আজ মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

পর্যাপ্ত খাবার থাকলেও দুর্ভিক্ষ হতে পারে

ইমতিয়াজ মাহমুদ  

অমর্ত্য সেন অর্থনীতিতে নোবেল পেয়েছিলেন কী জন্যে সেটা কি আপনার মনে আছে? দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষ নিয়ে তিনি যে গবেষণাপত্রটি করেছিলেন সেটির জন্যে। গবেষণাটি Poverty and Famine নামে প্রকাশিত বই আকারে পাওয়া যায়। এখানে অমর্ত্য সেন দেখিয়েছেন যে দুর্ভিক্ষ খাদ্যের অভাবে হয়না, দুর্ভিক্ষ হয় মানুষের খাদ্যের অধিকার না থাকলে। সেন ব্যবহার করেছেন entitlement শব্দটি, সেটিকেই অধিকার বলছি।

অমর্ত্য সেন আমাদের এখানকার মন্বন্তর, চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ আর আফ্রিকার দুর্ভিক্ষ এর সবগুলিকে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন এইসব দুর্ভিক্ষে যখন হাজার হাজার বা কোন ক্ষেত্রে লক্ষ মানুষ মারা যায় তখন সেইসব দেশে সকল মানুষের জন্যে পর্যাপ্ত খাবার ছিল, বা ব্যবস্থা করার উপায় ছিল। এই যে খাদ্যে অধিকারের কথা বলছি, সেটার জন্যে একটি কার্যকর গণতন্ত্রের উপস্থিতি যে জরুরি সেটাও দেখিয়েছেন অমর্ত্য সেন।

এটা অতি সরল করে বলা। সামাজিক বিজ্ঞানের সকল তত্ব ও ধারণার মতো অমর্ত্য সেনের এই সিদ্ধান্তও বিতর্কের ঊর্ধ্বে না। কিন্তু এই কথাটি মোটা দাগে সকলেই সঠিক মানেন যে একটি কার্যকর গণতন্ত্র যে দেশে থাকে, সেই দেশে চট করে মানুষ না খেয়ে মারা যায়না।

এই কথাটি কেন এখন মনে এসেছে বুঝতে পারছি না। সম্ভবত দেশে যে বন্যা অবস্থা চলছে এবং এর ভয়াবহতা সম্পর্কে যেসব পূর্বানুমান শুনছি, সেগুলি থেকে খুব ভয় লাগছে বলেই নানারকম কুকথা মনে আসছে। মানুষ যখন বিপদে থাকে, বা বিপদের শঙ্কার মধ্যে থাকে, তখন মানুষের মনে এইরকম কু-ডাক ডাকেই। মেহেরবানি করে কেউ কোন অপরাধ নেবেন না।


দেশে বন্য অবস্থা চলছে। বানের পানিতে গ্রামের পর গ্রাম ডুবেছে, মানুষ মারা গেছে, গরু ছাগলের ক্ষতি হয়েছে, ফসলের ক্ষতি হয়েছে, বাড়িঘর ভেসে গেছে। দেশে কোন বন্যা নাই বলে বৃহস্পতিবার যারা শাহবাগে ইমরান এইচ সরকারকে তাড়া করেছেন, ওরা মন্দ লোক, তস্কর। খুবই খারাপ মানুষ এগুলি। সকলেই বলছেন এরা নাকি ছাত্রলীগের কর্মী। হতে পারে, অসম্ভব কিছুনা। ছাত্রলীগের ছেলেরা কিছুদিন আগে ইমরান আর সনাতনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে, ওদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছে। আদালতেই ইমরানের উপর হামলা করেছে। ইমরানের উপর এই হামলাটি যদি ছাত্রলীগ করে থাকে অবাক হবো না। এরা ছাত্রলীগ হোক বা না হোক, এরা যে মন্দ ও গুণ্ডা প্রকৃতির দল এই ব্যাপারে তো আর কোন সন্দেহ নাই।

এই গুণ্ডাগুলি 'দেশে কোন বন্যা নাই' বলে দেশের কি ভালোটা করতে চেয়েছে জানিনা। সরকার বা আওয়ামী লীগেরই বা কি ভালো হবে। এই মূর্খরা কি জানে না যে সরকার বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্যে নানারকম ব্যবস্থা নিয়েছে? এরা কি জানেনা যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যে তাদের সকল কর্মকর্তা কর্মচারীর ছুটি বাতিল করেছে? এগুলি কি এই খবরটি রাখে না যে সরকার ইতোমধ্যেই দেশে বিপুল পরিমাণ খাদ্য আমদানির ব্যবস্থা করেছে? ওদেরকে জানিয়ে দিতে পারেন যে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে চাঁদা চেয়ে সরকারে মন্ত্রীরা ইতিমধ্যে বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে অনুরোধ জানানো শুরু করেছে।

এইগুলি কেন বলছি, কারণ দেশে যে বন্যা পরিস্থিতি বিরাজ করছে সেটা সরকারও অস্বীকার করছে না। এবং বন্যা পরিস্থিতি যে আরও ভয়াবহ হবে সে ব্যাপারেও সরকার সচেতন আছে। এর মধ্যে সরকার সমর্থক কেউ যদি বলে দেশে কোন বন্যা নাই, এদেরকে কি বলবেন?


গুণ্ডারা গুণ্ডামি করবে, ওদের ছলের অভাব হয় না। করুক। আমার মনে হয় না এইরকম গুণ্ডামির ভয়ে ইমরান বা অন্যরা যারা বন্যার জন্যে ত্রাণ সংগ্রহ করছে ওরা ওদের কাজ বন্ধ করবে। গুণ্ডারা যুগে যুগে ছিল, এখনো আছে। ওরা যা খুশী করুক, আমরা আমাদের কাজটা করে যাবো।

এই সময়ে আমাদের কাজটা কি?

প্রথম কাজ তো হচ্ছে সচেতন থাকা। বিপদ আসছে। আপনারা যারা উপদ্রুত এলাকায় আছেন, নিরাপদ জায়গায় সরে যাওয়ার চেষ্টা করুন। বন্যা তো কেবল যে পানিতে সব তলিয়ে দেয় সেটা তো নয়, বন্যা নানারকম রোগ ব্যাধি নিয়ে আসে। শিশুদের জন্যে এবং বয়স্ক লোকদের জন্যে বিশেষ করে বন্যার সময়টা খুবই বিপদজনক। সম্ভব হলে আগে থেকেই সরে যান। নিরাপদে জায়গায় চলে যেতে চেষ্টা করুন। আর আপনাদের যেসকল আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব উপদ্রুত এলাকায় আছেন, খোঁজ নিন ওরা কেমন আছেন। যতটুকু সম্ভব ওদেরকে সহায়তা করতে চেষ্টা করুন। বিপদের সময় সামান্য সহায়তাও অনেক বড় উপকার করে।

আর যতটুকু সম্ভব বন্যা ত্রাণে সাহায্য করুন। টাকা দিতে পারলে সবচেয়ে ভাল হয়। টাকা ছাড়াও খাবারদাবার ওষুধ কাপড়চোপড় এইসবও দরকার। নিজে সাহায্য করুন, সাহায্য সংগ্রহে সকলকে সহায়তা করুন। তাই বলে সবাই অল্প কিছু টাকা নিয়ে উপদ্রুত এলাকায় দৌড় দেওয়া কোন কাজের কথা না। না, যেতে পারলে তো যাবেনই। স্বেচ্ছাসেবক দরকার আছে। কিন্তু একসাথে সংগঠিত হয়ে সবাই সবার সাথে কো-অরডিনেট করে যেতে পারলে ভাল হয়। অতীতে দেখা গেছে ছোট ছোট দল গিয়ে একই জায়গায় নানারকম রিলিফ সামগ্রী নিয়ে বিতরণ করে চলে এসেছেন, আবার অপেক্ষাকৃত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় দেখা গেল কেউই যাচ্ছে না। এজন্যে কো-অরডিনেট করে নিতে পারলে ভাল।


আর কাকে সাহায্য দেবেন? কার হাতে তুলে দেবেন আপনার সাহায্য পৌঁছানোর দায়িত্ব। সেটা আপনি আপনার অবস্থান থেকে নির্ধারণ করবেন। আমার কাছে তো সবসময়ই মনে হয়েছে ছাত্র ইউনিয়ন, সিপিবি এরা খুবই আন্তরিক ও দক্ষ। এরা ছাড়াও আরও সংগঠন আছে, রাজনৈতিক অরাজনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন। এই যে ইমরান এইচ সরকার ত্রাণ তুলছেন, তিনি ও তাঁর সংগঠন এরাও নিশ্চয়ই নির্ভরযোগ্য। এছাড়া গণসংহতি আন্দোলনের কর্মসূচির কথা জেনেছি, ওদের উপরও আস্থা রাখতে পারেন। আপনার ত্রাণের টাকা এরা মেরে খাবে না।

টাকাপয়সা দিতে চাইলে এমন কাউকে দেন যারা আপনার টাকাটা কাজে লাগাবে বলে আপনি আস্থা পান। যারাই বন্যা ত্রাণে কাজ করছেন, এদের প্রায় সকলেই ভালো মানুষ।

আর কত টাকা দিবেন? চেষ্টা করেন যত বেশি সম্ভব দিতে। একবারে না পারেন ভাগ ভাগ করে দেন। কিন্তু বেশি টাকাই দিতে হবে এমন কোন কথা নাই। বেশি টাকা দিতে পারছেন না বলে লজ্জা পাবেন না। একশ দুইশ পারলে একশ দুইশ দেন, হাজার দশ হাজার পারলে তাই দেন, না পারলে দশ বিশ টাকাই দেন। তবুও কিছু সাহায্য করেন। সকলে অংশ নিলে একেকজন কম টাকা দিলেও সেটা বেশি হয়ে যায়। অনেক কাজে লাগে। টাকা ছাড়া কোন ত্রাণসামগ্রী যদি দিতে চান, যারা স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে কাজ করছেন ওদেরকে জিজ্ঞাসা করে আলাপ আলোচনা করে নেন, জেনে নেন কোথায় কি ধরনের সাহায্য গেলে ভাল হয়।

আর আপনার আশেপাশের যারা আছেন, সহকর্মী, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় স্বজন, সকলকে বলেন বন্যাত্রাণে এগিয়ে আসতে। সম্ভব হলে আপনি সংগঠিত করেন, অথবা যারা সংগঠিত করছেন, ওদেরকে সাহায্য করেন।

শারীরিকভাবে অংশ নিতে পারলে সেটাও করেন। টাকা পয়সার যেমন দরকার আছে, শ্রমেরও দরকার আছে। যারা শ্রম দিচ্ছেন ওরা টাকার চেয়ে মূল্যবান সহায়তা দিচ্ছেন।


বিপদের সম্ভাব্য ভয়াবহতার কথা তো খবরের কাগজে দেখেছেন। কিন্তু বন্যার ভয়াবহতাকে ভয় পাই না। কোন দুর্যোগকেই আসলে বাঙালি ভয় পায় না। আমি যতটুকু জানি আমাদের দেশে এই বছর খাবারের অভাব হওয়ার কথা না। ঘাটতি মেটানোর জন্যে সরকার শস্য আমদানির ব্যবস্থাও করেছে। বেশ কয়েকটি বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের সাথে কথা বলেছি গত দুই তিন দিনে। ওরা জানিয়েছেন যে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে ওরা মোটা অঙ্কের টাকা দিবে কয়েকদিনের মধ্যেই।

তরুণদের মধ্যে দেখেছি দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্যে আগ্রহ আছে, দৃঢ়তা আছে। অনেকেই ইতোমধ্যে নেমে পড়েছে কাজে। সব মিলিয়ে বিপদের সম্ভাব্য ভয়াবহতা যতটুকু হতে পারে, সেটাকেও ভয় পাওয়ার কিছু দেখি না। একটু অসুবিধা হবেই, কিন্তু বড় রকমের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো সম্ভব।

কিন্তু ঐ যে শুরুতেই বলেছি, দেশে পর্যাপ্ত খাবার থাকলেও দুর্ভিক্ষ হতে পারে। তাই-ই হয়। সেই অবস্থা না আবার হয় সেই আশঙ্কাটা যাচ্ছে না। আপনারা মেহেরবানি করে যার যার জায়গা থেকে চেষ্টা করেন, সরকার যেন তৎপর থাকে- দেশের গুদামে খাবার থাকা অবস্থায় মানুষ না খেয়ে মরবে সেরকম অবস্থা যেন না নয়। সামনে আশ্বিন কার্তিক মাস আসছে, বন্যা যখন নেমে যাবে, চাষিদের কাছে শস্যও তো থাকবে না।

আমাদের সকলে মিলে সঙ্কটে একে অপরের পাশে থাকতে হবে। বিপদের দিনে মানুষের পাশে না থাকলে কখন থাকবে? পিঠেপুলি খাওয়ার দিনগুলিতে?

ইমতিয়াজ মাহমুদ, অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ