আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

বিড়াল, ভয়, এইলোরো ফোভিয়া

ডা. সাঈদ এনাম  

মি. রহমান এসেছেন তার সদ্য বিবাহিতা পুত্রবধূকে নিয়ে। সমস্যাটা বেশ জটিল আকার ধারণ করেছে। বিয়ের দিন পর্যন্ত সবই ঠিকঠাক ছিলো। বাসর রাতের পরদিন সকাল থেকেই ঘটনার সূত্রপাত। সকালে সবাই বসেছেন নাস্তার টেবিলে, অমনি নববধূ "ও মাগো বিড়াল" বলে চিৎকার দিয়ে দিলেন এক লাফ। ডাইনিং টেবিল উলটে গিয়ে গরম তরকারি শাশুড়ির আর জ্যা'দের গায়ে পড়ে লঙ্কাকাণ্ড।  তারপর থেকে নববধূর সাথে শাশুড়ি আর জ্যা'য়েদের মুখ চাওয়াচাওয়ি কথাবার্তা সব বন্ধ। আজ সাত দিনে গড়ালো সব।

ননদ সামিয়া আর তার বর হাবিব অত্যন্ত অমায়িক, ভালো। বিষয়টি তারা বেশ হালকাভাবেই নিয়েছেন এবং সবাইকে বুঝিয়ে এক টেবিলে বসানোর যথেষ্ট চেষ্টা তদবির করেছেন। হাবিব পেশায় ইঞ্জিনিয়ার তিনিই মোটামুটি এ বাড়ির দ্বিতীয় অভিভাবক। বেজায় রসিক মানুষ। তিনি প্রথমেই এক হাত নিলেন তার স্নেহের শ্যালককে। শ্যালক তুমিই যত নষ্টার মুল। কথায় আছে, "বাসর রাতে বধিবে বিড়াল"। নিশ্চয়ই তুমি নববধূকে বাগে আনতে রাতে বিড়াল মারা জাতীয় কিছু করেছো। যেটা ছিলো নৃশংস। তাই ভয়ে বেচারির এই অবস্থা এখন। বিড়াল দেখলেই বা বিড়ালের ডাক শুনলেই বেচারি "ও মাগো বিড়াল" বলেই মূর্ছা যায়।

বাড়ির একমাত্র দুলাভাইয়ের এমন কথাতে রস থাকলেও অযৌক্তিক নয়। কিন্তু ননদ শাশুড়ি কেউই সেটা পাত্তা দিচ্ছেন না। তাদের কথা, "এ মেয়ে এ সংসারে থাকতে চায়না। তাই প্রথম দিনেই সবার হাত পা পুড়িয়ে এখন দোষ দিচ্ছে তাদের পোষা বিড়ালের উপর। তার নাকি বিড়ালভীতি আছে। এ বাড়িতে হয় বিড়াল থাকবে না হয় সে থাকবে। কী স্পর্ধা বড়লোকের মেয়ের। সে নাকি বিড়ালের সাথে থাকবেন না"।
 
বিড়াল ভীতি নিয়ে এ সাতদিনে দু পরিবারের সম্পর্কে ফাটল দেখা দিয়েছে।

দুই.
মি. রহমান সাহেবের কাছে চেম্বারে নববধূ নিয়ে আসার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস শুনে বিষয়টা আমার কাছে খুবই ইন্টারেস্টিং লাগলো। রহমান সাহেবকে বাইরে পাঠিয়ে আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, "বিষয়টা খুলে বলুন তো"।
 
বেচারি কাঁদোকাঁদো হয়ে বললো, "স্যার সত্যিই আমার বিড়ালে অসম্ভব ভয়। বিড়াল দেখলেই আমার গলা শুকিয়ে যায়, হাত পা কাঁপতে থাকে। অজ্ঞানের মতো অবস্থা হয়। সেটা ছোটবেলা থেকেই। সে জন্যে আমাদের বাসার চৌহদ্দিতে বিড়াল ছিলোনা। আমার বাবা যদিও বলতেন, 'মা বিড়াল অতি পোষা নিরীহ প্রাণি',  কিন্তু স্যার তাতেও আমার বিড়াল ভীতি লেগেই ছিলো। স্কুল কলেজে যেতে রাস্তায় বিড়াল দেখলে সেদিন আমি স্কুলে যেতাম না"।

"সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে ক্যানো"?, আমি হেসে জিজ্ঞেস করলাম।

সে বললো, গত তিন চার দিন থেকে সে ইন্টারনেট ইউটিউব দেখে দেখে কোথায় যেনো পেয়েছে, কিছু কিছু মানুষের এরকম বিড়াল ভীতি থাকতে পারে। এটা এক রকমের মানসিক রোগ। তাই তিনি শ্বশুরকে নিয়ে এসেছেন।

তার শ্বশুর মি. রহমান একজন উচ্চশিক্ষিত মানুষ। অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। শ্বশুরকে খুলে বলায় তিনি সানন্দে রাজি হলেন। তবে কিছুটা গোপন রাখতে বললেন। তাই সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে আসাটা কেবল তিনি আর তার শ্বশুরই জানেন। এর একমাত্র কারণ সাইকিয়াট্রিক কাউনসেলিং নিতে এখনো আমাদের দেশে কিছুটা সঙ্কোচ বা লজ্জাবোধ রয়ে গেছে। বিষয়টি শিক্ষিতজনের জন্যে হাস্যকর তথাপি দুজনকেই ধন্যবাদ দিলাম। তারা কিছুটা বুঝতে পেরেছেন, সমস্যা আসলে কোন জায়গায়।

অনেক সময় আমরা আমাদের  সমস্যা ঠিক কোন জায়গায় সেটাই বুঝতে পারিনা, তাই সমাধানে তালগোল পাকিয়ে ফেলি।

তিন.
পোকামাকড়, তেলাপোকা, জোঁক, সাপ, শামুক, মাকড়শা ইত্যাদিতে অনেকের ভয় থাকতে পারে। এ ভয় অনেক সময় মারাত্মক রূপ নেয়। ভয় বা ফোভিয়া যখন আপনার দৈনন্দিন জীবনকে বাধাগ্রস্ত করবে তখনই সেটাকে বলা হয় মানসিক রোগ। শুধুমাত্র বিড়ালভীতি থাকার কারণে এখানে নববধূর সাথে তার পরিবারের সম্পর্কের অবনতি ঘটে যাচ্ছে এমন বিচ্ছেদের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। হয়ত তারা উচ্চশিক্ষিত, তাই তারা বিষয়টি ধরতে পেরেছেন।

এসব ভয়ভীতিকে অনেকে অনেক সময় 'বাতাস লাগা', 'উপরি ধরা' ইত্যাদি মনে করে অপচিকিৎসার শিকার হয়ে সর্বস্ব হারান। এমনকি সাইকিয়াট্রিক ইভাল্যুয়েশন না হয়েই অনেক ক্ষেত্রে ডিভোর্স হয়ে যায়। ভুক্তভোগীরা না পারেন সইতে, না পারেন কইতে। অথচ কিছু কিছু মানসিক রোগ রয়েছে যা কেবল মাত্র সাইকোথেরাপি দিলেই সমাধান হয়। তেমন ঔষধপত্র লাগেনা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, 'সন্দেহবাতিক' রোগ যাকে 'ওথেলো সিনড্রোম' বলা হয়। এই "সন্দেহবাতিক" বা 'ওথেলো সিনড্রোম'  রোগের জন্যে  অনেক পরিবারে নেমে আসে অশান্তির আগুনে। এমনকি ডিভোর্সও হয়ে যায়।

বিড়ালভীতিকে বলা হয় এইলোরো ফোভিয়া। এটি এক ধরনের মানসিক রোগ। এ রোগে আক্রান্ত রোগী বিড়াল দেখলেই মারাত্মক প্যানিক হয়ে যান। দৌড়ে পালাতে গিয়ে লঙ্কাকাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেন। এমনকি বিড়ালের ডাক শুনলেই তার মাঝে প্যানিক ডিসঅর্ডারের কিছু লক্ষণ দেখা দেয়। একমাত্র সাইকিয়াট্রিক কাউনন্সেলিং, কগনেটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি এবং মামুলি কিছু রিলাক্সেন দিলে এ রোগ বা এরকম স্পেসিফিক কোন প্রাণি বা অবজেক্টে ফোভিয়াটা চলে যায়।

পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত লোকের মধ্যে এইলোরো ফোভিয়া ছিলো তাদের মধ্যে বিশ্বজয়ী আলেকজান্ডার, নেপোলিয়ন বোনাপার্ট, জার্মান চ্যান্সেলর এডলফ হিটলার, ইতালিয় সর্বাধিনায়ক মুসোলিনি।

ডা. সাঈদ এনাম, সাইকিয়াট্রিস্ট; ডিএমসি, কে-৫২, উপজেলা স্বাস্থ্য ও প প কর্মকর্তা, সিলেট; মেম্বার, আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন ও ইউরোপিয়ান সাইকিয়াট্রিস্ট এসোসিয়েশন; লাইফ মেম্বার, বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্ট।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ