আজ বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

বিচার ব্যবস্থার উন্নয়নে বাজেট: প্রত্যাশা ও বাস্তবতা

মুনীর উদ্দীন শামীম  

বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বাজেটটি উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। টাকার অংকে ৪০০২৬৬ কোটি টাকা। দেশের ইতিহাসের প্রথম বাজেটটি ছিল ৭৮৬ কোটি টাকার।

১৯৭২ থেকে ২০১৭। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছে বাংলাদেশ। অনেক ইতিবাচক ও গৌরবের গল্প তৈরি হয়েছে আমাদের। সব ক্ষেত্রেই উন্নয়নের চিহ্ন দৃশ্যমান। ফলে বেড়েছে বাজেটের কলেবর। প্রথম বাজেট ছিল শতকোটি টাকায়। এবারের বাজেট লক্ষ কোটি টাকায়। শতকরা হিসেবে প্রায় পঞ্চাশ হাজার গুণ বেশি।

২০০৯-২০১০ অর্থ বছর থেকে বাংলাদেশ প্রতিবছর লক্ষ কোটি টাকায় বাজেট প্রণয়ন করছে। বাজেটের এ প্রবৃদ্ধির হার প্রতিবছরই বেড়ে চলছে। ২০১৪-১৫, ১৫-১৬, ১৬-১৭ এবং ১৭-১৮ অর্থ বছরে এ বৃদ্ধির হার যথাক্রমে ১২.৬%, ১৭.৮%, ১৫.৪% এবং ১৭.৫%। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি)’র দিকে নজর দিলে আমরা দেখতে পাবো এ বৃদ্ধির পরিমাণ শতকরা হিসেবে আরও বেশি। ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে এডিপি বাজেটে তার আগের বছরের তুলনায় বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল ২১.৫%। ২০১৭-১৮ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এ বৃদ্ধির পরিমাণ আগের বছরের চেয়ে ৩৮% বেশি। বাংলাদেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে বাজেটের এ রকম ক্রমাগত স্বাস্থ্য বৃদ্ধিতে খুশী হওয়ার কথা। আমরা নিশ্চয়ই খুশী।

এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, প্রতিবছর বাজেট ঘোষণার ক্ষণটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। নীতিপ্রণেতা, বিদ্যাজগতের মানুষ, গবেষক, গণমাধ্যম, ব্যবসায়ী, এমনকি সাধারণ মানুষ বাজেটে কী থাকছে আর কী থাকছে না- তা দেখার গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন। মুহূর্তেই বাজেট নিয়ে নানা আলোচনা, বিতর্ক ও সমালোচনার ডালপালা গজায়। নানা চোখ, নানা মাত্রিকতা দিয়ে বাজেট বিশ্লেষণ চলে। কর, ভ্যাট, ব্যবসা সুযোগ, আমদানি-রপ্তানি, কর্মসংস্থানের সুযোগ, জেন্ডার, পরিবেশ-নানা মাত্রিকতা আর সূচক দিয়ে বাজেটের ভালোমন্দ বিবেচনা করা হয়। কিন্তু বিচার ব্যবস্থা বা বিচারিক পরিষেবার দিক থেকে বাজেট বিশ্লেষণের প্রবণতা একেবারে নেই বললেই চলে। অথচ বিচার ব্যবস্থা অন্যতম বৃহত্তম সরকারি পরিষেবা-দানকারী প্রতিষ্ঠান।

বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি অঙ্গের একটি। বিচারিক পরিষেবার ভূমিকা ও মানের সাথে শুধু গণতন্ত্র ও সুশাসনের সম্পর্ক জড়িত নয়; উন্নয়ন ও দারিদ্র্যের সম্পর্কও গভীর। যেসব বিষয় ক্রমাগতভাবে মানুষের দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে টিকে থাকার সক্ষমতাকে হ্রাস করে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে একটি কার্যকর বিচারিক পরিষেবায় সম ও সহজ প্রবেশাধিকারের অভাব। একটিমাত্র মামলাই জাতীয় দারিদ্র্য রেখার উপরে অবস্থানকারী একটি পরিবারকে চরম দারিদ্র্য রেখার নিচে টেনে আনতে পারে, যদি সে মামলাটি দিনের পর দিন চলতে থাকে। আবার পর্যাপ্ত ও যৌক্তিক বাজেট না থাকলে বিচারিক প্রতিষ্ঠানসমূহ একটি কার্যকর জনবান্ধব পরিষেবা-দানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠবে- সেটিও আশা করা যায় না।

এবারের বাজেট বক্তৃতার শিরোনাম হচ্ছে- উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ- সময় এখন আমাদের। মাননীয় অর্থমন্ত্রীর কথিত উন্নয়নের মহাসড়কটিকে বুঝতে চাইবো এবারের বাজেটে বিচারিক পরিষেবার উন্নয়নে বরাদ্দের পরিমাণ, তার গতিপ্রকৃতি ও অঙ্গীকার দিয়ে। দেখবার চেষ্টা করবো এ বাজেট কতখানি বিচারিক পরিষেবা উন্নয়ন-বান্ধব।

বিচারব্যবস্থার উন্নয়নে ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা
বাংলাদেশের যেকোনো ধরনের উন্নয়ন পরিকল্পনায় এখন গুরুত্বপূর্ণ দু’টি নথি হচ্ছে- ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০১৬-২০২০) এবং রূপকল্প ২০২১। এ ছাড়া সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় অভূতপূর্ব সাফল্যের পর জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনেও বাংলাদেশ তার আগের সাফল্য ধরে রাখবে- সেটিই সবার প্রত্যাশা। ফলে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাও উন্নয়ন পরিকল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এসব গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন নীতিকাঠামোয় যেসব দিকনির্দেশনা ও অঙ্গীকারগুলি রয়েছে সেগুলি বাস্তবায়নের অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে জাতীয় বাজেট। খুব স্বাভাবিকভাবে অনুমান করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় এসব গুরুত্বপূর্ণ নথিগুলি বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। বাজেট প্রণীত হয়েছে ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও রূপকল্প ২০২১-কে সক্রিয় বিবেচনায় নিয়ে। অতএব প্রস্তাবিত বাজেটে বিচার বিভাগের জন্য বরাদ্দ দেখার আগে বিচার বিভাগের উন্নয়নে ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় কী অঙ্গীকার করা হয়েছে তা একটু দেখা দরকার।

বাংলাদেশের আদালতগুলি অপেক্ষমাণ মামলার ভারে ভারাক্রান্ত। নানা উদ্যোগের ফল হিসেবে আদালতগুলিতে মামলা নিষ্পত্তির হার বেড়েছে। ফলে সামগ্রিকভাবে অপেক্ষমাণ মামলা বৃদ্ধির প্রবণতা কমেছে। ২০১৪, ২০১৫ ও ২০১৬ সালে এ হার ক্রমাগতভাবে কমে মামলা বৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৯.৪%, ৩.৩% ও ১.৫%। এ কমার পরও ২০১৭ সালের পহেলা জানুয়ারি আদালতগুলি সর্বমোট ৩১,৫৬,৮৭৮টি মামলা নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে। ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা আদালতগুলিতে মামলা বৃদ্ধির এ প্রবণতাকে খুব গুরুত্ব সহকারে নিয়েছে এবং আইনের শাসন ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচনা করেছে। ফলে নাগরিকদের জন্য দ্রুত ও মানসম্পন্ন বিচারিক পরিষেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এ পরিকল্পনায় বিচার বিভাগের সক্ষমতা বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। একটি ন্যায্য বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার রূপকল্পের কথা বলা হয়েছে। এ রূপকল্পের প্রধান তিনটি উপাদান হচ্ছে-
(ক) বিচারিক পরিষেবায় নাগরিকদের সহজ এবং স্বল্পখরচে প্রবেশাধিকার
(খ) মামলা ও আদালত ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়ায় ডিজিটাল পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে বিচারের জন্য অপেক্ষমাণ মামলার জট দূর করা, এবং
(গ) আইনি প্রক্রিয়ার সকল ধাপে তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে আইন প্রয়োগ ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন (পৃষ্ঠা-৫৮৩)।

এটি একই সাথে ন্যায় বিচার প্রাপ্তির জন্য নাগরিকদের যাতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে না হয় সে জন্য দ্রুত সাড়াপ্রদানে সক্ষম (রেসপন্সিভ) একটি সংবেদনশীল বিচারিক প্রক্রিয়ার উপর জোর দিয়েছে।

একটি ন্যায্য বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কতগুলি কর্মসূচি চিহ্নিত করেছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- বিচার বিভাগের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে যথাযথ অর্থ ও আইনি সহায়তা প্রদান, আদালতের প্রশাসনিক ব্যবস্থার উন্নয়ন ও শক্তিশালীকরণ, জেলা পর্যায়ে মামলা ব্যবস্থাপনার জন্য সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের অংশগ্রহণে সমন্বয় কমিটি প্রতিষ্ঠা, ৩১ লাখ মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য আইন কমিশনের সুপারিশের আলোকে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিচারক নিয়োগ এবং মামলা নথিবদ্ধকরণ সহ কোর্ট পরিচালনা প্রক্রিয়ার জন্য কম্পিউটারভিত্তিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা।

৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় আইন ও বিচার বিভাগের অধীন জাতীয় আইনগত সহায়তা সংস্থার সক্ষমতা বৃদ্ধির কথাও বেশ গুরুত্বের সাথে বলা হয়েছে। ২০২০ সালের মধ্যে প্রতিবছর ৩৭০০০ সেবাগ্রহীতাকে আইনি সেবাপ্রদানের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার কথা বলা হয়েছে। ২০২০ সালের মধ্যে বছরে কমপক্ষে ২৫০০০ মামলা বিকল্প পদ্ধতিতে নিষ্পত্তির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রত্যেক বিচারক যাতে প্রয়োজনীয় অফিস ও এজলাস পান সেজন্য সুপ্রিম কোর্ট ও নিম্ন আদালতের অবকাঠামো উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে। একই সাথে অপেক্ষমাণ মামলার সংখ্যা যাতে ২০১৯ সালের মধ্যে ৩.৩ মিলিয়ন অতিক্রম না করে সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগ্রহণের কথা বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে গোটা বিচার ব্যবস্থার 'ডিজিটাইজেশন' এর উপর জোর দেয়া হয়েছে। ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার একটি সমন্বিত তথ্য ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে।

সুপ্রিম কোর্ট, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের অধীন এক্সেস টু ইনফরমেশন প্রকল্পের সাথে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে একটি প্রকল্প গ্রহণের কথা বলা হয়েছে।

বাজেট বক্তৃতায় বিচারিক পরিষেবা উন্নয়ন প্রসঙ্গ
এবার দেখা যাক বিচার ব্যবস্থার উন্নয়নে এবারের বাজেটে কী রয়েছে। মাননীয় অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতাটি ১৫৩ পৃষ্ঠার। তার মধ্যে দু’টি অনুচ্ছেদ আইনের শাসন সম্পর্কিত। দু’টি অনুচ্ছেদ মিলে সর্বমোট ১১ লাইন। ১৫৩ পৃষ্ঠাব্যাপী পুরো বক্তৃতায় জাস্টিস বা ন্যায়বিচার শব্দটি মোট চার বার ব্যবহৃত হয়েছে (ইংরেজি ভার্সন দ্রষ্টব্য)। একবার আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের নাম হিসেবে। একবার সামাজিক ন্যায়বিচার অর্থে। একবার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে। আরেকবার ন্যায়বিচার প্রার্থীদের সেবা নিশ্চিত করা প্রসঙ্গে। জাস্টিস বা ন্যায় বিচার শব্দটি বহুল ব্যবহৃত হলেই রাষ্ট্র ন্যায়বিচার বা আইনের শাসনের পক্ষে- এমন অনুসিদ্ধান্ত টানার সুযোগ নেই। তবুও কখনও কখনও আধেয় বিশ্লেষণ থেকেও রাষ্ট্রের অগ্রাধিকার বিষয়ে একটা ধারণা পাওয়া যায়।

তাহলে মাননীয় অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট বক্তৃতায় বিচার বিভাগের উন্নয়নে কী কী অঙ্গীকার করেছেন? ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় নেয়া কার্যক্রম ও অঙ্গীকারের কতখানি প্রতিফলিত হয়েছে তাতে?বক্তৃতায় আইনের শাসন সম্পর্কিত অংশের প্রথম অনুচ্ছেদে বিচার বিভাগের উন্নয়নে চলমান অবকাঠামো উন্নয়ন বিশেষ করে জেলা পর্যায়ে চলমান আদালত ভবন নির্মাণ, ই- মোবাইল কোর্ট, যা গত অক্টোবর ২০১৬ সালে চালু হয়েছে, তার কথা বলেছেন। দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে ঝুঁকিপূর্ণ ও দাগি আসামীদের আদালতে উপস্থিত না করে ভিডিও কনফারেন্স এর মাধ্যমে শুনানির বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণে সক্রিয় বিবেচনার কথা উল্লেখ করেছেন। তারপর বিচারকদের দেশে বিদেশে উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণের কথা বলা হয়েছে। ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অন্যান্য যে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকারগুলি রয়েছে বিশেষ করে, ই-জুডিশিয়ারি, ডিজিটাইজেশন, সমন্বিত তথ্য ব্যবস্থাপনা, মামলা ব্যবস্থাপনা- এসব বিষয়ে কোন কিছুই বাজেট বক্তৃতায় উল্লেখ নেই। ডিজিটাল বাংলাদেশে ডিজিটাল বিচার ব্যবস্থার অবস্থানটি কী হবে, কীভাবে সেটি অর্জিত হবে- তা বাজেট বক্তৃতা থেকে বুঝবার বা অনুমান করার কোন সুযোগ চোখে পড়ে নি। তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক অনুচ্ছেদে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও মাঠ প্রশাসনে ই-নথি ব্যবস্থার কথা বলা হলেও উচ্চআদালত ও নিম্ন আদালতে সেটি চালু করা হবে কি না- এ সম্পর্কে কোন কিছু উল্লেখ নেই।

বাজেট বণ্টনে বিচারিক পরিষেবার হিস্যা
বাজেটে জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নামে একটি খাত আছে। বিচার বিভাগের বাজেটটি এ খাতের আওতাভুক্ত। এ খাতের আওতায় রয়েছে আইন ও বিচার বিভাগ, সুপ্রিমকোর্ট, দুর্নীতি দমন কমিশন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন জননিরাপত্তা বিভাগ, সুরক্ষা সেবা বিভাগ এবং আইন মন্ত্রণালয়ের অধীন লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ। সর্বমোট ৪০০,২৬৬ কোটি টাকার বাজেটের মাত্র ৫.৭% (২২,৫৮১ কোটি টাকা) জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা খাতে প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ২২,৫৮১ কোটি টাকার মধ্যে আইন ও বিচার বিভাগ, যেটি মূলত: নিম্ন আদালতসমূহের প্রশাসনিক কার্যক্রম দেখভাল করার দায়িত্বে নিয়োজিত, পাবে ৬.৯%। সুপ্রিমকোর্টের জন্য বরাদ্দ ০.৭৫%। প্রস্তাবিত বার্ষিক উন্নয়ন বাজেটে সুপ্রিমকোর্টের জন্য কোন বরাদ্দ রাখা হয়নি। ফলে বহুল আলোচিত বিচার বিভাগের ডিজিটাইজেশন প্রকল্পের ক্ষেত্রে কী ঘটল-তা বাজেট বক্তৃতা কিংবা বরাদ্দ থেকে বুঝবার কোন সুযোগ নেই। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা দরকার বিচার বিভাগকে ডিজিটাল পদ্ধতির আওতায় আনার প্রক্রিয়া হিসেবে সিলেটের আদালতগুলিতে পরীক্ষামূলক কার্যক্রম চালু হয়েছে গত বছর।

ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ থেকে বলতে পারি, সিলেটের আদালতগুলি ইতোমধ্যে এ পদ্ধতির সুফল পেতে শুরু করেছে। মামলা নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া দ্রুততর করা ও অপেক্ষমাণ মামলা কমিয়ে আনতে এ পদ্ধতি ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে।

আমাদের নিশ্চয়ই রূপকল্প ২০২১ এর কথা মনে আছে। একটি ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা এ রূপকল্পের মোদ্দাকথা। প্রশ্ন হচ্ছে ই-জুডিশিয়ারি বা বিচার বিভাগের ডিজিটাইজেশন ছাড়া ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা কী করে সম্ভব? আর বিচার বিভাগের ডিজিটাইজেশন যদি ডিজিটাল বাংলাদেশের অংশ হয়ে থাকে তবে তার জন্য বাজেট কোথায়? বাজেট বক্তৃতায় ও বরাদ্দে তার প্রতিফলন কোথায়?

বাজেটের অংকের হিসেবে জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার আওতায় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) তেও আইন ও বিচার বিভাগের তুলনামূলক হিস্যা কমে গেছে। গত অর্থ বছরে এ হিস্যার পরিমাণ ছিল ২৪%। প্রস্তাবিত বাজেটে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২০%। টাকার অংকে গত অর্থ বছরে আইন ও বিচার বিভাগের জন্য বরাদ্দ ছিল ১৫১৭ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত বাজেটে রাখা হয়েছে ১৪২১ কোটি টাকা। শতকরা হিসেবে কমে এসেছে ৬.৩ ভাগ। বাজেটে মূল্যস্ফীতি ধরা হয়েছে ৫.৫%। সেটি বিবেচনায় নিলে আইন ও বিচার বিভাগের বাজেট কমেছে শতকরা ১০ ভাগেরও বেশি। মোট টাকার অংকে সুপ্রিমকোর্টের বাজেট গত অর্থ বছরের ১৫৫ কোটি টাকা থেকে এ বছর ১৬৫ কোটি টাকা, অর্থাৎ ১০ কোটি টাকা বেশি ধরা হলেও ৫.৫% মূল্যস্ফীতি গণনায় নিলে সুপ্রিমকোর্টের বাজেটও কমেছে। শতকরা হিসেবে জাতীয় বাজেটে গত অর্থ বছরের তুলনায় এ বছর বেড়েছে ১৭.৫ ভাগ। বিপরীতে বিচার বিভাগ (সুপ্রিমকোর্ট এবং আইন ও বিচার বিভাগ) এর জন্য গত বছরের তুলনায় কমেছে ৫.১%। গত অর্থ বছরের তুলনায় এ বছরের এডিপি বাজেট বেড়েছে ৩৮%, অন্যদিকে বিচার বিভাগের জন্য এডিপি বরাদ্দ বেড়েছে মাত্র ৬.৫%। আবার এ ক্ষেত্রে যদি মূল্যস্ফীতি হিসেবে নেয়া হয় তবে প্রকৃত পক্ষে বিচার বিভাগের জন্য এডিপি বরাদ্দ বেড়েছে মাত্র ১.৫%। প্রস্তাবিত বাজেট অনুযায়ী সমগ্র বিচার বিভাগের জন্য বাৎসরিক মাথাপিছু খরচ হচ্ছে মাত্র ৯৯.৮০ টাকা এবং মাথাপিছু বাৎসরিক এডিপি বরাদ্দ হচ্ছে ৩১.৮৩ টাকা।

ইউএনডিপির এক গবেষণা থেকে জানা যায় বাংলাদেশে ২৫% খানা বিরোধের সাথে যুক্ত। সে হিসেবে চার কোটি মানুষ বিচারিক পরিষেবার সম্ভাব্য প্রত্যক্ষ সুবিধাভোগী। এ প্রত্যক্ষ সুবিধাভোগী বা সেবাগ্রহিতাদের জন্য বাৎসরিক মাথাপিছু বাজেট হচ্ছে মাত্র ৩৭৯ টাকা।

বিগত পাঁচ বছরের বাজেটের গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণেও একই রকম হতাশার চিত্র ফুটে ওঠে। জাতীয় বাজেট প্রতিবছরই অভিভূত হওয়ার মতো বাড়ছে। ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে এ বৃদ্ধির পরিমাণ ১২.৬%। ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে বেড়েছে ১৭.৫%। কিন্তু জাতীয় বাজেটে বিচার বিভাগের হিস্যার শতকরা হিসেবে তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি; প্রায় একই রকম থেকে গেছে ( মোট বাজেটের ০.৫% এর কম)। আর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ০.৩৩%-০.৪৩% এর মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে।

উন্নয়নের মহাসড়ক ও বিচারিক পরিষেবায় প্রবেশাধিকার
বিচার ব্যবস্থার জন্য বাজেট বরাদ্দ থেকে এটি স্পষ্ট যে, বিচার ব্যবস্থার উন্নয়নে ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় যে অগ্রাধিকারগুলি চিহ্নিত হয়েছিল, সেগুলি এবারের বাজেটে সক্রিয়ভাবে বিবেচনায় নেয়া হয়নি। ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা- উন্নয়ন পরিকল্পনায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। কিন্তু বিচারিক পরিষেবাসমূহ সে ডিজিটাল বাংলাদেশের অনিবার্য অংশ হয়ে উঠবে- সে রকম আলামত চোখে পড়ছে না। বাংলাদেশের আদালতগুলিতে অপেক্ষমাণ মামলার ক্রমবর্ধমান জটের অন্যতম কারণ মামলার তথ্য-ব্যবস্থাপনা ও সনাতন জটিল প্রক্রিয়া, যেটি কমে আসতে পারে ই-জুডিশিয়ারী প্রবর্তনের মাধ্যমে।

উপরের আলোচনা থেকে এটি স্পষ্ট যে, ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বিচার বিভাগের উন্নয়নে অনেক অঙ্গীকার রয়েছে। তবে একটি ভালো নীতিকাঠামো তখনই ভালো নীতিকাঠামো হিসেবে বিবেচিত হয়, যখন এটি বাস্তবায়নে বাস্তবসম্মত উদ্যোগ থাকে। ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বিচারব্যবস্থার উন্নয়নে যে অগ্রাধিকারগুলি রয়েছে তার জন্য যদি যথাযথ বাজেট না থাকে তাহলে সেটি শেষ পর্যন্ত কাগুজে পরিকল্পনা হিসেবেই থেকে যাবে। তার সুফল জনগণ পাবে না।

আবারও উল্লেখ করতে চাই এবারের বাজেট বক্তৃতার শিরোনাম হচ্ছে উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ। কিন্তু উন্নয়নকে শুধু মাথাপিছু আয়, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ দিয়ে বিবেচনা করলে চলবে না। উন্নয়নকে বিবেচনা করতে হবে অমর্ত্য সেনের ভাষায়- মানুষের সামগ্রিক সক্ষমতার বিকাশ হিসেবে, মানুষের স্বাধীনতার চৌহদ্দি বাড়াবার প্রক্রিয়া হিসেবে। মানুষের স্বাধীনতার চৌহদ্দি বাড়াবার অন্যতম শর্ত হচ্ছে একটি কার্যকর বিচারিক পরিষেবা ব্যবস্থা। মনে রাখতে হবে উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য নয়; লক্ষ্যে পৌঁছাবার উপায় মাত্র।সম্ভবত এ কারণেই ঘানার লিগ্যাল এইডের নির্বাহী পরিচালক বলেছেন- একটি সমাজের জনগোষ্ঠী যদি মনে করে তাদের বিচার ব্যবস্থায় সমান প্রবেশাধিকার নেই, তাহলে সে উন্নয়নকে আপনি উন্নয়ন বলতে পারেন না।

সুতরাং বাংলাদেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে উঠতে হলে একটি উন্নত বিচারিক পরিষেবা ব্যবস্থা নিশ্চিত করেই উঠতে হবে। বাজেট প্রণয়ন ও বণ্টন প্রক্রিয়ায়ও সেটি সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করতে হবে। একটি কার্যকর বিচারিক পরিষেবা ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে উঠবে, টিকে থাকবে- সেটিই হোক আমাদের সবার প্রত্যাশা।

মুনীর উদ্দীন শামীম, গবেষক ও উন্নয়ন কর্মী; সুশাসন বিষয়ক একটি কারিগরি প্রকল্পে কর্মরত।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ