আজ মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

মূলধন ঘাটতি, নাকি জনগণের পকেট কাটতি

মো. মাহমুদুর রহমান  

ব্যাংকে দক্ষ জনশক্তি নিয়োগের জন্য ইন্টারভিউয়ের আয়োজন। ব্যবস্থাপনা পরিচালক চাকরি প্রার্থী ব্যাংকারকে প্রশ্ন করলেন, বলুন তো ব্যাংক আমানতের সুরক্ষা ও গ্রাহকের আস্থা কিসের উপর কিসের উপর টিকে আছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে? একটু চিন্তা করে উত্তর এল- ব্যাংকারদের সততার উপরই আমানতের সুরক্ষা ও গ্রাহকের আস্থা নির্ভর করে। এই উত্তরের সাথে দৃঢ়ভাবে দ্বিমত পোষণ করে ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহোদয় বললেন- না, আপনি সঠিক বলেননি। কর্মকর্তা সৎ না অসৎ এটা কোনো বিষয়ই নয়। আসলে ব্যাংকিং ব্যবস্থা টিকে আছে ডাবল এন্ট্রি সিস্টেমের উপর।

‘এভরি ডেবিট মাস্ট হেভ এ করেসপন্ডিং ক্রেডিট’- হিসাব বিজ্ঞানের এই নীতিই ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে সুরক্ষা দিয়ে যাচ্ছে যুগের পর যুগ। নতুবা কার টাকা কে নিয়ে যেত তার কোন খোঁজই পাওয়া যেত না। সততার বিষয়টি এভাবে উড়িয়ে দেয়া- মনে মনে মেনে নিতে না পারলেও প্রশ্নকর্তার অভিমতের সাথে একমত না হয়ে উপায় ছিল না।

হিসাব বিজ্ঞানে ‘ডাবল এন্ট্রি’ সিস্টেম এবং শিল্পকর্মে ‘মোনালিসা’ চিত্রকর্মটি প্রায় পাঁচশত বছরের চেয়েও বেশি সময় থেকে স্ব স্ব ক্ষেত্রে সমান গুরুত্ব নিয়ে বিরাজমান। লিওনার্দো দা ভিঞ্চির অমর সৃষ্টি ‘মোনালিসা’ চিত্রকর্মটি এঁকেছিলেন ইতালিতে বসে ১৫০০ সালের কাছাকাছি সময়ে। ‘মোনালিসা’ আজও তাবৎ বিশ্বের শিল্প পিপাসু মানুষের কাছে বিস্ময়কর ও রহস্যাবৃত হিসেবেই রয়েছে। ‘মোনালিসা’র হাসির অর্থ উদ্ধারে এ পর্যন্ত শিল্পী সাহিত্যিকরা শব্দের পর শব্দ রচনা করে চলছেন তবুও যেন কেউ তৃপ্ত হতে পারছেন না। আর লিওনার্দো কাকে উদ্দেশ্য করে ছবিটি এঁকেছিলেন তাও সবার অজানা।

অনেক ইতিহাসবিদের মতে মোনালিসা ছবির ওই নারী হচ্ছেন ইতালির ফ্লোরেন্স নগরীর এক অভিজাত পরিবারের ব্যবসায়ীর স্ত্রী লিসা দেল গিওকন্দো। লিসা দেল গিওকন্দো পাঁচ সন্তানের জননী ছিলেন। আবার কেউ কেউ মনে করেন লিওনার্দোর নিজের ছবিই মোনালিসা যা তিনি নারীর আদলে তৈরি করেছিলেন। এজন্য ছবিটি তাঁর খুব প্রিয় ছিল। ১৫১৯ সালে ফ্রান্সে মৃত্যুর সময় পর্যন্ত ছবিটি তিনি সাথে সাথে রাখতেন।

লিওনার্দো দা ভিঞ্চি ছিলেন একজন স্থপতি। লিওনার্দোর সহযোগি ছিলেন একজন গণিতবিদ। লিওনার্দোর জন্ম ১৪৫২ সালে ইতালির ফ্লোরেন্স নগরের পাশে ছোট্ট শহর ভিঞ্চিতে। আর তাঁর গণিতবিদ সহযোগির জন্ম ফ্লোরেন্স এর কাছাকাছি সানসপিলক্রোতে ১৪৪৫ থেকে ১৪৪৮ সালের মধ্যে। অর্থাৎ দুজনই বৃহত্তর অর্থে ইতালির ফ্লোরেন্সে জন্মগ্রহণ করেন খুব কাছাকাছি সময়ে। তবে তাদের পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয় ইতালির মিলান শহরে। ১৪৯৪ সালে ল্যাটিন ভাষায় গণিতের বিখ্যাত বই ‘সুম্মা ডি এরিথমেটিকা, জিওমেট্রিকা, প্রপোরসনিয়েট, প্রোপোরসনালিটাতে’ প্রকাশিত হওয়ার পর এই গণিতবিদের সাথে পরিচয় হয় লিওনার্দো দা ভিঞ্চির এবং কিছুদিন তিনি তাঁর এই সহযোগি গণিতবিদ বন্ধুর কাছে গণিতও শিখেন।
সেই হিসেবে তাদের মধ্যে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কও ছিল।

ক্রিস্টোফার কলম্বাসের সমসাময়িক এই গণিতবিদই হচ্ছেন লুকা প্যাসিলিও, যাকে আধুনিক হিসাব বিজ্ঞানের জনক বলা হয়। লুকা প্যাসিলিও তাঁর এই বইয়ে ‘ডাবল এন্ট্রি’ সম্পর্কে ধারনা দেন। যা আজও বহুলভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে আমাদের ব্যাংকিং সেক্টরসহ হিসাব বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে। বর্তমান বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ওই সময়ের ইতালির জনগণের কাছে দুভাবেই ঋণী। একদিকে পৃথিবীর প্রথম বাণিজ্যিক ব্যাংকিং শুরু হয়েছিল ইতালিতে। এখন সারাবিশ্বের ব্যবসা বাণিজ্য ও লেনদেন বাণিজ্যিক ব্যাংক ছাড়া কল্পনাও করা যায় না। তাই বাণিজ্যিক ব্যাংক ও ব্যাংকের হিসাব রাখার পদ্ধতি দুটোই এসেছে ইতালি থেকে।

বাণিজ্যিক ব্যাংক ইতালিতে শুরু হওয়ার পর কালক্রমে শত শত বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে নতুন নতুন সেবা ও সেবা প্রদানের আধুনিক কৌশলে সুসজ্জিত হয়ে আজ বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে হাজির। বর্তমান বাংলাদেশে দ্রুত প্রসারমান ও লাভজনক খাত ব্যাংকিং হলেও হিসাবে রয়ে গেছে গড়বড়। বছর শেষে আর ব্যাংকের মূলধনের হিসাব মিলে না। গত জুনের হিসাব অনুযায়ী দেশের ৫৬ টি ব্যাংকের মধ্যে এখন ৯ টিতে মূলধন ঘাটতি রয়েছে। এরমধ্যে ৭ টিই হচ্ছে সরকারী ব্যাংক এবং বাকি দুটি বেসরকারি ব্যাংক। ৯ টি ব্যাংকের মোট মূলধন ঘাটতি রয়েছে ১৬ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। এরমধ্যে সরকারি ৭ টি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ১৪ হাজার ৯২২ কোটি টাকা। গত মার্চে সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে ৫ টি ব্যাংক ছিল মূলধন ঘাটতিতে যার পরিমাণ ছিল ১৩ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে সরকারি ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতির পরিমাণ বেড়েছে ১ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা। সরকারি ৮ টি ব্যাংকের মধ্যে ৭ টিতেই মূলধন ও প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে বলে বলে জানা যায়। এ ঘাটতির কারণ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ দায়ি করেছেন সীমাহীন দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও তদারকির অভাবকে। এর ফলে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। আর খেলাপি ঋণ বাড়লে মূলধন ঘাটতি হবেই (যুগান্তর, ২৭ সেপ্টেম্বর)।

সরকার এই মূলধন ঘাটতি পূরণের জন্য প্রতিবছর বাজেটে বরাদ্দ রাখছে। গত অর্থবছরের বরাদ্দ থেকে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা দেয়া হয়েছে। আগামী অর্থবছরগুলোতে ৫ হাজার কোটি টাকা করে প্রতিবছর মূলধন ঘাটতি পূরণের তহবিল হিসেবে রাখার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগ প্রস্তাবনা দিয়েছে। কথা হচ্ছে সরকার কার টাকা কাকে দিচ্ছে? জনগণের করের টাকার আমানতদার সরকার। এ দেশের কোটি কোটি শ্রমিকের রক্ত পানি করা পরিশ্রমের টাকা থেকে কর দেয় সরকারকে। এ টাকায় ভালভাবে তাকালে সরকারের কর্তা ব্যক্তিরা ঘর্মাক্ত শ্রমিকের, ক্ষুধার্ত ভিখারির চেহারা দেখতে পাবেন। তাহলে তারা কেন দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে দেয়া খেলাপি ঋণের কারণে সৃষ্ট মূলধন ঘাটতি পূরণে এ টাকা ব্যবহার করবে? মূলধন ঘাটতি পূরণের নামে এক ঘৃণ্য পথে সাধারণ মানুষের পকেটের টাকা চলে যাচ্ছে দুর্নীতিবাজ রাঘববোয়ালদের হাতে। এ অন্যায় প্রতিরোধে যাদের টাকা সেই জনগণকেই রুখে দাড়াতে হবে। বলতে হবে- না, আমরা আর টাকা দেব না। যারা ব্যাংকের টাকা লুটপাটের সাথে জড়িত তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করুন টাকা। তবে এ কথা বলার আগে জনগণকে বুঝতে হবে তারা কিভাবে প্রতারিত হচ্ছে, তাদের কষ্টে অর্জিত টাকার ভাগ কিভাবে দুর্নীতির মাধ্যমে ব্যাংক ঋণের নামে অন্যের পকেটে চলে যাচ্ছে। একই সাথে তাদেরকে এর প্রতিকারে সরব হওয়ার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, লুকা প্যাসিলিও’র বিখ্যাত ‘ডাবল এন্ট্রি’ সিস্টেম বলবত থাকা অবস্থায় কিভাবে হিসাবে এত গড়বড় হয়। তাহলে কি হিসাবরক্ষণের এ পদ্ধতিতে কোন ত্রুটির সুযোগ নিচ্ছে দুর্নীতিবাজরা? লুকা প্যাসিলিও কি বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছেন? না, সবই ঠিক আছে। শুধু ঠিক নেই যারা ‘ম্যান বিহাইন্ড দ্য সিস্টেম’ হিসেবে কাজ করছেন তারা। যেকোনো পদ্ধতিই অকার্যকর হতে বাধ্য যদি ওই পদ্ধতি বাস্তবায়নে নিয়োজিত কর্মী বাহিনী সৎ ও দক্ষ না হন। অসৎ ব্যাংকার, অসাধু ব্যবসায়ী এবং দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিকদের সমন্বয়ে দেশে যে দুষ্ট চক্র গড়ে উঠেছে তার হাত থেকে সরকারি ব্যাংকগুলোকে মুক্ত করতে না পারলে অনন্তকাল মূলধন ঘাটতি পূরণ সরকারের পক্ষে সম্ভব হবে না। এ দুষ্টচক্রের কুপ্রভাবে যদি কোন ব্যাংকে দেউলিয়া হাওয়া লাগে তাহলে ব্যাংকিং সেক্টরের সব অর্জন ম্লান হতে বাধ্য। তখন দেশের অর্থনীতির সামনে যে অপার সম্ভাবনার হাতছানি রয়েছে তা চোরাবালিতে হারিয়ে যাবে।

আশার কথা, এ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বেসিক ব্যাংক ঋণ জালিয়াতির সাথে জড়িতদের নাম প্রকাশ করেছেন। এভাবে শেয়ার বাজার, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংক ও বিভিন্ন আর্থিক জালিয়াতির সাথে জড়িতদের চিহ্নিত করে দ্রুত আইনের আওতায় নিয়ে আসার মাধ্যমে হয়তো ব্যাংকিং খাত রাহুমুক্ত হবে। একইসাথে ব্যাংকিং নিরাপত্তায় সঠিক পদ্ধতির সাথে কর্মনিষ্ঠ সৎ কর্মীকে নিয়োজিত করতে হবে ভবিষ্যৎ জালিয়াতি প্রতিরোধে।

মো. মাহমুদুর রহমান, ব্যাংকার। ইমেইল : [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ১৯ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৮৯ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৪ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ