আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

চলমান বন্যা ও সিলেট বিভাগের মৃতপ্রায় নদ-নদী

আব্দুল করিম কিম  

সিলেট বিভাগ হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ এবং সিলেট জেলা নিয়ে গঠিত। প্রতি বছরই এই বিভাগের নিম্নাঞ্চল কম-বেশি বন্যায় তলিয়ে যায়। চলতি ২০১৭ সালে সিলেট বিভাগের বন্যা এ অঞ্চলের মানুষের জন্য এক ভয়াবহ দুর্ভোগ নিয়ে এসেছে। সেই বন্যার কারণে হওয়া জন-দুর্ভোগ ও ফসলহানি সম্পর্কে সবাই অবগত আছেন। তাই সে আলোচনায় না গিয়ে সাম্প্রতিককালে সিলেটের আবহাওয়ার ব্যাপক পরিবর্তনের বিষয়েই কিছু কথা বলি।

চলতি বছর সিলেট বিভাগে অসময়ে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হয়েছে। গত কয়েক বছর ধরেই পারিপার্শ্বিক কারণে আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বছরের গড় তাপমাত্রা দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। শীতকালে শীত পড়ছে না, উল্টোদিকে গরমের সময় তাপমাত্রা অতিরিক্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৃষ্টির সময় বৃষ্টিপাত না হয়ে অসময়ে বেশী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। পাক-বর্ষা মৌসুমে মার্চ থেকে এপ্রিল মার্স পর্যন্ত অধিক বৃষ্টিপাত হচ্ছে। সিলেট আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালে সিলেট অঞ্চলে অক্টোবর মাসের তাপমাত্রা ছিল ৩১ ডিগ্রি কিন্তু চলতি অক্টোবর মাসে তা ৫ ডিগ্রি বেড়ে ৩৬ ডিগ্রি হয়েছে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে ৪৬ ভাগ বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা কিন্তু এবার সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে বৃষ্টিপাত হয়েছে মাত্র ২৬ ভাগ। বর্ষাকালে প্রতিবছর ৬৮ ভাগ বৃষ্টিপাত হয়ে থাকলেও গত বর্ষায় বৃষ্টিপাত হয়েছে মাত্র ৫০ ভাগ।

গত বছরের এপ্রিল মাসে আবার গত ৫৬ বছরের বৃষ্টিপাতের রেকর্ড অতিক্রম করে ৩৭৮ মিলিমিটারের স্থলে ৩ গুন বেড়ে ১০৩০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে বলা যায় গত বছরের চেয়েও অন্তত ১০গুন বেশি বৃষ্টি হয়েছে। এই অতিরিক্ত বৃষ্টির পানি সিলেট বিভাগের নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর-বাওর ধারণ করতে পারছে না। এই ধারণ না করার অন্যতম কারণ সিলেটের নদ-নদীর নাব্যতা সংকট ও হাওর-বাওরের তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়া। সিলেট বিভাগের নদ-নদী ও খাল-বিল ভরাট হওয়ার কারণে নিম্নাঞ্চলের মধ্যে পানি প্রবাহের যে প্রাকৃতিক নেট-ওয়ার্কিং ছিল তা ধিরে ধিরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অতীতে এক অঞ্চলে অতিরিক্ত বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢল নামলে ছোট ছোট নদী ও খাল দিয়ে দ্রুত প্রবাহিত হয়ে অন্য অঞ্চলে দ্রুত অপসারণ হয়ে যেত। কিন্তু নদ-নদী গুলো ভরাট ও দখল হয়ে খালে পরিণত হওয়ায়, খালগুলো দখল ও ভরাট হয়ে ড্রেনে পরিণত হওয়ায় পানি এখন দ্রুত অপসারণ হয় না। ফলে অঞ্চল ভেদে জলাবদ্ধতা হচ্ছে, গ্রামাঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। সিলেট বিভাগের নদ-নদী নিয়ে বছর জুড়ে সংবাদ মাধ্যমে নিয়মিত ভাবে যে সব প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, তার মূল বক্তব্য 'নদী মরে যাচ্ছে'।

এর পাশাপাশি সিলেটের নিম্নাঞ্চলের হাওর-বাওর বর্ষায় যে পানি ধারণ করতে পারতো বর্তমানে তা পারছে না। অধিকাংশ হাওরের তলদেশ ভরে গেছে। শুকনা মৌসুমে তা সহজে অনুধাবন করা যায়। এই বক্তব্যের স্বপক্ষে সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার হাকালুকি হাওর নিয়ে প্রকাশিত বেসরকারি সংগঠন পরিপ্রেক্ষিতের জরিপের কথা উল্লেখ করতে পারি। পরিপ্রেক্ষিত বলছে, হাকালুকি হাওড়ের ২৮১টি বিলের মধ্যে সম্পূর্ণ ও আংশিক ভরাট হয়ে গেছে ১৩৩টি বিল।

সিলেটের নদ-নদী কেন মরে যাচ্ছে আর হাওড়-বাওর কেন ভরাট হয়ে যাচ্ছে সে সম্পর্কে কিছু বলার পূর্বে জেনে নেই সিলেটে এখনো কি পরিমাণ নদ-নদীর চিহ্ন আছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), সিলেট শাখার পক্ষ থেকে ব্যক্তিগত আগ্রহে গত ১০ বছর ধরে সংবাদ-পত্রে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদের সূত্র ধরে বাংলাদেশের উত্তরপূর্বাঞ্চলের এই সিলেট বিভাগে প্রায় শত নদীর অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছি। নদ, নদী, শাখা নদী, উপ-নদী যে নামেই ডাকি না কেন- প্রতিটি নদীর প্রবহমান এলাকায় যে নাম রয়েছে সেই নামের উৎস ধরে খুঁজলেই সেই নদীর বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানা যাবে। সিলেটের প্রধান দুই নদী সুরমা ও কুশিয়ারা সহ এই বিভাগের বিভিন্ন জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলোর মধ্যে ১১৪টি নদীর পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

পিয়াইন, ধলাই, লোভা, রাংপানি, খোয়াই, করাঙ্গি, চলতি, লাঘাটা, সারী, ক্ষ্যাপা, কালনী, রত্না, সুতাং, মহাসিং, রক্তি, মনু, অন্ধমনু , লোলা, কুড়া, বিলাস, পিংলি, দেওছই, ধনু, বড়দাল, কংস, ডাউকা, চামটি, সুনাই, কন্টিনালা, মাকুন্দা, দৌলতা, খাজাঞ্চি, ফানাই, ধোনা, বলভদ্র, খাসিয়ামারা, গন্ডামারা, ইছামতি, ডেবনা, বিজনা, কচুয়াখাড়া, মুনিয়া, সাতাই, ধামালিয়া, জামালপুর, কালিয়া, পাটলী, বোয়ালিয়া, মাধবপুর, বিবিয়ানা, ধরিয়ানা, দিঘড়- পিয়াইন, বাসিয়া, কলকলিয়া, কচুয়া, গোয়াইন, শস্যনালী, জুঘনাল, দাড়াইন, কানাই, জুড়ী, নলজুর, পাইকরতলা, ধোয়াই, নুনছড়া, গুগালীছড়া, কাফনা, কাকেশ্বর, উন্দাখালি, ঠেংগাখালী, উদনা, ভাদেশ্বর, কামারখালি, কানাইখালী, পৈন্দা, মনিখাই, নয়াগাঙ, বড়গাঙ, ছড়াগাঙ, কাউনাই, সুমেশ্বরী, ঝিংড়ী, কুইগাং, মনাই, সোনাই, বড়ভাগা, যাদুকাটা, চুনাই, দেওড়ভাগা, পেকুয়া, শুটকী, বৌলাই, বোগাপানি, ভীমখালী, সুনই, ধলাই, গোমাইগাঙ, জালিয়াছড়া, বাগরাগাং, বটেরগাঙ, বেমুনা, গোপলা, লংলা, দেড়ু,আমিরদী্‌ন, ভেড়ামোহনা, ষাটমা, লঙ্গু, ধামাই, বাগহাতা, বারনা নামের এই নদীগুলোর প্রাণ প্রবাহের মধ্যেই সিলেটের ভবিষ্যৎ। আর এই ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়েছে মূলত নদীগুলোর তলদেশ ভরে যাওয়ার কারণে। সিলেটের অধিকাংশ বড় নদীর উৎস উত্তর-পূর্ব ভারতের খাসিয়া-জৈন্তিয়াহিল ও ত্রিপুরা রাজ্যে। সেখান থেকে প্রবাহিত পানি নিয়েই নদীগুলোর ছুটে চলা। তাই উত্তর-পূর্ব ভারতের পাহাড়ে বৃষ্টি হলে উজান থেকে পাহাড়ি ঢল হয়ে নেমে আসে সেই পানি। যে পানিতে থাকে উদাম পাহাড় ধুয়ে আসা লাখ লাখ টন বালি ও মাটি। আর এই বালি ও মাটি বছরের পর বছর ধরে সিলেট বিভাগের নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর-বাওরকে ভরাট করতে করতে এমন অবস্থায় নিয়ে এসেছে যে, এখন অতিরিক্ত পানি দ্রুত নামতে না পারে না। ফলে নতুন নতুন ফসলের জমি ও গ্রামাঞ্চল বন্যায় প্লাবিত হচ্ছে। যা অদূর ভবিষ্যতে পৌনঃপুনিক ভাবে বাড়তেই থাকবে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাহাড়ি ঢলের সাথে ও আন্তঃ সীমান্ত নদী দিয়ে বালি ও মাটি আসার পরিমাণ আশংকাজনক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। যা মূলত উত্তর-পূর্ব ভারতে অবাধ বৃক্ষ নিধন ও পাহাড়ে চলা অপরিকল্পিত কয়লা ও পাথর উত্তোলনের প্রভাব।

পাহাড় থেকে নেমে আসা বালি ও মাটিতে নদীর শুধু তলদেশ নয়, উৎসমুখ পর্যন্ত ভরাট হয়ে গেছে। এর অন্যতম প্রমাণ সুরমার উৎসমুখ ভরাট হয়ে যাওয়া। ভারতের মণিপুর রাজ্যের মাও সংসাং হতে উৎপন্ন বরাক নদী সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার অমলসীদ নামক স্থানে সুরমা ও কুশিয়ারা দুই শাখায় প্রবাহিত হয়েছে। অমলসীদে সুরমার উৎসমুখ দীর্ঘ এক দশক ধরে ক্রমান্বয়ে ভরাট হচ্ছে। সুরমার উৎসমুখ ও তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে বরাকের প্রায় ৮৫% পানি কুশিয়ারা দিয়ে প্রবাহিত হয়। এবারের শুষ্ক মৌসুমে সুরমার উৎসমুখ বরাক থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে বরাক নদীর সমস্ত পানি শুষ্ক মৌসুমে কুশিয়ারা নদী দিয়েই বয়ে যায়। তাই জকিগঞ্জের আমলসীদ থেকে কানাইঘাট উপজেলার লোভাছড়ার সংযোগস্থল পর্যন্ত সুরমা মুমূর্ষু নদী। প্রায় ৩২ কিলোমিটার এলাকায় মুমূর্ষু সুরমায় ৩৫টির চর জেগেছে। এসব স্থান দিয়ে লোকজন হেঁটে পার হচ্ছে। নদীর মাঝ বরাবর চলছে ফসল ফলানোর চেষ্টা।

সুরমা বেঁচে আছে কানাইঘাটের লোভাছড়া নদীর পানি প্রবাহে। ভারত থেকে প্রবাহিত পাহাড়ি ছোট নদী 'লোভা'। যা কানাইঘাটের লোভাছড়া চা বাগানের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এই ছড়া বা পাহাড়ি ছোট নদী শুকনা মৌসুমে সুরমার শুষ্ক দেহে পানি পৌঁছে দেয়। যা ধারণ করে শুষ্ক মৌসুমে সুরমা ক্ষীণকায় স্রোতে সিলেট মহানগর অতিক্রম করে। সিলেট মহানগরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা শুষ্ক মৌসুমের সুরমা মূলত লোভা নদীর পানি বয়ে চলছে। লোভার সাথে মিলনের পরে সুরমা বিশ্বনাথ থেকে মিলিত হওয়া বাসিয়া নদী, ছাতকের আফজলাবাদ ইউনিয়নে ডাউকা নদী, জৈন্তা-গোয়াইনঘাট থেকে আসা সারি-গোয়াইন নদী, পিয়াইন নদী, দোয়ারাবাজার থেকে আসা জালিয়া নদী ও মেঘালয় পাহাড়ের ছোট বড় বিভিন্ন খাল ও ছড়ার মিলনে শক্তি সঞ্চয় করে ছাতক উপজেলা থেকে সুনামগঞ্জের দিকে এগিয়ে যায়। সুনামগঞ্জে সুরমার সাথে মিশেছে বোগাপানি, জাদুকাটা, সোমেশ্বরী এবং কংস নদী। দীর্ঘ পথ পরিক্রম শেষে সুরমা অমলসীদে পৃথক হওয়া বোন কুশিয়ারার সাথে পুনরায় মিলিত হয়ে মেঘনা নামে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়।

উৎসমুখ থেকে লোভা নদীর মিলনে মৃত সুরমা কানাইঘাটে আবার প্রাণ ফিরে পেলেও আত্মপরিচয় হারাতে বসেছে। কিংবদন্তীর নদী সুরমা উৎসমুখ ভরাটের কারণে মাতৃনদী বরাক থেকে ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরছে। যা এই ঐতিহাসিক নদীর অস্তিত্বকে করছে বিপন্ন। লোভা নদী সুরমায় পতিত না হলে সুরমা একেবারেই পানিশূন্য থাকতো। পানিশূন্য নদীতে সৃষ্ট চর মানুষ দখলে নিতে চায়। দখল হওয়া চরে শুরু হয় কৃষি কাজ। এতে নদীর মাটি শক্ত হয়ে বর্ষায় প্লাবনের সৃষ্টি করে। সুরমার শুষ্ক চরেও এখন দখলদারি শুরু হচ্ছে। অমলসীদ থেকে লোভা নদীর মিলন স্থল পর্যন্ত ৩২ কিলোমিটার এলাকা খনন করা না হলে ভবিষ্যতে নদীর কোন চিহ্ন থাকবে না। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে সুরমার উৎসমুখ খননের প্রয়োজনীয়তা যৌথ নদী কমিশনে জরুরীভাবে উত্থাপন করা জরুরী। সিলেটের মানুষের আবেগ অনুভূতির সাথে সম্পর্কযুক্ত সুরমা। তাই সুরমা নদীর আত্মপরিচয় বিলুপ্তির এ সংকটকালে সিলেটবাসীর জেগে ওঠা প্রয়োজন। সুরমার আত্মপরিচয় রক্ষা ও সিলেটের হাজার বছরের সুরমাকেন্দ্রিক ইতিহাস ঐতিহ্য রক্ষায় অবিলম্বে সুরমার উৎসমুখ খনন করা প্রয়োজন।

সুরমা নদী সিলেটের প্রাণ। সিলেট নগরী সুরমা নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠেছে। সিলেটবাসীর ঠিকানা সুরমা। তাই 'সুরমা নদীর তীরে আমার ঠিকানারে...' আমরা অবলীলায় গেয়ে যাই। কিন্তু সেই সুরমা নদীর সাথে অত্যন্ত অন্যায় চলছে। নগর জীবনের সমস্ত আবর্জনা সুরমা নদীতে ফেলা হচ্ছে। সুরমার সাথে সংযুক্ত খাল ও ছড়াগুলোতে গৃহস্থালি আবর্জনা, হোটেল-রেস্তোরা, হাসপাতাল-ক্লিনিক ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। সিটি কর্পোরেশন মহানগরীর খাল ও ছড়া থেকে নিয়মিত আবর্জনা অপসারণের চেষ্টা করছে। কিন্তু আবর্জনা ফেলা বন্ধ হচ্ছে না। ফলে অপসারণের কিছুদিন পরেই খাল ও ছড়া আবর্জনায় ভরে ওঠে। আর এই আবর্জনার গন্তব্য হয় ঐতিহ্যবাহী সুরমা নদী। এভাবে যদি দূষণ অব্যাহত থাকে তবে বুড়িগঙ্গা বা তুরাগের মত অবস্থা হবে সুরমার। তাই সুরমাকে দূষণের হাত থেকে বাঁচাতে আবর্জনা ফেলা বন্ধ করতে হবে। সিটি কর্পোরেশনকে আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। একই সাথে নগরবাসীকে খাল, ছড়া, জলাশয় ও নদীতে আবর্জনা ফেলার বদ অভ্যাস পরিত্যাগ করতে হবে। সুরমা নদীকে দখল করে নির্মাণ করা আলোচিত বিলাসী শৌচাগার এখনো সম্পূর্ণভাবে অপসারণ করা হয়নি। এই অবৈধ স্থাপনার মূল কাঠামো রয়ে যাওয়ায় সুরমা নদী দখলমুক্ত হয়নি। জেলা প্রশাসন ও নগর ভবনের ৫০০ মিটার এলাকার মধ্যে এমন একটি অবৈধ স্থাপনা বিনা বাঁধায় নির্মাণ করার অপতৎপরতাই নদীর প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে।

সিলেটের নদীগুলোর দুরবস্থা নিয়ে কথা বলতে গেলে আন্তঃসীমান্ত সমস্যার কথাও বলতে হবে। সিলেটের অনেক নদীই আন্তঃ সীমান্ত নদী। যা প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের আসাম,মেঘালয় ও ত্রিপুরা রাজ্য থেকে সিলেট প্রবেশ করেছে। আন্তঃ-সীমান্ত এ নদীগুলো হচ্ছে সুরমা, কুশিয়ারা, ধলা, পিয়াইন, সারী-গোয়াইন, লোভা, সোনাইবরদল, মনু, ধলাই, জুরি, লংলা, গোপলা, যাদুকাঁটা, জালিয়াখালী, ধামালিয়া, খাসিয়ামারা, উমিয়াম, সোমেশরী, খোয়াই, সুতাং ও সোনাই। এই নদী গুলোর অনেক শাখা নদী ও উপনদী রয়েছে সিলেট বিভাগের চার জেলায়। আন্তঃ-সীমান্ত নদীগুলোর অবস্থা ভালো নয়। নদীগুলোকে ভারত শাসন ও শোষণ করে চলেছে।

উজানে ভারতের এই বৈরি আচরণের পাশাপাশি স্বদেশেও নদীর সাথে নিপীড়ন চলছে। সিলেটে বিভাগে পিয়াইন, সারি, ধলাই, লোভা, যাদুকাটা, চলতি, রাংপানি ইত্যাদি নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত করে পাথর উত্তোলন চলছে। অপরিকল্পিত পাথর উত্তোলনের কারণে ডাউকি নদী আজ হারিয়ে গেছে। সুরমা, কুশিয়ারা, খোয়াই ও মনু নদী নানাভাবে বর্জ্য দূষণের স্বীকার। সোনাই নদীর অভ্যন্তরে নির্মিত সায়হাম ফিউচার পার্ক নদীরক্ষায় প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের উদাসীনতার নির্মম সাক্ষী। মাধবপুর-চুনারুঘাটে গড়ে ওঠা শিল্পাঞ্চল সুতাং, সুনাই, বলভদ্র নদীর পানি বিষাক্ত করছে। সিলেট বিভাগের অধিকাংশ নদী থেকে ইচ্ছে খুশি বালি উত্তোলন করা হয়। বালু ব্যবসায়ীদের কাছে নদী মুনাফার আঁধার। নদীতে ইচ্ছে খুশি বাঁশের বাঁধ দিয়ে মাছ ধরা এখন অপরাধের পর্যায়ে পরে না। সিলেট বিভাগের অধিকাংশ নদীতে বর্ষা শেষ পানি কমে যাওয়ার সময় বাঁশের বাঁধ দিয়ে প্রভাবশালীরা মাছের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে। শুষ্ক মৌসুমে নদীতে বাঁধ দিয়ে পানি সেঁচে মাছ ধরার ঐতিহ্য সৃষ্টি হচ্ছে। বিশ্বনাথের বাসিয়া নদীকে দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে একাধিক স্থাপনা। ঢাকাদক্ষিণের কাকেশ্বর নদী ড্রেনে পরিণত হয়েছে। লোলা নদীকে দখল করায় নিয়মিত জলাবদ্ধতা বিয়ানীবাজারের অন্যতম নাগরিক সমস্যা।

সিলেটের নদ-নদী ও হাওর-বাওর ভরাট হয়ে যাওয়ার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ এ অঞ্চলের পাহাড়-টিলা কেটে সমতল করার প্রবণতা। গত দুই দশকে সিলেট জেলার প্রায় ৫০% টিলা-পাহাড় কেটে ফেলা হয়েছে। এভাবে টিলা-পাহাড় কাটার কারণে প্রচুর পরিমাণ মাটি জলাশয়গুলোকে ভরাট করেছে। ছোট ছোট খাল ও ছড়া ভরাট হয়ে যাওয়ায় বর্ষায় পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়।

সুনামগঞ্জ, সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলায় সাম্প্রতিক দীর্ঘস্থায়ী বন্যার পেছনে অপরিকল্পিত নদী শাসনকে দায়ি করছেন বিশেষজ্ঞ ও ভুক্তভোগীরা। সুনামগঞ্জের বন্যার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিম্নমানের কাজকে দায়ী করে একাধিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। সাম্প্রতিক বন্যায় কুলাউড়া, রাজনগর ও ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অন্যতম কারণ হিসাবে জুরী ও কুশিয়ারা নদীর মিলন স্থলে নির্মিত বুড়িকিয়ারি বাঁধ ও ইটভাটাকে দায়ি করছে সংবাদ মাধ্যম।

সিলেটের পরিবেশ প্রতিবেশ সুরক্ষায় প্রতিটি নদীকে বাঁচাতে হবে। নদীর পাশে দাঁড়াতে হবে। নদীর সাথে হওয়া অন্যায় চিহ্নিত করে প্রতিরোধে নামতে হবে। আন্তঃ-সীমান্ত নদীর সমস্যা সমাধানে ভারতকে চাপে রাখতে সরকারকে বাধ্য করতে হবে। বাংলাদেশকে জাতিসংঘ প্রণীত পানি প্রবাহ আইন ১৯৯৭ অবিলম্বে স্বাক্ষর ও সে অনুযায়ী নদীরক্ষায় পদক্ষেপ নিতে হবে। ভারতকে উক্ত আইন অনুস্বাক্ষরে রাজী করাতে হবে ও তার ভিত্তিতে একটি আঞ্চলিক পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা নীতি ও কৌশল প্রণয়ন এবং তার ভিত্তিতে সকল আন্তঃ-সীমান্ত নদী ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। মৃত ও ভরাট নদী ড্রেজিং করে তার প্রবাহ ও নাব্যতা পুনরুদ্ধার এবং নদীর মাটি/পাড় ইজারা দেয়া বন্ধ করতে হবে। পাহাড়-টিলা কাটা বন্ধ করা না হলে নদী ও হাওর ভরাট হওয়া অব্যাহত থাকবে। সিলেট অঞ্চলের বনাঞ্চলকে রক্ষা করা না গেলে ভুমিক্ষয় চলতেই থাকবে। আবহাওয়া ক্রমাগত চরমভাবাপন্ন হবে। ভূমি মন্ত্রণালয়, পানি উন্নয়ন বোর্ড, সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভাসমূহ, নগর উন্নয়ন সংস্থাসমূহ, বিআইডব্লিটিএ, নদী কমিশন, নদী টাস্কফোর্সকে দৃঢ়ভাবে নদী-বান্ধব নীতি অনুসরণ করতে হবে। নদীতে বাঁধ-ব্যারেজ-রেগুলেটর বসানোর ‘বেষ্টনী নীতি’ ভিত্তিক ভুল নদী ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে।

(১২ জুলাই রাতে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মো. আতাহারুল ইসলাম-এর উপস্থিতিতে সিলেট সার্কিট হাউজের সম্মেলন কক্ষে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), সিলেট শাখা ও সুরমা রিভার ওয়াটারকিপার-এর উদ্যোগে আয়োজিত "সিলেট বিভাগের চলমান বন্যা ও নদ-নদীর সার্বিক অবস্থা" শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় পঠিত)

আব্দুল করিম কিম, সমন্বয়ক, সিলেটের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি ও প্রকৃতি রক্ষা পরিষদ।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ