মী, অথবা ক্ষমতাবানদের আত্মীয় তখন বিচারিক প্রক্রিয়াটি আর নিরপেক্ষভাবে এগোয় না। কোথাও না কোথাও থমকে যায়। পক্ষপাতপূর্ণ হয়ে ওঠে। এ প্রক্রিয়া পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতাকাঠামোয় অন্য নিপীড়কদেরও উৎসাহিত করে। প্রণোদনা যোগায়। নারীর বিরুদ্ধে যেকোনো নিপীড়ন চালিয়ে যে পার পাওয়া যায় তার ধারাবাহিক উদাহরণ তৈরি করে। যা প্রকৃতপক্ষে যৌনসন্ত্রাসকে আরও উৎসাহিত করে। যৌনসন্ত্রাস সহ নারী নিপীড়নের উর্বর ক্ষেত্র ও পরিসর তৈরি করে। বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে এ রকম বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আছে। যৌনসন্ত্রাস সহায়ক সাংস্কৃতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের সৃজন ও পুনসৃজন, যৌনসন্ত্রাসীদের সাথে রাজনৈতিক ক্ষমতাবান ও অভিজনশ্রেণির ঘোষিত-অঘোষিত সম্পর্ক এবং শাসনব্যবস্থার যথাযথ সংবেদনশীলতা ও জবাবদিহিতার সংকট আমাদের এক অনিশ্চয়তার দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

অমর্ত্যরে কালের কাদের-আমাদের কালের হালিমা-হযরত
নোবেল বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তাঁর ডেভলম্যান্ট এজ ফ্রিডম বইয়ের সূচনা অধ্যায়ে তাঁর শৈশবের একটি গল্প বলেছেন। একজন কাদেরের গল্প। অমর্ত্য তখন শিশু। বয়স দশ হবে। থাকেন ঢাকায়। তখন হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা চলছিল। পরিস্থিতি খুবই খারাপ। সে ভয়াবহ ভীতিকর পরিস্থিতিতে কাদের ঘর থেকে বের হয়েছিলেন। বের হতে বাধ্য হয়েছিলেন। জীবীকার তাগিদে। গিয়েছিলেন দাঙ্গাপ্রবণ এলাকায়। পথে ছুরিকাহত হয়ে ঢুকে পড়েছিলেন অমর্ত্য সেনদের বাড়ির উঠোনে। অমর্ত্য সেনের বাবা আহত কাদেরকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু বাঁচাতে পারেন নি। শৈশবের এ অভিজ্ঞতাটি অমর্ত্য ভুলতে পারেন নি। পরবর্তী জীবনে উন্নয়ন দর্শন ও তত্ত্ব নির্মাণে অমর্ত্য ঘটনাটিকে সংযুক্ত করেছেন। এ বলে অনুসিদ্ধান্ত টেনেছেন যে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতাহীনতা ব্যক্তির সামাজিক স্বাধীনতাহীনতা তৈরি করে। আবার সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতাহীনতা অর্থনৈতিক স্বাধীনতাহীনতা তৈরি করে। অমর্ত্য ছুরিকাঘাতে কাদেরের মৃত্যুর ঘটনাটিকে বলেছেন, অর্থনৈতিক স্বাধীনতাহীনতার খেসারত। কারণ সেদিন কাদেরের বাড়িতে পরিবারের সদস্যদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা ছিল না। থাকলে তাঁকে বাইরে আসতে হতো না। আর বাইরে না আসলে ঐভাবে জীবন দিতে হতো না (ডেভলম্যান্ট এজ ফ্রিডম, অক্সফোর্ড, ২০০৬, পৃষ্ঠা-৯)।হালিমা-হযরত দম্পতির ঘটনাটিকে, মেয়েসহ বাবার আত্মাহুতির ঘটনাকে অমর্ত্যরে চোখ দিয়ে ব্যাখ্যা করলে কী দাঁড়ায়? হ্যাঁ, হালিমা-হযরত দম্পতি দরিদ্র ছিল। অমর্ত্যরে ভাষায়- অর্থনৈতিক স্বাধীনতাহীনতা ছিল তাঁদের। এ দরিদ্র দম্পতি নিজের প্রিয় সন্তানের নিরাপত্তা চেয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন, কেউ কর্ণপাত করেনি। প্রতিবেশিরা বলেছেন, যদি সংশ্লিষ্টরা যথাসময়ে এগিয়ে আসতো, যাদের এগিয়ে আসা সামাজিক, প্রশাসনিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব ছিল, তারা যদি দরিদ্র পরিবারের আকুতি-আবেদনে কর্ণপাত করতেন, তাহলে বাবা-মেয়ের এ করুণ পরিণতি হতো না (প্রথম আলো, ১ মে, ২০১৭, পৃষ্ঠা-৪)।

পরিবারটির অর্থনৈতিক স্বাধীনতাহীনতা সীমাবদ্ধ করেছে তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা। সীমাবদ্ধ করেছে বিচারিক পরিষেবাগুলিতে অর্থপূর্ণ প্রবেশাধিকার। ফলে প্রতিকার চাইতে গিয়েছেন, কিন্তু কোন প্রতিকার পান নি। কেউ সহানুভূতিশীল হওয়াতো দূরে থাক, ন্যুনতম দায়িত্ব নিয়েও এগিয়ে আসেনি।অমর্ত্যরে চোখে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কাদেরের মৃত্যু যদি হয়ে থাকে অর্থনৈতিক স্বাধীনতাহীনতার খেসারত তবে গাজীপুরের বাবা-মেয়ের জোড়া আত্মাহুতি অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতাহীনতার সমন্বিত খেসারত। রাষ্ট্রের সুশাসন ও জবাবদিহিহীনতাজনিত নৈরাজ্যের খেসারত। ধারণা করি,বনানীর মেয়ে দু’টি কমপক্ষে মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। হালিমা-হযরত দম্পতির মতো দরিদ্র নয়। তাদের শিক্ষা আছে, সামাজিক গতিশীলতাও আছে। কিন্তু ধর্ষকরা এ শহরের বড় কারবারির সন্তান। যাদের বিপুল অর্থ-প্রতিপত্তি আছে। ক্ষমতার রাজনীতির সাথে সম্পর্ক আছে। থাকাটাই স্বাভাবিক। বিপরীতে ধর্ষণের শিকার দুই শিক্ষার্থী বিত্তের বিচারে কিছুটা এগিয়ে থাকলেও পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা-কাঠামোয় তাদের অবস্থান প্রান্তিক। তার সাথে যুক্ত হয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহীহীনতা। সামাজিক কাঠামোগত কারণে ধর্ষণের মামলা থানা পর্যন্ত গড়াতেই সময় লেগেছে প্রায় একমাস। অভিযোগ আছে-থানাও প্রথমে মামলা নেয়নি। তারপর মামলা নিল, কিন্তু অভিযুক্তরা দোর্দণ্ড প্রতাপে ঘুরে বেড়িয়েছে। আসামীদের ধরবার জন্য রাস্তায় নামতে হয়েছে সর্বসাধারণের।সময় বেঁধে দিতে হয়েছে আন্দোলনকারীদের। প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতা থাকলে তো এটি হওয়ার কথা না। প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতা, দায়িত্বশীলতা ও আইনের শাসন- সুশাসনের জন্য ন্যুনতম শর্ত। আর সুশাসন ছাড়া স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন কী করে সম্ভব?তাহলে কেমন উন্নয়নের পথে এগুচ্ছে বাংলাদেশ?আমাদের প্রিয় স্বদেশ!

অমর্ত্যরে চোখে উন্নয়ন যখন এক অনিশ্চিত গরিমা
আজকালের নিত্য আলাপ-বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে উঠে গেছে। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যবিত্ত আয়ের দেশে উন্নীত হবে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে। মাথাপিছু আয় বাড়ছে। বিশ্বের উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে বাংলাদেশের নাম বারবার উঠে আসছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক-এডিবির পরিচালনা পর্ষদের সভায় বাংলাদেশকে এশিয়ার ছয়টি উদীয়মান অর্থনীতির একটি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এসব ইতিবাচক গল্পে নাগরিক হিসেবে তো আমাদের খুশী হওয়ারই কথা। কারণ উন্নয়নের জন্য প্রবৃদ্ধি লাগবেই। কিন্তু প্রবৃদ্ধি হলেই কি উন্নয়ন হবে, সেই উন্নয়ন কি টেকসই হবে- এ প্রশ্নগুলি কি আমরা যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিচ্ছি?

আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের উন্নয়ন নিয়ে লেখা অমর্ত্য সেন ও জিন ড্রিজ এর একটি বই বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বইটির নাম-এ্যান আন সার্টেইন গ্লোরি- ইন্ডিয়া এন্ড ইটস কনট্রাডিকশন। লেখকদ্বয়ের মতে বিশ্বের বড় অর্থনৈতিক দেশগুলির মধ্যে প্রবৃদ্ধির প্রশ্নে ভারত হচ্ছে দ্বিতীয় দ্রুততম অর্থনীতি (পৃষ্ঠা-১৯)। যার অর্থ ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি খুব দ্রুত গতিতে বাড়ছে।কিন্তু তাঁরা ভারতের এ অর্থনৈতিক উন্নয়নকে, প্রবৃদ্ধির দ্রুততম গতিকে বলেছেন, একটি অনিশ্চিত গরিমা। এ রকম বলার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। বলেছেন, ভারত প্রবৃদ্ধির প্রশ্নে এগিয়ে থাকলেও দেশটি সামাজিক সূচকে ব্যাপক পিছিয়ে আছে। সেটি আলাপ করতে গিয়ে তুলনা করেছেন বাংলাদেশের সাথে। প্রশংসা করেছেন বাংলাদেশের।সামাজিক সূচকের অনেক জায়গায় এগিয়ে রেখেছেন বাংলাদেশকে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জেন্ডার সূচক- মোট শ্রমশক্তিকে নারীদের হার, শিক্ষা ও রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ, নারীর গতিশীলতা (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৫৯)। বইটির ভূমিকার প্রথম পাতায় স্থান পেয়েছে নারীর বিরুদ্ধে যৌনহয়রানির কথা। তাঁরা মনে করেন, নারীর বিরুদ্ধে নিপীড়ন-বিরোধী সংগ্রামটিকে হতে হবে রাজনৈতিক। ২০১২ সালে দিল্লীতে সংঘটিত চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় জেগে ওঠা আন্দোলন এর প্রশংসা করে তাঁরা বলেন, নারীনির্যাতনের বিরুদ্ধে বৃহত্তর পরিসরে এ রকম রাজনৈতিক আন্দোলন ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় আরও অনেক আগেই জেগে উঠার কথা। কিন্তু সেটা হয়নি। তাঁর মতে চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনাটিকে সম্ভবত ভারতীয় মধ্যবিত্ত সমাজ নিজেদের একজনের ঘটনা বলেই বিবেচনা করেছেন। নচেৎ সামাজিক অর্থনৈতিকভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অনেক মেয়েই এ রকম নিপীড়নের শিকার হচ্ছে বছরের পর বছর। কিন্তু এ সব ক্ষেত্রে সেরকম কোন আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠেনি ( প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-Vii) । অতএব এটা স্পষ্ট যে, নারী নিপীড়নের সম্ভাব্য ক্ষেত্রগুলিকে অমীমাংসিত রেখে, সামাজিক সূচকে পিছিয়ে থেকে শুধু প্রবৃদ্ধি নির্ভর উন্নয়নকে সুনিশ্চিত গরিমা বলতে তারা নারাজ। তাহলে উন্নয়ন কী? উন্নয়নের লক্ষ্য কী? অমর্ত্যরে কাছ থেকেই শোনা যাক।

অমর্ত্যরে মতে মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতার ক্ষেত্র ও পরিসর বাড়ানো হচ্ছে উন্নয়ন। এটি একদিকে উন্নয়নের মূল লক্ষ্য। আবার অন্যদিকে উন্নয়নের প্রধান মাধ্যমও (অমর্ত্য সেন, ডেভলম্যান্ট এজ ফ্রিডম, অক্সফোর্ড, ২০০৬, পৃষ্ঠা-xii)। তার মানে হচ্ছে মানুষের স্বাধীনতাকে অনিশ্চিত রেখে জিডিপি বাড়ানো হয়তো সম্ভব, কিন্তু উন্নয়ন সম্ভব নয়। মানুষের নানা ধরনের স্বাধীনতাহীনতা আছে, এ স্বাধীনতাহীনতার নানা উৎস আছে, উপাদান আছে। যা মানুষের পছন্দ-অপছন্দ করার ক্ষমতাকে সীমিত করে দেয়। অমর্ত্য বলেন, উন্নয়ন হচ্ছে মানুষের স্বাধীনতাহীনতার এসব রকমফের ও তার উৎসগুলিকে দূর করা (প্রাগুক্ত)। অমর্ত্য মানুষের স্বাধীনতা খর্বকারী উৎসগুলির কথাও বলেছেন। সে উৎসগুলি হচ্ছে- দারিদ্র্য, অত্যাচার-নিপীড়ন, দুর্বল অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা, সামাজিক কাঠামোগত বঞ্চনা, সরকারি পরিষেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের অনীহা ও দায়িত্বহীনতা, অতিরিক্ত রাষ্ট্রীয় অবদমন এবং রাষ্ট্রীয় অসহিষ্ণুতা।

তিনি বলেন, মানুষের স্বাধীনতাহীনতার বিষয়টি অনেক বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত। তারমধ্যে অন্যতম হচ্ছে স্থানীয় পর্যায়ে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্বে কার্যকর প্রতিষ্ঠানসমূহের থাকা না থাকা। (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৩-৪)। অমর্ত্য আরও বলেন, একজন মানুষে যে ধরনের জীবন পছন্দ করে, যে ধরনের জীবনযাপনকে মূল্যবান মনে করে, যৌক্তিকভাবে, সে ধরনের জীবন যাতে যাপন করতে পারে তার জন্য প্রয়োজনীয় সক্ষমতার বিকাশই হচ্ছে উন্নয়ন (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-১৮)। প্রবৃদ্ধি আর উন্নয়ন হলেই চলবে না, দু’টির সাথে সামাজিক ন্যায় বিচারের সম্পর্কটি প্রতিষ্ঠিত হতে হবে (সেন, অমর্ত্য, এ্যানআন সার্টেইন গ্লোরি- ইন্ডিয়া এন্ড ইটস কনট্রাডিকশন, পেঙ্গুইন, ২০১৩, পৃষ্ঠা- Vii) । অমর্ত্যরে মতে উন্নয়ন-বান্ধব প্রতিষ্ঠানগুলি বাধাগ্রস্ত হয় দু’টি কারণে। একটি সামাজিক বাধা। অন্যটি শাসন ব্যবস্থার আরোপিত ধরন বা আরোপিত সুশাসন( প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৩৪)। অমর্ত্যরে এ উন্নয়ন ভাবনার আলোকে বাংলাদেশের উন্নয়নের গতি-প্রকৃতিকে আমরা কীভাবে দেখবো? নারীদের জন্য, আমাদের শিশুদের জন্য ঘর ও বাহির অনিরাপদ রেখে, তাদের স্বাভাবিক গতিশীলতাকে অনিশ্চিত রেখে, আতংকিত রেখে মাথাপিছু আয় ও জিডিপি প্রবৃদ্ধির উলম্বরৈখিকতাকেই যদি আমরা উন্নয়ন বলে গ্রহণ করি, নারীর ওপর ক্রমবর্ধমান যৌনসন্ত্রাস বন্ধে ব্যর্থ হই, জিডিপির প্রবৃদ্ধিনির্ভর উন্নয়নের মিথ তৈরি করি, তাহলে একদা অমর্ত্য যে বাংলাদেশের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন, সে বাংলাদেশ উন্নয়নের অনিশ্চিত গরিমার পথেই এগুবে। আমরা কিছুটা হলেও সে অনিশ্চয়তার পথেই হাটতে শুরু করেছি।

হুমায়ুন আজাদকে উদ্ধৃত করে শেষ করতে চাই। তিনি বাংলাদেশের শিশুদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে শিউরে উঠেছিলেন। বলেছিলেন, শিশুরা বেড়ে উঠো না, বাড়লে তোমাদের অনুশোচনা করতে হবে। এখানে বেড়ে ওঠা পাপ, এখানে বেড়ে ওঠা দু:স্বপ্ন (জলপাই রঙের অন্ধকার, রাজনৈতিক প্রবন্ধ সমগ্র, পৃষ্ঠা-৪৬৭)। হালিমা-হযরত দম্পতির দত্তক নেয়া একমাত্র কন্যা আয়েশা তো শিশুই ছিল, ঠিক বেড়ে ওঠেনি। বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেড়ে ওঠার স্বপ্নটা দু:স্বপ্ন হয়ে উঠলো। যে দু:স্বপ্ন এখন স্থির হয়ে আছে হালিমার চোখের সামনে, গোটা বাংলাদেশের দু:স্বপ্ন হয়ে। যে বাংলাদেশ অসাধারণের নয়; নিতান্ত সাধারণের। আমাদের সবার। তবু বলতে চাই-আমরা অবশ্যই প্রবৃদ্ধি চাই। উন্নয়ন চাই। কিন্তু সেটি কোনভাবেই আমাদের স্বাধীনতার চৌহদ্দিকে সীমাবদ্ধ করে নয়। কম সুশাসন- বেশি উন্নয়নের ধারণা দিয়ে নয়। আমরা চাই, আমাদের মেয়েরা, নারীরা, শিশুরা, নাগরিকেরা- আমরা সবাই পূর্ণ স্বাধীনতা ও নিরাপত্তায় ঘুরে বেড়াবো। কারও হিংস্র নখ, চোখ আমাদের আতংকিত করবে না। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ পূর্ণজবাদিহিতার সাথে নাগরিকদের স্বাধীনতার চৌহদ্দিকে সুনিশ্চিত করবে। না হয় এ কথিত উন্নয়ন হেল্পম্যানের বই-দ্যা মাইজারি অব ইকোনোমিক গ্রোথ- অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দু:খদর্দশা হয়েই থাকবে। এখনও সময় আছে, উন্নয়নের মইয়ে চড়া বাংলাদেশ যেন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নির্ভর দুর্দশাগ্রস্ত দেশে পরিণত না হয়। আমাদের উন্নয়ন যাতে কোনভাবেই অমর্ত্যরে চোখে এক অনিশ্চিত গরিমা না হয়ে ওঠে। বনানীর যৌনসন্ত্রাস নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান শুরু করেছে, অভিযুক্তদের গ্রেফতার করেছে দেখে আমরা আশাবাদী হতে চাই।

বিশ্বাস করতে চাই- রাষ্ট্র নারীর বিরুদ্ধে সকল ধরনের সহিংসতা রুখে দাঁড়াবে। যথাসময়ে, যথাউপায়ে, কার্যকরভাবে। বিত্তের বিচারে নয়; ধর্ম, লিঙ্গ, শ্রেণি, গোষ্ঠী বা পেশার বিচারে নয়, সাংবিধানিক দায় হিসেবে রাষ্ট্র তার দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হবে। প্রিয় স্বদেশ-বাংলাদেশ,মুক্তিপাক অব্যাহত যৌনসন্ত্রাসের কবল থেকে।

মুনীর উদ্দীন শামীম, গবেষক ও উন্নয়ন কর্মী; সুশাসন বিষয়ক একটি কারিগরি প্রকল্পে কর্মরত।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ